বিবিসি : ফিলিস্তিনের ম্যান্ডেলাখ্যাত মারওয়ান বারগুতিকে ইসরাইলের কারাগারে নির্যাতন করা হচ্ছে। এমনকি তার ওপর কারারক্ষীরা হামলাও করেছে বলে বারগুতির পরিবার অভিযোগ করেছে। এ সময় তিনি কারাগারের মধ্যেই অচেতন হয়ে পড়েন। প্রাণঘাতী হামলার পরিকল্পনার অভিযোগ তুলে ৬৬ বছর বয়সী বারগুতিকে যাবজ্জীবন কারাদ- দেয় ইসরাইল। কারাগারে তাকে দীর্ঘদিন নির্যাতন করা হচ্ছে। বারগুতির মাথা ও বুকে আঘাত করা হয়েছে। তবে ইসরাইলের প্রিজন সার্ভিস এই অভিযোগ অস্বীকার করেছে বলে জানিয়েছে ।

বারগুতির ছেলে জানিয়েছেন, তারা মুক্তি পাওয়া পাঁচ পৃথক বন্দির কাছ থেকে বারগুতিকে নির্যাতনের কথা জানতে পেরেছেন। বারগুতিকে প্রহরীরা হাতকড়া পরিয়ে নির্যাতন করে। মেঝেতে ফেলে দিয়ে লাথি মেরে তাঁকে আহত করা হয়। তা ছাড়া কারাগারে তাঁকে পিটিয়ে নির্যাতন করা হয়। বারগুতির মাথা ও বুকে আঘাত করা হয়েছে। পাসহ শরীরের বিভিন্ন অংশ ফুলে গেছে। নির্যাতনে তিনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা অচেতন ছিলেন। তাঁর শরীর থেকে রক্তপাত হয়েছে।

১৯৫৯ সালে রামাল্লাহর কাছে কোবার গ্রামে জন্মগ্রহণকারী বারগুতি কিশোর বয়সে ফাতাহ আন্দোলনে যোগ দেন এবং দ্রুত যুব শাখার নেতা হয়ে ওঠেন। ২০০০ সালের গোড়ার দিকে তিনি দ্বিতীয় ইন্তিফাদার সবচেয়ে প্রভাবশালী নেতাদের একজন ছিলেন। বিশ্লেষকরা মনে করেন, বারগুতির প্রভাব ফাতাহ আন্দোলন ছাড়িয়ে সমগ্র ফিলিস্তিনি রাজনৈতিক পরিম-লে ব্যাপৃত। এ জন্য তাকে মুক্তি দিতে ভয় পায় ইসরাইল।

উত্তর গাজায় ইসরাইলি বাহিনীর গোলাবর্ষণ

আলজাজিরা জানায়, যুদ্ধবিরতি সত্ত্বেও ইসরাইলি সেনাবাহিনী এখনও উত্তর গাজার শুজাইয়ার পূর্বাঞ্চলে গোলাবর্ষণ করছে। গতকাল শুক্রবার ইসরাইলি হামলায় তিন ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ১০ অক্টোবর যুদ্ধবিরতি কার্যকর হওয়ার পর থেকে প্রায় দুই ডজন নিহত হয়েছেন। যুদ্ধবিরতির এক সপ্তাহ পরও ত্রাণ সংকটে গাজা জাতিসংঘ জানিয়েছে, দুই বছর ধরে ইসরাইলের হামলায় গাজার কৃষিজমির অনেক ক্ষতি হয়েছে। অনেক পরিবার আয়হীন হয়ে পড়েছে। যুদ্ধবিরতির পর যে খাদ্য সরবরাহ হচ্ছে, তাতে পরিবারগুলোর চাহিদার চেয়ে কম। ফলে গাজার বাসিন্দাদের মধ্যে খাদ্যাভাব ও হাহাকার রয়েই গেছে। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ জানায়, এক কেজি টমেটো এখন ১৫ ডলার খরচ করে কিনতে হচ্ছে বাসিন্দাদের।

গাজায় আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েনে কাজ করছে ফ্রান্স ও ব্রিটেন

রয়টার্স জানায়, যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সমন্বয় করে ফ্রান্স ও ব্রিটেন আগামী দিনে আন্তর্জাতিক বাহিনী মোতায়েনের প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছে। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে একটি প্রস্তাব তোলা হবে। ফ্রান্সের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র প্যাসকেল কনফাভ্রো এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, গাজায় এই ধরনের বাহিনী গড়তে জাতিসংঘে দেশগুলোর ম্যান্ডেট প্রয়োজন। আনাদুলো

ইসরাইলের যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘন, একই পরিবারের গাজায় ১১ জনকে হত্যা গাজায় ইসরাইলি বাহিনী একটি ফিলিস্তিনি পরিবারের ১১ জন সদস্যকে হত্যা করেছে। আট দিন আগে কার্যকর হওয়া ভঙ্গুর যুদ্ধবিরতির সবচেয়ে ভয়াবহ লঙ্ঘন এটি। খবর আল জাজিরার।

গাজার নাগরিক প্রতিরক্ষা বিভাগের মতে, শুক্রবার সন্ধ্যায় গাজা শহরের জেইতুন এলাকায় আবু শাবান পরিবারকে বহনকারী একটি বেসামরিক গাড়িতে হামলা হয়। ইসরাইলি বাহিনী ট্যাংক থেকে শেল ছুড়ে এ হামলা চালায়। বেসামরিক প্রতিরক্ষা মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল এক বিবৃতিতে বলেন, পরিবারটি যখন তাদের বাড়ি পরিদর্শনের জন্য পৌঁছানোর চেষ্টা করছিল, তখন ইসরাইলি সেনাবাহিনী গাড়িটিতে গুলি চালালে হতাহতের ঘটনা ঘটে। নিহতদের মধ্যে সাত শিশু এবং তিনজন নারী ছিলেন।

বাসাল বলেন, তাদের সতর্ক করা যেতে পারত অথবা ভিন্নভাবে মোকাবিলা করা যেত। যা ঘটেছে তা নিশ্চিত করে যে দখলদাররা এখনো রক্তপিপাসু এবং নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের বিরুদ্ধে অপরাধ করার ওপর জোর দেয়।

হামাস এ ঘটনাকে ‘গণহত্যা’ বলে অভিহিত করেছে। নিন্দা জানিয়ে বলেছে, পরিবারটিকে কোনো যুক্তি ছাড়াই লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে। গোষ্ঠীটি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং মধ্যস্থতাকারীদের কাছে যুদ্ধবিরতি চুক্তি মেনে চলার জন্য ইসরাইলকে চাপ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে। এদিকে ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গে ফোনালাপ করেছেন শান্তিতে নোবেল পুরস্কারজয়ী ভেনেজুয়েলার মারিয়া কোরিনা মাচাদো। আলাপকালে মাচাদো গাজা যুদ্ধে ইসরাইলি ভূমিকার প্রশংসা করেছেন। তিনি ফিলিস্তিনি যোদ্ধা দল হামাসকে ‘নিপীড়ক বাহিনী’ উল্লেখ করেন। এমনকি ইরানের শাসনকর্তাদের সমালোচনাতেও তিনি সরব হন। নেতানিয়াহুর কার্যালয় জানায়, গাজা যুদ্ধে নেতানিয়াহুর নেতৃত্ব ও ভূমিকার প্রশংসা করেন মাচাদো। গাজায় জিম্মি মুক্তি ঘটনায় তিনি অভিনন্দনও জানান।

ইসরাইলের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের

লাশ থেকে অঙ্গ চুরির অভিযোগ

টিআরটি ওয়ার্ল্ড : গাজা প্রশাসন ইসরাইলের বিরুদ্ধে নিহত ফিলিস্তিনিদের মরদেহ থেকে মানব অঙ্গ চুরির অভিযোগ এনেছে। এটিকে তারা 'ভয়াবহ যুদ্ধাপরাধ' আখ্যা দিয়েছে। গাজা প্রশাসন অবিলম্বে আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি গঠনের আহ্বান জানিয়েছে। গাজার সরকারি সংবাদমাধ্যম দফতরের পরিচালক ইসমাইল থাওয়াবতা গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, গত তিন দিনে ইসরাইলি বাহিনী আন্তর্জাতিক রেড ক্রস কমিটির মাধ্যমে ১২০টি মৃতদেহ হস্তান্তর করেছে। এসব দেহের অধিকাংশই ভয়াবহ অবস্থায় ছিল। অনেকের চোখ বাঁধা, হাত-পা বাঁধা, গলায় দড়ির দাগ এবং গুলির চিহ্ন স্পষ্টভাবে দেখা গেছে।

থাওয়াবতা দাবি করেন, অনেক দেহের চোখ, কর্নিয়া এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ অঙ্গ অনুপস্থিত ছিল। এতে নিশ্চিত হওয়া যায় যে দখলদার বাহিনী দেহগুলো ধরে রেখে মানব অঙ্গ চুরি করেছে। এটি এক বর্বর অপরাধ। তিনি আরও বলেন, আমরা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও মানবাধিকার সংস্থাগুলোর প্রতি আহ্বান জানাই, যেন অবিলম্বে একটি আন্তর্জাতিক তদন্ত কমিটি গঠন করে ইসরাইলকে এই অপরাধের জন্য জবাবদিহির মুখে আনা হয়। ইসরাইলি সামরিক বাহিনী এখনও এ অভিযোগের বিষয়ে কোনও মন্তব্য করেনি। তবে গাজার মানবাধিকার সংগঠনগুলোর দাবি, ইসরাইল দীর্ঘদিন ধরে নিহত ফিলিস্তিনিদের দেহ আটক রেখে তাদের ওপর চিকিৎসা ও পরীক্ষামূলক কাজ চালিয়ে আসছে। ফিলিস্তিনি ন্যাশনাল ক্যাম্পেইন ফর দ্য রিট্রিভাল অব মার্টিয়ার্স বডিজ-এর তথ্য অনুযায়ী, ইসরাইল বর্তমানে ৭৩৫ জন ফিলিস্তিনি বন্দির দেহ ধরে রেখেছে, যাদের মধ্যে ৬৭ জন শিশু।

ইসরাইলি দৈনিক হারেৎজ-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, দক্ষিণ ইসরাইলের নেগেভ মরুভূমির স্ডে তেইমান সামরিক ঘাঁটিতে গাজার প্রায় দেড় হাজার ফিলিস্তিনির মৃতদেহ সংরক্ষিত আছে। সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতির অংশ হিসেবে হামাস ২০ জন জীবিত ইসরাইলি জিম্মিকে মুক্তি দেয় এবং আরও ১০ জনের মরদেহ ফেরত দেয়। এর বিনিময়ে প্রায় ২ হাজার ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তি দিয়েছে ইসরাইল। এই সমঝোতা হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের মধ্যস্থতায়। তার প্রস্তাবিত ২০ দফা পরিকল্পনার ভিত্তিতে, যাতে গাজা পুনর্গঠন ও হামাসবিহীন নতুন প্রশাসনিক কাঠামো গঠনের বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত আছে।

২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইলের অব্যাহত হামলায় গাজায় এখন পর্যন্ত প্রায় ৬৮ হাজার ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের অধিকাংশই নারী ও শিশু। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞে অঞ্চলটি এখন প্রায় বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়েছে। গাজার প্রশাসনের অভিযোগ, নিহতদের অঙ্গচুরির ঘটনা যদি প্রমাণিত হয়, তবে এটি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের চরম লঙ্ঘন এবং যুদ্ধাপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে।