ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকায় ইসরাইল গণহত্যা চালিয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘের স্বাধীন আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিশন (সিওআই)। এই গণহত্যায় ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুসহ অন্য নেতারা উস্কানি দিয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। গতকাল মঙ্গলবার প্রকাশিত প্রতিবেদনে তদন্ত কমিশন বলেছে গণহারে মানুষকে হত্যা, ত্রাণ প্রবেশে অবরোধ, জোর করে মানুষকে স্থানচ্যুত করা এবং শিশুদের ক্লিনিক ধ্বংসের বিষয়টিকে তারা বিবেচনায় নিয়েছেন। এতে দেখা গেছে ইসরাইল গাজায় গণহত্যা চালিয়েছে। টাইমস অব ইসরাইল,আনাদোলু,আল জাজিরা, দ্য গার্ডিয়ান

তদন্ত কমিশন জাতিসংঘের সম্পূর্ণ স্বাধীন একটি সংস্থা। এটি জাতিসংঘের হয়ে কোনো কথা বলে না। গাজার গণহত্যা নিয়ে কাজ করায় সংস্থাটিকে নিয়ে ইসরাইল ব্যাপক সমালোচনা করে থাকে।

তদন্ত কমিশনের প্রধান নাভি পিল্লাই বলেছেন, “গাজায় গণহত্যা হচ্ছে এবং গণহত্যা এখনো সংঘটিত হচ্ছে। এসব নৃসংশ অপরাধের দায় ইসরাইলের সর্বোচ্চ নেতাদের ওপর বর্তায়। যারা গত দুই বছর ধরে একটি গণহত্যার ছক কষেছেন। যেটির বর্তমান নির্দিষ্ট লক্ষ্য হলো গাজার ফিলিস্তিনিদের ধ্বংস করা।” দখলদার ইসরাইল জাতিসংঘের স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনটি প্রত্যাখ্যান করেছে। এছাড়া তদন্ত কমিশনকে বিলুপ্তের দাবিও জানিয়েছে তারা। ফিলিস্তিনের গাজা সিটিতে ইসরাইলি সেনারা মঙ্গলবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্থল হামলা শুরু করেছে। ঠিক ওই সময় তদন্ত কমিশন ইসরাইলের গণহত্যার প্রতিবেদন প্রকাশ করল। ইসরাইলি হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৬৫ হাজার মানুষ নিহত হয়েছেন। আহত হয়েছেন আরও দেড় লাখের বেশি বাসিন্দা। ইসরাইলের বর্বর হামলার কারণে সেখানকার আইনশৃঙ্খলার পরিস্থিতি ভেঙে পড়েছে। ইসরাইলের অবরোধের কারণে গাজার বিভিন্ন জায়গায় দুর্ভিক্ষও দেখা দিয়েছে।

গাজা সিটিতে হাজার হাজার সেনা দিয়ে স্থল হামলা শুরু ইসরাইলের : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকার বৃহৎ শহর গাজা সিটিতে স্থল হামলা শুরু করেছে দখলদার ইসরাইল। গত সোমবার রাতে ব্যাপক হামলা চালানো শুরু করে তারা। ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, স্থল হামলায় অংশ নিয়েছে তাদের দুটি ডিভিশন। এ দুই ডিভিশনে হাজার হাজার সেনা রয়েছে। স্থল হামলা শুরুর আগে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে গাজা সিটিতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করেছে দখলদার ইসরাইল। বিমান ও ড্রোন থেকে মিসাইল ও বোমা ফেলে গাজা সিটির প্রায় সব উঁচু ভবন ধসিয়ে দেওয়া হয়েছে। গাজা সিটিতে স্থল হামলার আগে আশপাশের অঞ্চলগুলোতে অবস্থান নিয়েছিল ইসরাইলি সেনারা। ইসরাইলি সেনাবাহিনী জানিয়েছে, তাদের ১৬২ নং এবং ৯৮ নং ডিভিশন গাজা সিটিতে অবস্থান করছে এবং সেখানে হামলার পরিধি বাড়াচ্ছে। এ দুই ডিভিশনের সঙ্গে ৩৬ নং ডিভিশন পরবর্তীতে যোগ দেবে। এরমাধ্যমে গাজা সিটিতে ইসরাইলি সেনার সংখ্যা আরও কয়েক হাজার গুণ বাড়বে। গতকাল রাতে স্থল সেনারা গাজা সিটিতে প্রবেশের আগে ব্যাপক বোমাবর্ষণ করে ইসরাইলি বিমানবাহিনী। গাজা সিটিতে প্রায় ১০ লাখ মানুষ ছিলেন। ইসরাইল এ হামলা শুরুর আগে শহরটির সব বাসিন্দাকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল। কিন্তু এখনো সেখানে আরও ৬ লাখ মানুষ রয়ে গেছেন।

ইসরাইলি সেনাবাহিনীর ধারণা গাজা সিটিতে হামাসের তিন থেকে চার হাজার যোদ্ধা রয়েছে। যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্ত ইসরাইলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু দাবি করছেন, গাজা সিটির নিয়ন্ত্রণ তারা নিতে পারলে জিম্মিদের উদ্ধার করা যাবে। তবে জিম্মিদের পরিবারের সদস্যরা এ হামলা নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, এতে তাদের প্রিয়জনরা মারা যেতে পারেন।

গাজায় ইসরাইলি হামলায় ১৪ বছর বয়সী ফুটবলারসহ পরিবারের ১৪ সদস্য নিহত : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখ-ে ইসরাইলি বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন ১৪ বছর বয়সী ফিলিস্তিনি ফুটবলার মোহাম্মদ রামেজ আল-সুলতান। এ ঘটনায় তার পরিবারের আরও ১৪ জন প্রাণ হারিয়েছেন। গত শুক্রবার হওয়া হামলায় তারা প্রাণ হারান। নিহত রামেজ আল-সুলতান বৈশ্বিক ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা অনুমোদিত একাডেমির ফুটবলার ছিলেন। গতকাল মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা । বার্তাসংস্থাটি বলছে, গাজা সিটির উত্তরে ইসরাইলি বিমান হামলায় ফিলিস্তিনি কিশোর ফুটবলার মোহাম্মদ রামেজ আল-সুলতান (১৪) প্রাণ হারিয়েছেন। এ ঘটনায় তার পরিবারের আরও ১৪ জন সদস্যও নিহত হয়েছেন বলে সোমবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে ফিলিস্তিনি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশন। গত শুক্রবার আল-তুওয়াম এলাকায় আল-সুলতানের পরিবারের বাড়িতে ইসরাইলি বাহিনী হামলা চালালে তিনি নিহত হন। আল-হিলাল ক্লাব সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে লিখেছে, ফিফা অনুমোদিত একাডেমির স্নাতক খেলোয়াড় ছিলেন আল-সুলতান। তিনি বাবা ও আত্মীয়দের সঙ্গে প্রাণ হারিয়েছেন। এ ঘটনায় তার সতীর্থ মালিক আবু আল-আমারেনের সঙ্গে তিনিও ‘শহীদদের কাতারে’ যুক্ত হলেন। এর আগে গত ৬ সেপ্টেম্বর আল-হিলালের যুব খেলোয়াড় মালিক আবু আল-আমারেন গাজার উত্তরে মানবিক সহায়তার অপেক্ষায় থাকা অবস্থায় ইসরাইলি বাহিনীর গুলিতে নিহত হন।

আল-সুলতান ও তার পরিবারের মৃত্যু এমন সময় ঘটল, যখন ইসরাইলি হামলায় গাজায় অনেকের পুরো পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। এই হামলায় ক্রীড়াবিদ, সাংবাদিক, চিকিৎসক ও শিক্ষার্থীসহ সমাজের সব শ্রেণির মানুষ নিহত হচ্ছেন। ফিলিস্তিনি ফুটবল অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট জিবরিল রাজুব গত ২৬ আগস্ট জানিয়েছিলেন, ইসরাইলি আগ্রাসনে ফিলিস্তিনি ক্রীড়াঙ্গন অভূতপূর্ব বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে। এখন পর্যন্ত ৭৭৪ জন ক্রীড়া-সম্পর্কিত ব্যক্তির প্রাণহানি ঘটেছে। তাদের মধ্যে ৩৫৫ জন ফুটবলার, ২৭৭ জন অন্য ফেডারেশনের খেলোয়াড় ও ১৪২ জন স্কাউট। এছাড়া আরও ১১৯ জন নিখোঁজ রয়েছেন। নিহতদের মধ্যে ১৫ জন ক্রীড়া সাংবাদিকও আছেন। এ ছাড়া পশ্চিম তীর ও গাজায় ২৮৮টি ক্রীড়া অবকাঠামো সম্পূর্ণ বা আংশিক ধ্বংস হয়ে গেছে। ২০২৩ সালের অক্টোবরে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরাইলি হামলায় গাজায় প্রায় ৬৫ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞে পরিণত হওয়া এ ভূখ- এখন দুর্ভিক্ষের মুখে। গাজায় চলমান যুদ্ধকে কেন্দ্র করে ইসরাইলের বিরুদ্ধে গণহত্যার অভিযোগে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে মামলা চলছে।

গাজায় ৬ বছর বয়সী জমজ শিশুসহ নিহত আরও ৫১ ফিলিস্তিনি : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখ-ের সবচেয়ে বড় নগরী গাজা সিটিতে ইসরাইলের ব্যাপক বিমান হামলায় লাখো মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় এই শহরে টানা বোমাবর্ষণে অন্তত ৫১ জন নিহত হয়েছেন। নিহতদের মধ্যে জমজ শিশু ও সাংবাদিকও রয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে সংবাদমাধ্যম।

সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ইসরাইল সোমবার সন্ধ্যায় গাজা সিটিতে ব্যাপক বোমাবর্ষণ চালিয়ে এলাকার সর্বোচ্চ আবাসিক ভবন আল-ঘাফরি হাইরাইজ ধ্বংস করেছে। এই তীব্র হামলার কারণে লাখো বাসিন্দা শহর ছেড়ে পালাতে বাধ্য হচ্ছেন। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি ভূখ-ে মানবাধিকার বিষয়ক বিশেষ র‌্যাপোর্টার ফ্রান্সেসকা আলবানিজে অভিযোগ করেছেন, ফিলিস্তিনিদের জোরপূর্বক উৎখাত করতে ইসরাইল অপ্রচলিত অস্ত্র ব্যবহার করছে।

ইসরাইলি টিভি চ্যানেল ১২ জানায়, গাজা সিটির উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে ‘অস্বাভাবিক তীব্র হামলা’ চালানো হয়েছে। ফিলিস্তিনি সিভিল ডিফেন্স জানিয়েছে, গত কয়েক সপ্তাহে অন্তত ৫০টি বহুতল ভবন মাটির সঙ্গে মিশিয়ে দিয়েছে ইসরাইল। শহরের অন্যান্য এলাকাও ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। শুধু জায়তুন এলাকায় আগস্টের শুরু থেকে ১ হাজার ৫০০’র বেশি বাড়িঘর ধ্বংস হয়েছে। ইসরাইলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসরাইল কাটজ টানা তৃতীয় দিনের মতো হামলার ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশ করে লিখেছেন, “সন্ত্রাসের টাওয়ার সমুদ্রে ভেঙে পড়েছে”। তবে ভবনটি হামাসের ব্যবহৃত ছিল এমন কোনো প্রমাণ তিনি দেননি।

২৩ মাস ধরে চলা যুদ্ধের মধ্যে আবাসিক এলাকা, স্কুল ও হাসপাতালও বারবার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৪ ঘণ্টায় শুধু গাজা সিটিতেই ৫১ জন নিহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে ছয় বছর বয়সী যমজ শিশুও রয়েছে।

এছাড়া তিন সাংবাদিকও পৃথক হামলায় নিহত হয়েছেন। তারা হচ্ছেন- নাসর এলাকায় প্রতিবেদক মোহাম্মদ আল-কুইফি, ফটোগ্রাফার ও সম্প্রচার প্রকৌশলী আইমান হানিয়ে এবং সাংবাদিক ইমান আল-জামিলি। এ নিয়ে ইসরাইলি হামলায় নিহত সাংবাদিক ও গণমাধ্যমকর্মীর সংখ্যা প্রায় ২৮০ জনে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর মতে, সাংবাদিকদের জন্য এটি সবচেয়ে প্রাণঘাতী যুদ্ধ। ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইলের হামলায় অন্তত ৬৪ হাজার ৯০৫ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আরও ১ লাখ ৬৪ হাজার ৯২৬ জন। ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনও অগণিত মরদেহ চাপা পড়ে আছে।