নূর ঘাচাম বাড়ির ধ্বংসস্তূপ হাতড়ে মায়ের ছোট কালো জুতাজোড়া বের করলেন। জুতাজোড়া আলতো করে ধরে তাতে চুমু খেলেন।
নূর ঘাচামের (৪৮) মায়ের নাম নাজওয়া ঘাচাম। খুবই স্বাধীনচেতা একজন মানুষ ছিলেন তিনি। চারদিকে ইসরাইলের বোমাবর্ষণ ও লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহর সঙ্গে তাদের লড়াই চলার মধ্যেও এক বছর তিন মাস নাজওয়া দেশটির দক্ষিণের গ্রাম ইয়ারুনে নিজের বাড়ি ছেড়ে যাননি।
‘মা তার বাড়িটা খুব পছন্দ করতেন। এটা পরিষ্কার যে, তিনি নিজের বাড়িকে খুব গুরুত্ব দিতেন,’ মিডলইস্ট আইকে বলছিলেন নূর ঘাচাম। মিডল ইস্ট আই, রয়টার্স।
একসময় বাড়িটা কেমন ছিল, তা দেখাতে নূর তার মুঠোফোন বের করেন। সাদা পাথরে তৈরি দোতলা বাড়ি। টেরাকোটা ছাদের টালি, আকাশি রঙের শাটার। বাড়ির সম্মুখে উঠানের গেটের ওপর ছড়িয়ে আছে বেগুনি ফুলের ঝাড়। বাড়ির প্রবেশপথে একটি পাইনগাছ, শাখাগুলো ছাদের ওপর প্রসারিত।
যাহোক, গত বছরের ২৭ নবেম্বর দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি শুরু হয়। তবে তখনো ইসরাইলী সেনারা ইয়ারুন ছেড়ে যাননি। সালমান বলেন, নাজওয়ার ওপর ইসরাইলী সেনারা একদিন গুলী চালান। তিনি ও তার দল বারবারই নাজওয়ার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ৩০ দিন ওই এলাকা অবরুদ্ধ করে রেখে তাদের ঢুকতে দেননি ইসরাইলী সেনারা।
নাজওয়ার বাড়ির সামনের বাড়িতেই থাকেন শহরের মেয়র ও তার স্ত্রী লায়লা তাহফা (৫৩)। তাহফা বলেন, তার মনে আছে, নাজওয়া ঘণ্টার পর ঘণ্টা নিজ বাড়ির সিঁড়িগুলো ও আশপাশের স্থান পরিষ্কার কিংবা বাগান পরিচর্যার কাজ করতেন।
তাহফা মিডলইস্ট আইকে বলেন, ‘নাজওয়ার কাছে তার বাড়িটা ছিল একটা রাজ্যের মতো, বাইরের কিছুই যেন এর কাছে কিছু নয়।’
নাজওয়ার সঙ্গে নিজের কিছু সুখস্মৃতির কথা স্মরণ করেন তাহফা। তাকে অনেক বছর ধরে চিনতেন তিনি। বলেন, ‘৭০-এর কাছাকাছি বয়সে এসেও তিনি (নাজওয়া) ছিলেন প্রাণবন্ত, সব সময় গল্প করতে পছন্দ করতেন।’
তাহফা বলছিলেন, হিজবুল্লাহর সঙ্গে ইসরাইলের যুদ্ধ বাধলে তার নিরাপত্তার কথা ভেবে তাকে নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন তারা। কিন্তু তিনি সব সময় বলতেন, “আমি বোমার ভয় পাই না, শুধু আমার বাড়িতে থাকতে চাই।”’
আমি তার (নাজওয়া) মরদেহ দেখেছি, তিনি বৃদ্ধ নারী ছিলেন। তাকে গুলী করার কোনো দরকার ছিল না।
মোহাম্মদ সালমান, লেবাননের চিকিৎসক একদিন ২৮ বছর বয়সী চিকিৎসক মোহাম্মদ সালমান ও তার উদ্ধারকর্মী দল নাজওয়াকে বাড়ি ছেড়ে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার বিষয়ে রাজি করাতে সক্ষম হয়। কিন্তু অল্প দিন পরই আবার বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি।
মোহাম্মদ সালমান মিডল ইস্ট আইকে বলেন, ‘স্রষ্টার নামে শপথ করে বলছি, নাজওয়া হেঁটে বাড়ি ফিরছিলেন।’
‘তাকে গুলী করার কোনো প্রয়োজনই ছিল না’
যুদ্ধের মধ্যে নাজওয়াকে যারা মাঝেমধ্যে দেখতে যেতেন, তাদের একজন সালমান। তারা তাকে খাবার, পানি ও অন্যান্য অপরিহার্য সামগ্রী দিয়ে আসতেন।
যাহোক, গত বছরের ২৭ নবেম্বর দুই পক্ষের মধ্যে যুদ্ধবিরতি শুরু হয়। তবে তখনো ইসরাইলী সেনারা ইয়ারুন ছেড়ে যাননি। সালমান বলেন, নাজওয়ার ওপর ইসরাইলী সেনারা একদিন গুলী চালালেন। তিনি ও তার দল বারবারই নাজওয়ার কাছে পৌঁছানোর চেষ্টা করেছেন। কিন্তু ৩০ দিন ওই এলাকা অবরুদ্ধ করে রেখে তাদের ঢুকতে দেননি ইসরাইলী সেনারা।
সালমান বলেন, অবশেষে এক মাস পর ২৭ ডিসেম্বর তারা নাজওয়ার বাড়িতে পৌঁছাতে সক্ষম হন। দেখেন, নাজওয়া মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। তিনি বলেন, তাকে তিনবার গুলী করা হয়েছে। তার শরীরের আঘাতের চিহ্নও ছিল। এতে মনে হয়, তাকে মারধর বা পদদলিত করা হয়েছে।
চিকিৎসক সালমান বলেন, অবশেষে এক মাস পর ২০২৪ সালের ২৭ ডিসেম্বর তারা নাজওয়ার বাড়িতে পৌঁছাতে সক্ষম হন। দেখেন, নাজওয়া মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। তাকে তিনবার গুলী করা হয়েছে। শরীরের আঘাতের চিহ্নও ছিল। এতে মনে হয়, তাকে মারধর বা পদদলিত করা হয়েছে।
‘আমি তার (নাজওয়া) মরদেহ দেখেছি, তিনি বৃদ্ধ নারী ছিলেন। তাকে গুলী করার কোনো দরকার ছিল না,’ বলছিলেন সালমান।
নাজওয়ার মরদেহ উদ্ধার করে তা গ্রামের কাছাকাছি তেবনাইন গভর্নমেন্ট হাসপাতালে পৌঁছে দেন চিকিৎসক সালমান।
হাসপাতাল থেকে চিকিৎসকদের দেওয়া একটি প্রতিবেদন মিডলইস্ট আইয়ের হাতে এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইসরাইলী সেনাদের আগ্রাসনে নিহত নাজওয়ার মরদেহ হাসপাতালে নিয়ে আসে লেবাননের রেডক্রস। মাথা, তলপেট ও বুকে আঘাতের কারণে তিনি মারা গেছেন। তার বাঁ ঊরু ভাঙা ছিল।’
নাজওয়ার ঘটনা নিয়ে ইসরাইলী সেনাদের কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চায় মিডল ইস্ট আই। তবে তারা তাতে সাড়া দেয়নি।
‘তিনি জন্মস্থানকে ভালোবাসতেন’
নাজওয়ার ছেলে নূরের কিশোরকাল কেটেছে ইয়ারুন গ্রামে। ইসরাইলের বোমা হামলায় বিধ্বস্ত নিজেদের বাড়িতে এসে ধ্বংসস্তূপ এক পাশে সরিয়ে রাখছিলেন তিনি। এক জায়গায় একটা চুলার ঝাঁঝরি পান। নূর বলেন, এটি ছিল রান্নাঘরের স্থান। এখানে মায়ের সঙ্গে ঘণ্টার পর ঘণ্টা বসে কাটাতেন তিনি।
নূর বলেন, রান্না শেষে মা ওই জায়গা পরিষ্কার করতেন। পরে দীর্ঘ সময় বসে তারা গল্প করতেন।
বাবা ও দুই ভাইয়ের সঙ্গে ১৯৯১ সালে ইয়ারুন ছেড়ে ভেনেজুয়েলা চলে যান নূর। ওই সময় ইসরাইলী বাহিনী তাদের গ্রাম দখল করে নেয়। তখন তার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। কিন্তু বাড়ির বারান্দা থেকে ইসরাইলের মারাকাভা ট্যাংকের আনাগোনার দৃশ্য এখনো মনে করতে পারেন।
২০২৩ সালের ৮ অক্টোবর (ইসরাইলে ফিলিস্তিনী স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের হামলার পরদিন) লেবাননে ইসরাইলী বাহিনী ও হিজবুল্লাহর মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়। ওই সময় ইয়ারুন থেকে রাজধানী বৈরুতের উদ্দেশে পালিয়ে যান নাজওয়ার অনেক আত্মীয়স্বজন। যুদ্ধ থামলেও গ্রামে ফিরতে ভয় পেতেন তারা।
গত বছরের ২৩ সেপ্টেম্বরের পর ইয়ারুনে লড়াই ও ইসরাইলের বিমান হামলা জোরালো হয়। ওই সময় দেশের অন্যান্য অংশেও হামলা জোরদার করে ইসরাইল। এতে চাহিন নাজওয়াকে দেখতে ইয়ারুনে আসতে পারেননি। তিনি বলেন, ‘কিন্তু আমি সব সময় ভাবতাম, তিনি বেঁচে আছেন। কেননা, এমন পরিস্থিতিতে কীভাবে বাঁচতে হয়, তা তিনি জানতেন।’
দুই মাস পর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলে সেদিনই চাহিন নাজওয়াকে দেখতে ইয়ারুন গ্রামে ছুটে আসেন। ‘সৌভাগ্যবশত আমরা তাকে বেঁচে থাকতে দেখি। ভেবেছিলাম, যুদ্ধ বন্ধ হয়েছে। তাই তাকে বলি, তোমার কাছে আমরা আগামীকাল ফিরব।’
‘আগামীকাল আর এল না’
‘যুদ্ধবিরতির দ্বিতীয় দিন আমরা ইয়ারুনে ফিরে এলাম। তখন ইসরাইলী বাহিনী আমাদের লক্ষ্য করে গুলী ছুড়তে শুরু করে। তারা আমাদের গ্রামে ঢুকতে দিতে চায়নি,’ বলেন চাহিন।
চাহিন জানান, এরপর ইয়ারুনে ইসরাইলের হামলা আরও জোরালো হয়। নাজওয়াকে সরিয়ে নিতে তার বাড়িতে ছুটে যান তিনি। দক্ষিণ লেবাননে অবস্থানরত রেডক্রস ও জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী বাহিনী ইউনিফিলকে জানান, গ্রামে একজন বেসামরিক ব্যক্তি আটকে পড়েছেন।
পরে রেডক্রস ও শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্যরা গ্রামে ঢোকার চেষ্টা করেন। কিন্তু ইসরাইলী বাহিনী গুলী ছুড়ে তাদের ঢুকতে দেয়নি। এর দুই সপ্তাহ পর নাজওয়ার বাড়িতে যেতে সক্ষম হন তারা। তবে দেখেন, বাড়িতে গুলীবিদ্ধ হয়ে মৃত পড়ে আছেন তিনি।
‘এ খবর বজ্রাঘাতের মতো’
নাজওয়ার নিহত হওয়ার খবর ইয়ারুনের গ্রামবাসীকে শোকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছিল। চাহিন বলেন, ‘নাজওয়া যে ওই বাড়িতে থাকেন, ইসরাইলী বাহিনী তা প্রথম দিন থেকেই জানত। যুদ্ধ চলাকালে তারা তার কিছু করেনি। কিন্তু যুদ্ধবিরতির পর তারা কেন তার বাড়িতে গেল, তাকে মারধর করল ও গুলী করে মারল, তা জানি না। তিনি কারও জন্য ক্ষতির কারণ ছিলেন না।’
নাজওয়ার প্রতিবেশী তাহফা বলেন, ‘তার নিহত হওয়ার খবর ছিল বজ্রাঘাতের মতো। এটা মেনে নেওয়া কঠিন ছিল। তাকে সুস্থ অবস্থায় পাব, তাকে অভিনন্দন জানাব- সেই প্রত্যাশায় গ্রামে ফেরার অপেক্ষায় ছিলাম আমরা।’
তাহফার ক্ষোভ, ‘ইসরাইলী সেনারা কেন তার বাড়িতে গেল? তার কাছে তো কোনো অস্ত্র ছিল না। তিনি তো প্রতিরোধ বাহিনী হিজবুল্লাহর সদস্যও ছিলেন না। তবে কেন তারা বাড়িতে ঢুকে তাকে মেরে ফেলে গেল?’
৬০ দিনের যুদ্ধবিরতির মধ্যে নাজওয়াকে যখন মেরে ফেলা হয়, তখন ইসরাইলী বাহিনী ইয়ারুনে বিমান হামলা জোরদার করে। গ্রামের ৯০ শতাংশ বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। বাকি যে ১০ শতাংশ বাড়িঘর ছিল, তা–ও হয় ক্ষতিগ্রস্ত। এসব বাড়ির অনেকগুলোই ছিল আগুনে পোড়া, জানান তাহফা।