দখলদার ইসরাইলের হামলায় গাজায় মঙ্গলবার রাত থেকে গতকাল বুধবার সকাল পর্যন্ত আরও ৪৫ জন নিহত হয়েছেন। যাদের মধ্যে নারী ও শিশু রয়েছে। এরমধ্যে একটি শিশুর বয়স মাত্র এক সপ্তাহ।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দখলদারদের হামলায় এখন পর্যন্ত গাজায় ৫৩ হাজার ৫০০ জনের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। টাইমস অব ইসরাইল, আনাদুলো,বিবিসি।
দখলদার ইসরাইলের প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) জানিয়েছে, তাদের সেনারা গতকাল গাজায় ১১৫টি হামলা চালিয়েছে। তারা হামাসের লক্ষ্যবস্তুতে হামলা চালানোর দাবি করলেও; এসব হামলায় যারা নিহত হয়েছেন তাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু।
আন্তর্জাতিক চাপের মুখে গত সোমবার থেকে গাজায় খুবই সামান্য ত্রাণ প্রবেশ করতে দেয় দখলদাররা। যা কোনোভাবেই পর্যাপ্ত নয়।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ডক্টর উইথআদার্স বর্ডার’ জানিয়েছে, ইসরাইল যে ত্রাণ গাজায় ঢুকতে দিয়েছে সেগুলো পর্যাপ্তের কাছাকাছিও না। উল্টো এরমাধ্যমে প্রতারণা করছে ইসরাইলীরা। তারা বোঝাতে চাচ্ছে গাজায় তারা ত্রাণ সামগ্রী ঢুকতে দিচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে এটি আসলে ঘটছে না।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে দখলদারদের সঙ্গে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের যুদ্ধবিরতি হয়। কিন্তু ২ মার্চ এ যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন করে তারা গাজায় ব্যাপক বর্বরতা শুরু করে। সঙ্গে গাজায় সবধরনের মানবিক সহায়তা প্রবেশও আটকে দেয়। যা টানা আড়াই মাস ছিল। সোমবার থেকে ত্রাণের ট্রাক ঢুকলেও সেগুলো এখনো সাধারণ মানুষের হাতে পৌঁছায়নি। মূলত আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে দখলদাররা দেখাতে চাচ্ছে তারা গাজার মানুষকে অভুক্ত রাখছে না।
এর ফলে গাজায় বহু মানুষ দুর্ভিক্ষের মুখে পড়েছেন। সৃষ্টি হয়েছে মানবিক সংকট। এমন অবস্থায় গাজার বাসিন্দাদের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়েছেন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার। তিনি বলেছেন, আমরা গাজার মানুষকে অনাহারে থাকতে দিতে পারি না।
এমনকি গাজায় মানবিক বিপর্যয় এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যা সহ্য করা যায় না বলেও মন্তব্য করেছেন তিনি। গত মঙ্গলবার এক প্রতিবেদনে এই তথ্য জানিয়েছে বার্তাসংস্থা।
প্রধানমন্ত্রী স্টারমার বলেন, গাজায় নিরপরাধ শিশুদের ওপর চলমান বোমাবর্ষণ এবং মানবিক বিপর্যয় এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যা ‘সহ্য করা যায় না’। তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, “গাজার মানুষদের অনাহারে থাকতে দিতে পারি না।”
গত মঙ্গলবার ব্রিটিশ পার্লামেন্টে ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে ব্রিটেনের ‘পুনর্গঠন চুক্তি’ নিয়ে বক্তব্য রাখতে গিয়ে স্টারমার এসব কথা বলেন। তিনি বলেন, “গাজার ভয়াবহ পরিস্থিতি নিয়ে আমি কিছু বলতে চাই। নিরীহ শিশুদের ওপর বারবার বোমাবর্ষণ—এই দুর্ভোগ একেবারেই অসহনীয়।”
তিনি আরও বলেন, পশ্চিম তীরে বসতি স্থাপন বন্ধে যুক্তরাজ্যের অবস্থান আগের মতোই কঠোর রয়েছে। একইসঙ্গে গাজায় মানবিক সহায়তা অনেকগুণ বাড়ানোর দাবিও পুনর্ব্যক্ত করেন প্রধানমন্ত্রী কিয়ার স্টারমার।
ইসরাইলের সাম্প্রতিক ঘোষণায় বলা হয়, তারা কেবলমাত্র সীমিত পরিমাণ ত্রাণ গাজায় প্রবেশের অনুমতি দেবে। এই প্রসঙ্গে স্টারমার স্পষ্ট ভাষায় বলেন, “এই সহায়তার পরিমাণ সম্পূর্ণরূপে অপর্যাপ্ত-এটা মেনে নেওয়া যায় না।”
