এএনআই: অশান্ত লাদাখ শান্ত করতে নরেন্দ্র মোদির বিজেপি সরকার পরিচিত পথেই হাঁটছে। বুধবারের গোলমালের জন্য সরকার যাঁকে ‘পালের গোদা’ ঠাউরেছে, ম্যাগসেসে পুরস্কারপ্রাপ্ত সেই শিক্ষাবিদ ও পরিবেশ আন্দোলনকর্মী সোনম ওয়াংচুকের সংস্থার বিরুদ্ধে বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এনে তাঁর লাইসেন্স বাতিল করেছে। তাঁর সংস্থার বিরুদ্ধে সিবিআই তদন্তও শুরু করেছে।
লাদাখের স্বার্থে বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে কয়েক বছর ধরে তিনি শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে আসছেন। এই প্রথম অশান্তি ছড়াল। পৃথক রাজ্য গঠন ও লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত করার দাবিতে আন্দোলনকারী জনতার সঙ্গে নিরাপত্তারক্ষীদের সংঘর্ষে বুধবার লেহতে চারজন নিহত হন, আহত হন ৮০ জন। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যেই জানিয়েছে, সোনমই জনতাকে সহিংস হতে উসকানি দিয়েছেন। যদিও এ যাবত তেমন আচরণের কোনো উদাহরণ নেই। লাদাখের মানুষের মতে, একদিকে সরকারি ঔদাসীন্য, অন্যদিকে অনশনরত ব্যক্তিদের মধ্যে দুজনের শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটায় জনতার একাংশ ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। বিজেপির একাংশ অবশ্য বলাবলি করেছে, সোনম পাকিস্তানের মদদ পাচ্ছেন। এ রটনার কারণ গত ফেব্রুয়ারিতে পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে আয়োজিত জলবায়ু সম্মেলন ‘ব্রিদ পাকিস্তান’–এ সোনমের যোগদান। পাকিস্তানি গণমাধ্যম ‘ডন’ ছিল সেই সম্মেলনের আয়োজক।
উগ্র হিন্দুত্ববাদীরা প্রচার করছেন, সেখান থেকে ফেরার পরই পৃথক রাজ্যের মর্যাদার দাবিতে নতুন আন্দোলন শুরু করেন সোনম ওয়াংচুক। এখন তাঁকে মদদ দিচ্ছে কংগ্রেসও। বিজেপি সরাসরি অভিযোগ করেছে, হিংসাত্মক ঘটনায় স্থানীয় কংগ্রেস নেতারাও যুক্ত।
লাদাখ বরাবর শান্ত সীমান্ত : জম্মু–কাশ্মীরের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হওয়া সত্ত্বেও লাদাখ কিন্তু বরাবর শান্তিতে দিনাতিপাত করেছে। ১৯৮৯ সালে বৌদ্ধ ও মুসলিমদের মধ্যে সামান্য কিছুদিনের ছোটখাটো সংঘর্ষ ছাড়া বিস্তীর্ণ এই অঞ্চল শান্তই থেকেছে। ৩৬ বছর আগের সেই সংঘর্ষ ছিল মুসলিমপ্রধান কাশ্মীরি আধিপত্য থেকে বৌদ্ধদের মুক্তিলাভের তাগিদে। যদিও তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ওই সময় বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের একাংশের প্রতিরোধের পাশাপাশি সরকার ও প্রশাসন হিংসা থামাতে উদ্যোগী হয়েছিল। তারপর থেকে লাদাখে অশান্তির আগুন একবারের জন্যও জ্বলেনি।
