গাজার অনাহারী মানুষের ওপর হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরাইল। ফলে সেখানে মৃত্যুর মিছিল দীর্ঘ থেকে দীর্ঘ হচ্ছে। বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বাঁচার আকুতি জানিয়ে গাজাবাসী সাহায্যের আহ্বান জানাচ্ছেন। অনেক মাকে দেখা গেছে তার অনাহারী সন্তানদের সঙ্গে নিয়ে ইউটিউব শর্টস, ফেসবুক রিলে এসে আহাজারী করছেন। তার ওপর ইসরাইলী আগ্রাসনে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, মঙ্গলবার পর্যন্ত মোট ৬০,০৩৪ জন ফিলিস্তিনী প্রাণ হারিয়েছেন। মৃত্যুর এই মাইলফলক সামনে আসছে এমন এক সময়ে, যখন গাজার অভ্যন্তরে ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ, মানবিক অবরোধ এবং অব্যাহত বোমাবর্ষণের মধ্যে খাদ্য সহায়তার খোঁজে বের হওয়া অসহায় জনগণের ওপরও হামলা অব্যাহত রেখেছে ইসরাইলী বাহিনী। আল-জাজিরা, প্রেস টিভি।
গ্লোবাল হাঙ্গার পর্যবেক্ষণ সংস্থা আইপিসি জানিয়েছে, গাজার বেশির ভাগ এলাকায় খাদ্যগ্রহণের ক্ষেত্রে দুর্ভিক্ষের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে। গাজা সিটির অভ্যন্তরে তীব্র অপুষ্টির হার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছেছে। জুলাইয়ের প্রথমার্ধেই ২০,০০০-এরও বেশি শিশু অপুষ্টিজনিত কারণে চিকিৎসা গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে ৩০০০ শিশু মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। গাজার নাসের হাসপাতালের শিশু ও প্রসূতি বিভাগের প্রধান ডা. আহমেদ আল-ফাররা বলেন, শিশুরা আসছে হাড় আর চামড়ার অবয়বে ঢাকা শরীর নিয়ে। তাতে মাংস নেই, চর্বি নেই। শুধু খালি দেহ। এটা শুধু তীব্র অপুষ্টি নয়, এটা ধ্বংস। তিনি বলেন, অপুষ্টির কারণে শিশুর স্নায়ুবিক বিকাশ ব্যাহত হয়, ফলে ভবিষ্যতে লেখাপড়ার সমস্যা, বিষণœতা ও উদ্বেগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বাড়ে।
আন্তর্জাতিক সংস্থা ‘ডক্টরস উইদাউট বর্ডারস’-এর প্রতিনিধি ডাক্তার তানিয়া হাজ হাসান বলেন, খাদ্য এলেই সমস্যার সমাধান হয় না। অপুষ্টি দেহের প্রতিটি অঙ্গকে প্রভাবিত করে। তিনি ব্যাখ্যা করেন, অপুষ্টির ফলে অন্ত্রে কোষ মারা যায়। ফলে পুষ্টি শোষণে সমস্যা হয়। হৃদযন্ত্র দুর্বল হয়ে পড়ে এবং পুনরায় খাদ্য গ্রহণ শুরু করলেও হৃদপি- ব্যর্থ হয়। এতে শিশুর মৃত্যু হতে পারে। দখলদার ইসরাইলী বাহিনী গাজার বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের (জিএইচএফ) খাদ্য বিতরণ কেন্দ্রের আশপাশে সহায়তা নিতে যাওয়া মানুষের ওপর গুলী চালাচ্ছে বলে জানিয়েছেন আল-জাজিরার সাংবাদিক হিন্দ খৌদারি। একইদিনে গাজায় প্রথমবারের মতো আকাশপথে সাহায্য পাঠায় বৃটেন। এর মূল্য প্রায় পাঁচ লাখ পাউন্ড।
স্থানীয় সূত্রের বরাতে আল-জাজিরা জানায়, ইসরাইল দিয়ের আল-বালাহে ট্যাংক, ড্রোন ও ফাঁদ পাতা রোবট ব্যবহার করেছে, যা সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে সবচেয়ে রক্তাক্ত রাত বলে বর্ণনা করা হচ্ছে। এর মধ্যেই বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন ইসরাইলের এই যুদ্ধকে ‘গণহত্যা’ আখ্যা দিয়েছে এবং পূর্ব জেরুজালেমসহ দখলকৃত অঞ্চল থেকে ফিলিস্তিনী জনগণের সম্পূর্ণ মুক্তির আহ্বান জানিয়েছে।
