ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় ইসরাইলী হামলায় একদিনে আরও ৭৭ ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪৭ জনই গাজা সিটির বাসিন্দা ছিলেন। এছাড়া নিহতদের মধ্যে ১১ ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন রুটি সংগ্রহের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, ইসরাইলের বোমাবর্ষণ ও জোরপূর্বক উচ্ছেদ অভিযানের মুখে গাজা নগরী ছেড়ে শত শত ফিলিস্তিনী পালাচ্ছেন। হাতে গোনা সামান্য মালপত্র ট্রাক, ভ্যান ও গাধার গাড়িতে তুলে তারা এলাকা ছাড়ছেন। আল জজিরা, রয়াটর্স, আনাদোলু।

নুসেইরাত শরণার্থী শিবিরের পশ্চিম দিকে দেইর আল-বালাহর কাছে বহু পরিবার খোলা আকাশের নিচে অস্থায়ী তাবু ফেলতে শুরু করেছে। এদের অধিকাংশকেই একাধিকবার ঘরবাড়ি ছেড়ে পালাতে হয়েছে। আগস্টের শুরু থেকে ইসরাইলী সেনারা হামলা জোরদার করেছে গাজা সিটতে। শহর দখল ও প্রায় ১০ লাখ মানুষকে বাস্তুচ্যুত করার লক্ষ্যেই এই অভিযান এমন আশঙ্কা জানিয়েছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনআরডব্লিউএ)। গত শুক্রবার ইসরাইল জানায়, তারা নগরী দখলের ‘প্রাথমিক ধাপ’ শুরু করেছে এবং এটিকে ‘যুদ্ধক্ষেত্র’ ঘোষণা করেছে।

গতকাল শনিবার হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, ওই দিন একদিনেই গোটা গাজায় ৭৭ জন ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। শুধু গাজা নগরীতেই নিহত ৪৭ জন। এর মধ্যে অন্তত ১১ জন নিহত হয়েছেন রুটি সংগ্রহের লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায়। অন্যদিকে ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় আবাসিক ভবনে হামলায় সাতজন নিহত হন। ধ্বংসস্তূপে উদ্ধারকাজ চালাতে দেখা গেছে স্বেচ্ছাসেবকদের। সাংবাদিক হানি মাহমুদ বলেন, ‘গাজা নগরীজুড়ে হামলা আরও বাড়ছে। ঘরবাড়ি, কমিউনিটি সেন্টার সবই ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের জীবনধারার ভিত্তি ভেঙে পড়ছে। এ সব ঘটছে যখন মানুষ দুর্ভিক্ষ, অনাহার আর পানিশূন্যতার মধ্যে রয়েছে। পুরো পরিস্থিতি মানবিক বিপর্যয়ে গড়াচ্ছে।’

গাজা সিটি থেকে নিরাপদ গণউচ্ছেদ অসম্ভব

রেড ক্রস প্রধান

রেড ক্রসের প্রেসিডেন্ট মিরজানা স্পোলিয়ারিচ সতর্ক করে বলেছেন, ইসরায়েলের তীব্র সামরিক অভিযানের মধ্যে গাজা সিটি থেকে জনগণকে নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া বর্তমান পরিস্থিতিতে একেবারেই অসম্ভব। প্রতিবেদনে বলা হয়, ইসরায়েল ধাপে ধাপে গাজা সিটির নিয়ন্ত্রণ নিয়ে পুরো গাজা উপত্যকার দখল নেওয়ার পরিকল্পনা এগিয়ে নিচ্ছে। প্রায় ২৩ মাস ধরে চলা যুদ্ধ এবং অবরুদ্ধ গাজায় চরম খাদ্যঘাটতি ও মানবিক সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক উদ্বেগের মধ্যেই এই পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। স্পোলিয়ারিচ এক বিবৃতিতে বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে গাজা সিটি থেকে নিরাপদ ও সম্মানজনকভাবে গণউচ্ছেদ সম্ভব নয়। এ ধরনের উচ্ছেদ ব্যাপক জনগোষ্ঠীর বাস্তুচ্যুতি ঘটাবে, যা গাজার অন্য কোনো এলাকা সামাল দেওয়ার মতো অবস্থায় নেই। ইতিমধ্যেই সেখানে খাদ্য, আশ্রয় ও চিকিৎসা সামগ্রীর মারাত্মক সংকট রয়েছে।”

ইসরায়েলি সেনাবাহিনী গত শুক্রবার জানিয়েছে, তারা “সন্ত্রাসী সংগঠনগুলোর বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান চালিয়ে যাওয়ার পাশাপাশি মানবিক সহায়তা কার্যক্রম সমর্থন করে যাবে, যাতে ইসরায়েলের নিরাপত্তা নিশ্চিত হয়।” ইসরায়েল গাজার নাগরিকদের দক্ষিণাঞ্চলে সরে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। তবে স্পোলিয়ারিচ বলেছেন, গাজা সিটির বহু মানুষ ক্ষুধার্ত, অসুস্থ বা আহত হওয়ায় তারা উচ্ছেদের নির্দেশ মানতে সক্ষম নয়। আন্তর্জাতিক মানবিক আইন অনুসারে ইসরায়েলকে উচ্ছেদের নির্দেশ দেওয়ার আগে বেসামরিকদের জন্য আশ্রয়, নিরাপত্তা ও খাদ্য নিশ্চিত করতে হবে। তিনি আরও বলেন, “বর্তমান পরিস্থিতিতে এসব শর্ত পূরণ করা সম্ভব নয়। তাই এ ধরনের গণউচ্ছেদ শুধু অবাস্তব নয়, বরং অগ্রহণযোগ্য।”

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলি বসতিতে চালানো হামলায় প্রায় ১,২০০ মানুষ নিহত হয় এবং প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করা হয়। গাজা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের হিসাব অনুযায়ী, ইসরায়েলের সামরিক অভিযানে এখন পর্যন্ত গাজায় ৬৩ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগই বেসামরিক।

ইয়েমেনের ভারপ্রাপ্ত

প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মেফতা

ইয়েমেনের ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হচ্ছেন মোহাহাম্মদ মেফতাহ। সাম্প্রতিক ইসরাইলী হামলায় ইয়েমেনি প্রধানমন্ত্রী আহমেদ গালেব আল-রাহাবির মৃত্যুপর পর দেশটির সুপ্রিম পলিটিক্যাল কাউন্সিলের প্রধান মোহাম্মদ মেফতাহকে ভারপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের একটি ডিক্রি জারি করেছেন। ইয়েমেনি আল-মাসিরাহ টিভি নেটওয়ার্কের মতে, ইয়েমেনের সুপ্রিম পলিটিক্যাল কাউন্সিলের প্রধান মাহদি আল-মাশাত এক ডিক্রিতে সানায় ইয়েমেনি সরকারের নিহত প্রধানমন্ত্রীর উত্তরসূরি হিসেবে একজনকে নিয়োগ করেছেন।

প্রথম উপ-প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ মোহাম্মদ মেফতাহকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিযুক্ত করা হয়েছে। ইয়েমেনের প্রেসিডেন্সি বৃহস্পতিবার সানায় ইসরাইলী সরকারের হামলায় প্রধানমন্ত্রী এবং তার সহযোগী বেশ কয়েকজন মন্ত্রীর শহীদ হওয়ার ঘোষণার পর এই খবর সামনে আসলো। এর আগে ইয়েমেনের হুথি বিদ্রোহীরা নিশ্চিত করেছে, রাজধানী সানায় ইসরাইলের বিমান হামলায় তাদের সরকারের প্রধানমন্ত্রী আহমেদ আল-রাহাওয়ি নিহত হয়েছেন। গত শনিবার এক বিবৃতিতে হুথিরা জানিয়েছে, বৃহস্পতিবার সানায় চালানো ওই হামলায় আল-রাহাওয়ির সঙ্গে আরও কয়েকজন মন্ত্রীও নিহত হয়েছেন। তারা এক কর্মশালায় অংশ নেওয়ার সময় লক্ষ্যবস্তু হন। হুথিদের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘ইসরাইলী আক্রমণে আমাদের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী নিহত হয়েছেন,’ তবে বিস্তারিত নাম প্রকাশ করা হয়নি।

গাজায় অনাহারে আরও

১০ ফিলিস্তিনীর মৃত্যু

ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় ইসরাইলী অবরোধের কারণে অপুষ্টিতে আরও ১০ জন ফিলিস্তিনী মারা গেছেন। তাদের মধ্যে তিনিটিই শিশু। এক বিবৃতিতে মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, অপুষ্টির কারণে নতুন ১০ জনের মৃত্যুর ফলে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে মৃতের সংখ্যা ৩৩২ জনে দাঁড়িয়েছে, যার মধ্যে ১২৪ জন শিশু। বৈশ্বিক ক্ষুধা পর্যবেক্ষণ সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) অনুসারে, গাজা উপত্যকার গাজা গভর্নরেটে দুর্ভিক্ষ নিশ্চিত করা হয়েছে এবং সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ দেইর আল-বালাহ এবং খান ইউনিস গভর্নরেটে তা বিস্তৃত হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। মন্ত্রণালয় আরও জানিয়েছে, আইপিসি গাজায় দুর্ভিক্ষ ঘোষণা করার পর থেকে ৫৪ জন অনাহারে মারা গেছেন, যার মধ্যে নয়জন শিশু। আইপিসি জানিয়েছে, ২২ মাসের অব্যাহত আগ্রাসনে গাজা উপত্যকার পাঁচ লাখেরও বেশি মানুষ অনাহার, দারিদ্র্য এবং মৃত্যুর মুখোমুখি হচ্ছে। আরও ১০ লাখেরও বেশি মানুষ,যা গাজার মোট জনসংখ্যার অর্ধেকেরও বেশি - তীব্র খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার জরুরি স্তরের মুখোমুখি হচ্ছে।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে চলা সামরিক অভিযানে গাজায় ৬৩ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনীকে হত্যা করেছে ইসরাইলী। প্রায় দুবছর ধরে চলা সামরিক অভিযানের ফলে ছিটমহলটি ধ্বংস হয়ে গেছে। এর আগে গত নভেম্বরে, আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত গাজায় যুদ্ধাপরাধ এবং মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ও তার সবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী ইয়োভ গ্যালান্তের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে। উপত্যকাটিতে যুদ্ধের জন্য ইসরাইল আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার মামলার মুখোমুখিও রয়েছে।

পশ্চিম তীরে ইসরাইলবিরোধী

চিকিৎসকের জমি দখল

পশ্চিম তীরের মাসাফের ইয়াত্তা এলাকায় ফিলিস্তিনী-আমেরিকান চিকিৎসক ডা. নিদাল জবুরের ৫০ একর জমি দখলে নিয়েছে ইসরাইলী বসতিস্থাপনকারীরা। গাজায় গণহত্যার বিরুদ্ধে স্বাস্থ্যকর্মীদের প্রতিবাদী জোট ডক্টারস অ্যাগেইনস্ট জেনোসাইড (ডিএজি)-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতাও তিনি। অস্কারজয়ী তথ্যচিত্র ‘নো আদার ল্যান্ড’-এও দেখানো হয়েছিল এই জমিটি। জবুর বলেছেন, ‘আমরা একেবারেই অসহায় হয়ে পড়েছি। তার পরিবার আইনজীবীদের সঙ্গে কথা বলছেন এবং যে কোনো সংস্থা থেকে সাহায্য চাইছেন। আমরা জানি, এভাবেই তো জোরপূর্বক উচ্ছেদ শুরু হয়।’

বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানে বসবাসরত জবুর আরও বলেছেন, তিনি ১৮ আগস্ট খবর পান যে তার পারিবারিক জমি বসতকারীরা দখল করেছে। প্রায় ৫০ একর জমিতে ৫০০টিরও বেশি জলপাই গাছ, বাদাম এবং আঙুরের গাছ রয়েছে। জবুরের পরিবার বর্তমানে ফিলিস্তিনেই বাস করছে। তার বাবা, মা, সাত ভাই ও তিন বোন রয়েছেন সেখানে। জবুর জানিয়েছেন, তাদের পরিবার খোঁজ নিয়েছে জমির বিষয়ে কোনো নতুন সামরিক আদেশ আছে কিনা, অথবা জমি কেউ ভুলক্রমে বিক্রি করেছে কিনা। কিন্তু তারা স্পষ্ট জবাব পেয়েছেন, কোনো সামরিক আদেশ নেই, এমনকি এটি বিক্রয়ও হয়নি। জমিটি এখনো তাদেরই।

তিনি বলেছেন, ‘দখলকারীরা একবার স্থাপনা বানিয়ে ফেললেই তারা দাবি করে এটা তাদের জমি। আর তখন আমাদের বেরিয়ে যাওয়া ছাড়া আর কোনো উপায় থাকবে না। তাই আমরা চেষ্টা করছি শুরুতেই প্রতিরোধ করতে। দুর্ভাগ্যবশত, আমরা অস্ত্র ছাড়াই লড়াই করছি। আর তাদের হাতে আছে সেনাবাহিনী ও অস্ত্র।’ জমি দখলের পর বসতকারীরা সেখানে ইসরাইলী পতাকা টাঙিয়ে দিয়েছে বলেও জানিয়েছেন জবুর।