কাশ্মীর উপত্যকার অশান্ত হয়ে ওঠার শুরুও সেই ১৯৮৯ সালেই। উপত্যকা থেকে হিন্দু পণ্ডিতদের বিতাড়নের মধ্য দিয়ে শুরু হয়েছিল অশান্তি। সেই অশান্তি ক্রমে জম্মুতে ছড়িয়ে পড়ে। আশ্চর্যজনকভাবে তা কিন্তু লাদাখের শিয়া মুসলিম অথবা বৌদ্ধ অধ্যুষিত অঞ্চলে প্রভাব ফেলেনি। মুসলিম অধ্যুষিত কারগিল, দ্রাস, মাতাইন, কাঁকসার, বাতালিক, জানস্কার কিংবা বৌদ্ধপ্রধান লেহ থেকেছে নিস্তরঙ্গ দিঘির মতো। অভিযোগ আছে, লাদাখের শিয়াপ্রধান কারগিলকে অশান্ত করার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান জেনারেল পারভেজ মোশারফ ১৯৯৯ সালে। এবার লাদাখের বৌদ্ধদের দাবিকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন কারগিলের মুসলিমরাও। পৃথক রাজ্য ও সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত হওয়ার দাবিতে তারাও সরব। বৃহস্পতিবার গোটা কারগিলের জনজীবন স্তব্ধ ছিল। সারার্থ, লাদাখের মুসলিম ও বৌদ্ধরা দাবি আদায়ে একজোট।
রাজ্য ভাগ থেকে সলতে পাকানো শুরু: রাষ্ট্রীয় স্বয়ং সেবক সংঘের (আরএসএস) ‘এক দেশ, এক নিশান, এক বিধান’ নীতি রূপায়ণের তাগিদে ২০১৯ সালের ৫ আগস্ট নরেন্দ্র মোদি সরকার জম্মু–কাশ্মীরের বিশেষ মর্যাদা প্রত্যাহার করে নেয়। খারিজ করে দেওয়া হয় সংবিধানের ৩৭০ অনুচ্ছেদ। সেই সঙ্গে রাজ্য ভেঙে গড়া হয় দুটি কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। জম্মু–কাশ্মীর ও লাদাখ। জম্মু–কাশ্মীরের বিধানসভা জিইয়ে রেখে সরকার প্রতিশ্রুতি দেয়, পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে জম্মু–কাশ্মীরকে ফের পূর্ণাঙ্গ রাজ্য করে দেওয়া হবে। কিন্তু লাদাখ থাকবে কেন্দ্রশাসিত। সরকারের সেই সিদ্ধান্তকে লাদাখের জনগণ স্বাগতও জানিয়েছিল। জম্মু ও কাশ্মীরের আধিপত্যমুক্ত হয়ে তারা খুশি হয়েছিল।
এসব দাবিদাওয়া নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে আলোচনায় অংশ নিয়েছে লেহ অ্যাপেক্স বডি ও কারগিল ডেমোক্রেটিক অ্যালায়েন্স। সরকার এক উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন কমিটিও গড়েছে। আলোচনাও চলছে। যদিও ষষ্ঠ তফসিলভুক্ত করার বিষয়ে সরকার নিরুত্তর থেকেছে। সংবিধানের ২৪৪ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, কোনো নির্দিষ্ট অঞ্চলের জন্য স্বশাসিত প্রশাসনিক ব্যবস্থা বন্দোবস্ত করা যায়। লক্ষ্য সেই অঞ্চলের বৈশিষ্ট, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষা। আসাম, মেঘালয়, মিজোরাম ও ত্রিপুরার আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকায় এই ব্যবস্থা জারি আছে।
২০১৪ সালে বিজেপি প্রথমবারের মতো লাদাখ লোকসভা আসনে জয়ী হয়। ২০১৯ সালেও সেই ধারা অব্যাহত ছিল। রাজ্য ভাগের পরের বছরেই ঘটে যায় পূর্ব লাদাখের গালওয়ানে ভারত–চীন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ। সংঘর্ষের পর বিজেপি–দলীয় সংসদ সদস্য ভারতীয় জমি দখল করে নেওয়ার অভিযোগ এনেছিলেন চীনের বিরুদ্ধে। অথচ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্য ছিল, কেউ এক ইঞ্চি জমিও দখল করেনি। আলোচনা সত্ত্বেও দাবি না মেটায় লাদাখি মন যে কেন্দ্রের শাসক দলের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে, তার প্রমাণ পাওয়া যায় ২০২৪ সালে লোকসভা নির্বাচনে। বিজেপি ও কংগ্রেসকে হারিয়ে জয়ী হন ন্যাশনাল কনফারেন্স ছেড়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী মুহাম্মদ হানিফা। মানুষ যে ক্রমেই বিজেপির ওপর অসন্তুষ্ট, তার প্রমাণও পাওয়া যায় গত বুধবারের সহিংসতায়।
লেহতে বিজেপির দলীয় কার্যালয়ে আগুন দিয়েছেন বিক্ষোভকারীরা। আন্দোলনকারী জনতা গণমাধ্যমকে বলেছেন, তাঁরা বুঝেছেন, কেন্দ্রের বিজেপি সরকার তাঁদের স্বশাসন দিতে চায় না। কেন্দ্র লাদাখকে মুঠোবন্দি করে রাখতে চায়।
সোনম ওয়াংচুকই হয়ে উঠেছেন মধ্যমণি : ‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমায় আমির খান অভিনীত ‘র্যাঞ্চো’ চরিত্রটি তৈরি হয়েছিল সোনম ওয়াংচুকের আদলে। ওই সিনেমার পর লাদাখে তাঁর তৈরি স্কুলটিও পর্যটকদের কাছে দর্শনীয় হয়ে ওঠে। সমাজ ও শিক্ষা নিয়ে মশগুল থাকা ৫৯ বছরের এ মানুষটি ২০১৯ সাল থেকে লাদাখের ভঙ্গুর পরিবেশ রক্ষায় উদ্যোগী হয়ে ওঠেন।
লাদাখের প্রকৃতি, পরিবেশ, জনগণ, সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারের কাছে বিভিন্ন দাবিদাওয়া পেশ করতে থাকেন ওয়াংচুক। উন্নয়ন ও পর্যটনের নামে নির্বিচার প্রকৃতি নিধনের প্রতিবাদে অনশন আন্দোলনের মধ্য দিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। লাদাখের খনিজ সম্পদ শিল্পপতিদের হাতে তুলে দেওয়ার সরকারি উদ্যোগের বিরোধিতাও তিনি করতে থাকেন। এভাবে পরিচিত ও প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দল ও নেতাদের ছাপিয়ে একসময় সোনম ওয়াংচুকই হয়ে ওঠেন আপামর লাদাখি মানুষের প্রতিনিধি। দাবি আদায়ে দিল্লি অভিযানও তিনি করেছিলেন।
ষষ্ঠ তফসিলে অন্তর্ভুক্তিসহ অন্যান্য দাবিতে সরব সোনম ওয়াংচুক সম্প্রতি পৃথক রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবিও তুলেছিলেন। এসব দাবির সমর্থনে ১০ সেপ্টেম্বর থেকে তিনি নতুন করে অনশন শুরু করেন। এ যাবত শান্তিপূর্ণ আন্দোলন চালিয়ে আসা সোনমের সমর্থকেরা গত বুধবার কেন হিংসাত্মক হয়ে উঠলেন, কেন সংঘর্ষের রাস্তায় এগোলÍসেই রহস্য এখনো অনুদ্ঘাটিত রয়ে গেছে। সংঘর্ষ, রক্তক্ষয় ও মৃত্যুর পর তিনি অনশন প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। হিংসার নিন্দাও করেছেন; কিন্তু সরকারের চোখে তিনি হয়ে গেছেন যত নষ্টের গোড়া। সোনম ওয়াংচুকের ‘স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অব লাদাখ’–এর লাইসেন্স বাতিল করার মধ্য দিয়ে সরকার বুঝিয়ে দিচ্ছে, তাঁর অতিসক্রিয়তা ভালো চোখে দেখা হচ্ছে না।