গাজায় একদিনে ইসরাইলী
হামলায় নিহত ৮০॥ অনাহারে ১৪
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় ইসরাইলী হামলায় একদিনে কমপক্ষে আরও ৮০ ফিলিস্তিনী প্রাণ হারিয়েছেন। এছাড়া ইসরাইলী অবরোধের ফলে অনাহারে উপত্যকাটিতে আরও ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এদের মধ্যে দুজন শিশু। সংবাদমাধ্যমটি বলছে, গাজা উপত্যকায় ইসরাইলী হামলায় আরও ৮০ জন নিহত হয়েছেন। একইসঙ্গে ক্রমবর্ধমান দুর্ভিক্ষে আরও ১৪ ফিলিস্তিনীর মৃত্যু হয়েছে, যাদের মধ্যে দুটি শিশুও রয়েছে বলে সোমবার জানিয়েছে গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়।
২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইল গাজায় আগ্রাসন শুরুর পর অপুষ্টিজনিত কারণে এখন পর্যন্ত মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৪৭ জনে, যাদের মধ্যে ৮৮ জনই শিশু। সম্প্রতি গাজায় খাদ্য সংকট আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। চলতি বছরের মার্চ মাসে ইসরাইল উপত্যকাটিতে পুরোপুরি অবরোধ আরোপ করে, যা মে মাসে আংশিক তুলে নেওয়া হলেও এখনও সীমিত পরিমাণে ত্রাণ ঢুকছে। জাতিসংঘ ও ত্রাণ সংস্থাগুলোর সতর্কতা সত্ত্বেও প্রয়োজনীয় সাহায্য ঢুকতে পারছে না। জাতিসংঘের ফিলিস্তিনী শরণার্থীদের সহায়তাকারী সংস্থা ইউএনআরডব্লিউএ–এর প্রধান ফিলিপ ল্যাজারিনি জানান, গাজায় অবস্থানরত তার সহকর্মীরা মানুষজনকে এমন অবস্থায় দেখছেন যেন তারা ‘না বেঁচে আছে, না মরেছে – যেন চলমান লাশ’। জাতিসংঘের একটি সম্মেলনে তিনি বলেন, ‘শুধু ক্ষোভ বা নিন্দা জানানো যথেষ্ট নয়। অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি নিশ্চিত করতে হবে, দুর্ভিক্ষ রোধ করতে হবে এবং বন্দিদের মুক্ত করতে হবে। ‘ এদিকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প স্কটল্যান্ড সফরে সাংবাদিকদের বলেন, গাজায় প্রকৃত অর্থেই দুর্ভিক্ষ চলছে এবং ইসরাইল এ অবস্থার জন্য ‘বড় ধরনের দায় বহন করে’। এর আগের দিন ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বলেন, ‘গাজায় কোনো দুর্ভিক্ষ নেই’। তবে সোমবার এক্সে দেওয়া এক পোস্টে তিনিও স্বীকার করেন, গাজার পরিস্থিতি ‘কঠিন’ এবং মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে ইসরাইল কাজ করছে।
দুধের বদলে সন্তানকে পানি খাইয়ে
বাঁচানোর চেষ্টা করছেন গাজার মায়েরা
গাজার শরণার্থী তাঁবুতে বাস করা মায়েরা নিরুপায়। কীভাবে সন্তানকে খাবার দেবেন সেই চিন্তাতেই তারা হিমশিম। তারা শুধু সন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। এখানে রয়েছেন লিনা। তাঁর ছেলে ওমরের বয়স মাত্র নয় মাস। অপুষ্টিতে ভুগছে, সঙ্গে আছে হাঁপানির মতো শ্বাসকষ্ট। গত ছয় সপ্তাহে এক ফোঁটা দুধও জোটেনি ওমরের কপালে। লিনা বললেন, আমার সন্তানের জন্য কোনো দুধ নেই। কোনো খাবার নেই, কোনো বিকল্প নেই শুধু পানি। আমি শুধু পানি খাইয়ে যাচ্ছি।
তিনি আরও জানান, চার মাস ধরে ফর্মুলা মিল্ক পাইনি। এই প্রথম একটু পেলাম। ভাবতে পারেন, আপনার সন্তান দুধের জন্য কাঁদছে আর আপনি কিছুই দিতে পারছেন না? যদি কোনোভাবে বাজারে ফর্মুলা দুধ পাওয়া যায়, তাও হয় মেয়াদোত্তীর্ণ কিংবা এতটাই দামি যে সাধারণ মানুষ তা কিনতে পারে না। খান ইউনিসে বসবাসরত জুদ লড়ছেন তার যমজ সন্তান তাওফিক ও নায়াকে বড় করে তোলার লড়াইয়ে। তাদের বয়স মাত্র দশ মাস। কখনও মায়ের বুকের দুধ পান করেনি তারা। কারণ, জুড নিজেই এতটাই অপুষ্ট যে তার শরীরে দুধই তৈরি হয় না। জুদ এখন তাঁর শিশুদের খাওয়ান মসুর ডাল আর পানি মিশিয়ে। এই চিত্র এখন গাজার প্রতিটি মায়ের বাস্তবতা। নেই পরিষ্কার পানি, নেই ফর্মুলা দুধ, নেই নিরাপদ কোনো খাদ্য। শুধু প্রতিদিনের একটি সংগ্রামÍসন্তানকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম। প্রতিটি মা একটি মৌন প্রার্থনায় বুক বেঁধেছেনযেন আগামীকালও তাঁদের সন্তান জীবিত থাকে, যেন কোনোভাবে একটু সহায়তা আসে।
ইসরায়েলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয়ার দাবি ইউরোপের ৪০ আইনপ্রণেতার
সংগ্রাম ডেস্ক : ইউরোপীয় পার্লামেন্টের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ৪০ আইনপ্রণেতা ইসরায়েলের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গাজায় ক্রমবর্ধমান মানবিক সংকট এবং জাতিসংঘ-সমর্থিত সংস্থার তথ্যানুযায়ী দুর্ভিক্ষের আশঙ্কার প্রেক্ষিতে এই আহ্বান জানানো হয়েছে। সূত্র: প্রেস টিভি
এমইপিদের এই জোট এক যৌথ বিবৃতিতে ইসরায়েলের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের চলমান বাণিজ্য চুক্তি স্থগিতের দাবি জানিয়েছে। একইসঙ্গে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সরকারে থাকা ব্যক্তিদের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করারও আহ্বান জানানো হয়েছে।
বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “গণহত্যা সনদ এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন” করছে ইসরায়েল, যা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। এমইপিরা হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, বর্তমান নেতৃত্বের পদক্ষেপ ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এক দিন দোষী সাবস্ত্য হবেন।
এছাড়াও, বিবৃতিতে হামাস প্রতিরোধ আন্দোলনের প্রতি আহ্বান জানানো হয়েছে যেন তারা ইসরায়েলি বন্দিদের অবিলম্বে মুক্তি দেয়।
বিবৃতিতে আরও উল্লেখ করা হয়, “গাজায় চলমান বর্বরতা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রেক্ষিতে এখনই সিদ্ধান্তমূলক পদক্ষেপ না নিলে, তা মানবতার ওপর এক চিরন্তন কলঙ্ক হিসেবে ইতিহাসে লেখা থাকবে। এখন নৈতিক ভীরুতার সময় নয়— পদক্ষেপ নিতে হবে দ্রুত।”
এখন পর্যন্ত ইউরোপীয় ইউনিয়ন ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেনি। যদিও যুক্তরাজ্য ও নরওয়ে ইতোমধ্যে ইসরায়েলের দুই কট্টর ডানপন্থী মন্ত্রীÑনিরাপত্তা মন্ত্রী ইতামার বেন-গভির এবং অর্থমন্ত্রী বেজালেল স্মোটরিচের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে।