এপি : ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার ফ্রান্সের সাহসী সিদ্ধান্ত মধ্যপ্রাচ্যের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার ধরন পাল্টে দিতে পারে। যদিও এটি গাজায় চলমান সংঘর্ষ বা ইসরাইল-হামাস যুদ্ধের ওপর তাৎক্ষণিক কোনো প্রভাব ফেলবে না বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিশ্বজুড়ে একাধিক শক্তিধর রাষ্ট্র যে সময় নিজেদের মতামত চাপিয়ে দিতে সামরিক শক্তির আশ্রয় নিচ্ছে, যেমন রাশিয়া ইউক্রেনে কিংবা সম্প্রতি ইরান ও তাদের পরমাণু স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্র-ইসরাইলের হামলা; সেই সময় কূটনৈতিক সমাধান এবং ‘যুদ্ধ নয়, শান্তির’ বার্তাই দিতে চাইছেন ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ।
নিজের দ্বিতীয় ও শেষ মেয়াদের আর দুই বছরের কম সময় বাকি থাকা মাখোঁর জন্য এ বিষয় ব্যক্তিগত ভাবমর্যাদার সঙ্গেও জড়িত। ফিলিস্তিনের গাজায় মানবিক বিপর্যয়ের সময় কার্যকরভাবে এগিয়ে না এলে ইতিহাসের পাতায় তা কালিমা হয়ে থাকতে পারে। পারমাণবিক শক্তিধর, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিকভাবে প্রভাবশালী এবং জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের একটি দেশের নেতা হিসেবে মাখোঁর হাতে বৈশ্বিক ঘটনাপ্রবাহে প্রভাব রাখার অনেক উপায় রয়েছে।
জি-৭ গোষ্ঠীর প্রথম দেশ হিসেবে ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেওয়ার পদক্ষেপ নেওয়া মাখোঁর জন্য নিজ দেশে রাজনৈতিক ঝুঁকি থাকাও অস্বাভাবিক নয়। ইউরোপে সবচেয়ে বড় ইহুদি ও মুসলিম জনগোষ্ঠীর বসবাস ফ্রান্সে। এমন এক দেশে প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি জনমতের ভারসাম্যে হাঁটছেন।
তার ঘোষণায় কিছু মানুষ আনন্দিত হবেন, আবার কেউ ক্ষুব্ধ। গত বৃহস্পতিবার রাতে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া তার ঘোষণার পর ফ্রান্সের রাজনৈতিক অঙ্গনে দ্বিধাবিভক্ত প্রতিক্রিয়ায় এর প্রতিফলন পাওয়া গেছে।
এমন পদক্ষেপ সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কৃত এবং গাজা যেভাবে ইরানের প্রক্সিতে পরিণত হয়েছে, সেভাবে আরেকটি প্রক্সি তৈরি হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হলে তা ইসরাইলের পাশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নয়, বরং ইসরাইল ধ্বংসের প্ল্যাটফর্ম হবে।
তবে ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসের হামলার পর ইসরাইলের আত্মরক্ষার অধিকারকে দৃঢ়ভাবে সমর্থন করার পরও এখন মাখোঁ ইঙ্গিত দিচ্ছেনÑ এ সমর্থনেরও একটা সীমা রয়েছে।
ফ্রান্সের এ অবস্থান বদলে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু। তিনি বলেন, ‘এমন পদক্ষেপ সন্ত্রাসবাদকে পুরস্কৃত এবং গাজা যেভাবে ইরানের প্রক্সিতে পরিণত হয়েছে, সেভাবে আরেকটি প্রক্সি তৈরি হওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি করবে। বর্তমান পরিস্থিতিতে ফিলিস্তিন রাষ্ট্র গঠিত হলে তা ইসরাইলের পাশে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নয়, বরং ইসরাইল ধ্বংসের প্ল্যাটফর্ম হবে।’
এটি একটি পদক্ষেপ কিন্তু তা কোনো জাদুর কাঠি নয়
ফিলিস্তিন ও ইসরাইলের নিজ নিজ রাষ্ট্রে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ধারণা আজকের বাস্তবতায় আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি দূরাশার বলেই মনে হচ্ছে। কেননা, ইসরাইলের তা-বে ফিলিস্তিনের গাজা একরকম ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে এবং দখলকৃত পশ্চিম তীরেও ইসরাইলি অবৈধ বসতি স্থাপন ক্রমেই বাড়ছে।
এ অবস্থায় শুধু মাখোঁর বক্তব্যেই বাস্তবতা বদলাবে না। তবুও তার বার্তা স্পষ্ট, ইসরাইল-ফিলিস্তিন সংকটে ‘দ্বি-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান’ কূটনৈতিক পথে অর্জন করার আশা কখনো হারিয়ে যেতে দেওয়া যাবে না, তা আজ যতই অসম্ভব মনে হোক।
তথাকথিত ‘পি-৫’ রাষ্ট্রগুলো নানা ইস্যু, যেমন ইউক্রেন, বাণিজ্য, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে পরস্পর বিভক্ত। ফলে শুধু ফ্রান্সের অবস্থান বদলে হঠাৎই ফিলিস্তিনিদের জন্য পরিস্থিতি আমূল বদলে যাবে, এমন আশা করাটা ঠিক হবে না। তবে গাণিতিক অর্থে হলেও ইসরাইলের সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এখন মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আলোচনায় বড় শক্তিগুলোর মধ্যে কিছতা একঘরে হয়ে পড়তে পারে।
মাখোঁ এক চিঠিতে ফিলিস্তিনের প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসকে লেখেন, ‘এ সমাধানই একমাত্র পথ, যা ইসরাইলি ও ফিলিস্তিনিদের ন্যায্য আকাঙ্ক্ষার জবাব দিতে পারে। এখন যত দ্রুত সম্ভব তা বাস্তবায়ন করতে হবে।’
মাখোঁ আরও লেখেন, ‘মধ্যপ্রাচ্য সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা ক্রমেই দুরূহ হয়ে উঠছে। আমি এটা মেনে নিতে পারি না।’
ফ্রান্সের সিদ্ধান্তের তাৎক্ষণিক প্রভাব গাজায় না হলেও বিশ্বের বিভিন্ন রাজধানীতে পড়তে পারে; যেখানে অন্য রাষ্ট্রপ্রধানেরা ফ্রান্সের পথ অনুসরণের জন্য চাপের মুখে পড়তে বা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নতুন করে অনুপ্রাণিত হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে জি-৭ জোটের অন্য দেশগুলোর দিকে এখন নজর বেশি, কারণ, তাদের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব অনেক।
ফ্রেঞ্চ ইনস্টিটিউট অব স্ট্র্যাটেজিক অ্যানালাইসিসের বিশ্লেষক ডেভিড রিগুলে-রোজে বলেন, ‘মাখোঁর ঘোষণা একটি নজির সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, জি-৭ এর কোনো পশ্চিমা দেশ এই প্রথম এ ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। এটি অন্যদেরও অনুসরণে উৎসাহিত করতে পারে।’
মাখোঁর ঘোষণা একটি নজির সৃষ্টি করতে পারে। কারণ, জি-৭–এর কোনো পশ্চিমা দেশ এই প্রথম এ ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছে। এটি অন্যদেরও অনুসরণে উৎসাহিত করতে পারে।
যদিও ইতিমধ্যে ১৪০টির বেশি দেশ ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে, তবু ইউরোপের মধ্যে ফ্রান্স হবে সবচেয়ে বড়, জনবহুল ও ক্ষমতাধর রাষ্ট্র; যারা এ পদক্ষেপ নিচ্ছে।
লন্ডনভিত্তিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান চ্যাথাম হাউসের জ্যেষ্ঠ গবেষক ইয়োসি মেকেলবার্গ বলেন, ‘এটি কিছতা গতি তৈরি করতে পারে। তবে এটুকুই যথেষ্ট নয়।’ তিনি আরও বলেন, ‘ফ্রান্সকে সাধুবাদ জানাতে হবে, আর মাখোঁর সাহসিকতা প্রশংসার যোগ্য।’
ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলোর ভারসাম্যে পরিবর্তন
এখন পর্যন্ত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ স্থায়ী সদস্যের মধ্যে চীন ও রাশিয়াই শুধু ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিয়েছে। আগামী সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে মাখোঁ তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করলে ফ্রান্স এ দেশগুলোর সঙ্গে যুক্ত হবে। ফলে পরিষদে স্থায়ী সদস্য হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য তখন সংখ্যালঘু হয়ে যাবে। কারণ, তারা এখনো ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়নি।
এ তথাকথিত ‘পি-৫’ রাষ্ট্রগুলো নানা ইস্যু, যেমন ইউক্রেন, বাণিজ্য, জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে পরস্পর বিভক্ত। ফলে শুধু ফ্রান্সের অবস্থান বদলে হঠাৎ করেই ফিলিস্তিনিদের জন্য পরিস্থিতি আমূল বদলে যাবে, এমন আশা করাটা ঠিক হবে না। তবে গাণিতিক অর্থে হলেও, ইসরাইলের সবচেয়ে বড় মিত্র যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য এখন মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে আলোচনায় বড় শক্তিগুলোর মধ্যে কিছতা একঘরে হয়ে পড়তে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প গত শুক্রবার মাখোঁর সিদ্ধান্ত খাটো করে বলেন, ‘ও কী বলল, সেটা কোনো গুরুত্বই রাখে না। এতে কিছুই বদলাবে না।’
যুক্তরাজ্য যদি অনুসরণ করে তবে চিত্র বদলাতে পারে
যুক্তরাজ্যের সঙ্গে ফ্রান্সের সম্পর্ক এখন আগের চেয়ে মজবুত। ব্রেক্সিট-পরবর্তী সময়ে ইউক্রেন ইস্যুতে দুই দেশের সহযোগিতা বেড়েছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার যদি মাখোঁর পথ অনুসরণ করেন, তবে নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচ বড় শক্তির মধ্যে ট্রাম্পই হয়ে পড়বেন একমাত্র ব্যতিক্রম, যিনি ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দিতে অনাগ্রহী।
ফ্রান্সের সিদ্ধান্তের তাৎক্ষণিক প্রভাব গাজায় না হলেও বিশ্বের বিভিন্ন রাজধানীতে পড়তে পারে; যেখানে অন্য রাষ্ট্রপ্রধানেরা ফ্রান্সের পথ অনুসরণের জন্য চাপের মুখে পড়তে বা ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে নতুন করে অনুপ্রাণিত হতে পারেন। এ ক্ষেত্রে বিশেষ করে জি-৭ জোটের অন্য দেশগুলোর দিকে এখন নজর বেশি, কারণ, তাদের অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব অনেক।
স্টারমার ইতিমধ্যে গাজায় মানবিক বিপর্যয় নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বৃহস্পতিবার দেওয়া এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘গাজায় দুর্ভোগ ও অনাহার বর্ণনার অতীত ও অমার্জনীয়।’ তবে এখনো তিনি মাখোঁর মতো স্পষ্ট অবস্থান নেননি; বরং বলছেন, ‘প্রথমে যুদ্ধবিরতি প্রয়োজন।’
স্টারমার বলেন, ‘ফিলিস্তিনি জনগণের জন্য রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি একটি অবিচ্ছেদ্য অধিকার। যুদ্ধবিরতির মাধ্যমেই আমরা ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি এবং দুই রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধানের পথে এগোতে পারি।’