লাদাখে সহিংসতার অভিযোগে সোনম ওয়াংচুককেই গ্রেফতার করল পুলিশ! : লাদাখে অশান্তি এবং প্রাণহানির ঘটনার তিন দিনের মাথায় ইঞ্জিনিয়ার, গবেষক ও সমাজকর্মী সোনম ওয়াংচুককে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তাঁর বিরুদ্ধে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে মামলাও করা হয়েছে। লাদাখ প্রশাসন বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। লাদাখ পুলিশের ডিজি এসডি সিংহ জামওয়ালের নেতৃত্বে পুলিশবাহিনী দুপুর আড়াইটায় ওয়াংচুককে তার লেহর বাড়ি থেকে গ্রেফতার করে। আগে বিদেশি অনুদান নিয়ন্ত্রণ আইন (ফরেন কনট্রিবিউশন রেগুলেশন অ্যাক্ট বা এফসিআরএ) লঙ্ঘনের অভিযোগে তার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেয় অমিত শাহর কেন্দ্রীয় মন্ত্রণালয়। সোনমের সংস্থা ‘স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অফ লাদাখ’ (এসইসিএমওএল)-এর এফসিআরএ লাইসেন্স বাতিল করা হয়েছিল।
এবার সরাসরি রাষ্ট্রীয় সুরক্ষার মতো স্পর্শকাতর অভিযোগ এনে গ্রেফতার করা হল তাকে। প্রসঙ্গত, লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্ভুক্ত করা এবং পূর্ণাঙ্গ রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে বুধবার লাদাখের রাজধানী লেহ শহরে বিক্ষোভে নেমেছিলেন কয়েক হাজার তরুণ-তরুণী। অভিযোগ, বিক্ষোভ চলাকালীনই লেহতে বিজেপির পার্টি অফিসে আগুন ধরিয়ে দেন বিক্ষোভকারীরা। শুধু তাই নয়, পার্টি অফিসের সামনে থাকা একটি পুলিশের গাড়িতে আগুন লাগানো হয়। তার পরই পরিস্থিতি ক্রমশ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সংঘর্ষে মোট পাঁচ জনের মৃত্যু হয়। ঘটনার জন্য সোনমের উস্কানি ‘অন্যতম কারণ’ বলে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গত বৃহস্পতিবার জানিয়েছিল। ঘটনাচক্রে, তার পরেই এই পদক্ষেপ করা হল।
‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমায় আমির খানের ‘র্যাঞ্চো’ চরিত্রটি বানানো হয়েছিল তাঁরই আদলে। সেই সোনমের সংস্থা এসইসিএমওএল এবং ‘হিমালয়ান ইনস্টিটিউট অফ অল্টারনেটিভস লাদাখ’ (এইচআইএএল) এবং ‘স্টুডেন্টস এডুকেশনাল অ্যান্ড কালচারাল মুভমেন্ট অফ লাদাখ’ (এসইসিএমওএল)-এর বিরুদ্ধে নিয়ম ভেঙে বিদেশি অনুদান নেওয়ার অভিযোগে চলতি মাসে সিবিআই তদন্তেরও নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্র। পিটিআই-এর প্রতিবেদককে বৃহস্পতিবার সোনম জানিয়েছিলেন, প্রায় ১০ দিন আগে সিবিআই-এর তদন্তকারী দল সরকারি নির্দেশনামা নিয়ে তার কাছে এসেছিল। প্রসঙ্গত, লাদাখকে সংবিধানের ষষ্ঠ তফসিলের অন্তর্গত করে পূর্ণাঙ্গ স্বশাসনের আওতায় আনা এবং পরবর্তী পর্যায়ে রাজ্যের মর্যাদা দেওয়ার দাবিতে গত ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ৩৫ দিনের জন্য অনশনে বসেছিলেন ওয়াংচুক-সহ ‘লেহ অ্যাপেক্স বডি’-র কয়েক জন সদস্য। ঘটনাপ্রবাহ বলছে, তার পরেই সিবিআই-এর নিশানা হয়েছিলেন তিনি।