তিনি আরও বলেন, “আমরা গাজার মানুষদের অনাহারে থাকতে দিতে পারি না।”
ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর এই মন্তব্য এমন এক সময় এলো যখন আন্তর্জাতিক যুদ্ধবিরতির আহ্বান প্রত্যাখ্যান করে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে গাজায় ধ্বংসাত্মক সামরিক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইল।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পাশাপাশি জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থা বারবার গাজায় দুর্ভিক্ষের ঝুঁকি এবং চিকিৎসাসেবা ভেঙে পড়ার বিষয়ে সতর্ক করেছে।
বসতি স্থাপনকারীদের ওপর যুক্তরাজ্যের নিষেধাজ্ঞা
পশ্চিম তীরের কয়েকজন ইসরাইলী বসতি স্থাপনকারী (সেটেলার) এবং সংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে যুক্তরাজ্য।
গাজায় নতুন সামরিক অভিযান না বন্ধ না করায় ইসরাইলের সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বিষয়ক আলোচনা স্থগিত করেছে লন্ডন। প্রায় তিন মাস যাবৎ গাজায় ত্রাণ সরবরাহে অবরোধ আরোপ করে রেখেছে ইসরাইল। ফলে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে উপত্যকাটিতে। এ নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ বেড়েছে তেল আবিবের ওপর। এমনকি, দীর্ঘদিনের মিত্র যুক্তরাষ্ট্রও এই পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।
যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামি বলেন, গাজা এবং ইসরাইল অধিকৃত পশ্চিম তীরে ইসরাইল সরকার যে ভয়াবহ নীতি অনুসরণ করছে, তাতে তাদের সঙ্গে বিদ্যমান বাণিজ্য চুক্তি উন্নীত করার আলোচনা আমরা আর চালিয়ে যেতে পারি না।
তিনি আরও বলেন, ইতিহাস একদিন তাদের বিচার করবে। ত্রাণ আটকে রাখা, যুদ্ধ বিস্তৃত করা, বন্ধু ও মিত্রদের উদ্বেগ উপেক্ষা করা— এসব অমার্জনীয়। এই পরিস্থিতি বন্ধ করতেই হবে।
যুক্তরাজ্যে ইসরাইলী রাষ্ট্রদূত টিপি হোটোভেলিকে ফরেন অফিসে তলব করা হয়। সেখানে মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক মন্ত্রী হ্যামিশ ফ্যালকনার বলেন, গাজায় ১১ সপ্তাহ ধরে চলা অবরোধ ‘নিষ্ঠুর এবং অমার্জনীয়’।
অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রনীতি প্রধান কায়া কাল্লাস জানান, গাজায় চলমান যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ইসরাইলের সঙ্গে বাণিজ্য সম্পর্ক শাসনকারী ইউরোপীয় চুক্তি পুনর্মূল্যায়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।
ব্রাসেলসে এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি বলেন, সদস্য রাষ্ট্রগুলোর বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠতা মনে করছে, এই মানবিক সংকট অগ্রহণযোগ্য। তবে এই প্রক্রিয়ার সময়সীমা বা পদ্ধতি স্পষ্ট করেননি তিনি।
ল্যামি বলেন, যুক্তরাজ্য নতুন করে আরও তিন ব্যক্তি, দুটি অবৈধ বসতি এবং ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতায় লিপ্ত দুটি সংগঠনের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করছে।
তিনি বলেন, এই বসতিগুলো স্পষ্টভাবে ইসরাইল সরকারের সমর্থনে পশ্চিম তীরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে।
ল্যামির বক্তব্য হাউজ অব কমন্সে কেউ কেউ স্বাগত জানালেও অনেকে আরও কঠোর পদক্ষেপের দাবি জানান, যেমন- ইসরাইলের ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার আহ্বান।
কিছু সংসদ সদস্য চিৎকার করে ইসরাইলের কর্মকা-কে ‘গণহত্যা’ আখ্যায়িত করারও আহ্বান জানান। যদিও ল্যামি এটিকে ‘চরমপন্থা’ এবং ‘অমানবিকতা’ বলে উল্লেখ করেন।