আল-জাজিরা: কাবুলে গত বুধবার পাকিস্তান, চীন ও আফগানিস্তানের তালেবান সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা একসঙ্গে হাত মেলালেন। কূটনৈতিক সৌজন্যের হাসি থাকলেও বৈঠকের মূল লক্ষ্য ছিল দুই প্রতিবেশী পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে নতুন করে আস্থা গড়ে তোলা। এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এটি ছিল তিন মাসের মধ্যে দ্বিতীয় বৈঠক। মে মাসে বেইজিংয়ে প্রথম বৈঠক শেষে পাকিস্তান-আফগানিস্তান কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করার ঘোষণা এসেছিল। একই সঙ্গে আলোচনায় উঠেছিল চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডর (সিপিইসি) আফগানিস্তান পর্যন্ত সম্প্রসারণের প্রস্তাব।
বিশ্লেষকদের মতে, বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের (বিআরআই) অংশ সিপিইসি সম্প্রসারণের পরিকল্পনা চীনের কৌশলগত আগ্রহ প্রকাশ করলেও, একই সঙ্গে এটি নিরাপত্তা ঝুঁকি নিয়েও উদ্বেগের প্রতিফলন। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের টানাপোড়েন চীনের ওই অর্থনৈতিক প্রকল্পকে সরাসরি প্রভাবিত করতে পারে। এক জ্যেষ্ঠ পাকিস্তানি কূটনীতিক আল জাজিরাকে বলেছেন, চীনের কাছে শান্তিপূর্ণ প্রতিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। উন্নয়ন ও সংযোগ নিরাপত্তা ছাড়া সম্ভব নয়। তাই বেইজিং দুই দেশকে কাছাকাছি আনার চেষ্টা করছে। ২০১৫ সালে শুরু হওয়া ৬২ বিলিয়ন ডলারের সিপিইসি পাকিস্তানের অর্থনীতিকে বদলে দেওয়ার প্রকল্প হিসেবে আখ্যা পেয়েছিল। কিন্তু রাজনৈতিক অস্থিরতা, বিচ্ছিন্নতাবাদী হামলা ও চীনা নাগরিকদের লক্ষ্য করে একের পর এক আক্রমণে প্রকল্পটির গতি কমেছে। সরকারি হিসাব অনুযায়ী পাকিস্তানে বর্তমানে প্রায় ২০ হাজার চীনা নাগরিক বসবাস করছেন, যাদের নিরাপত্তা নিয়ে বেইজিং বারবার উদ্বেগ জানিয়েছে।
চীনের উদ্দেশ্য আফগানিস্তানকেও সিপিইসিতে যুক্ত করা। তবে ইন্ডিয়ানা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক স্টেলা হং ঝ্যাং মনে করেন, রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলেও চীনা রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো বিনিয়োগে কতটা আগ্রহী হবে তা অনিশ্চিত। পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের ঝুঁকিপূর্ণ পরিবেশ বিনিয়োগকারীদের দ্বিধায় রাখছে। পাকিস্তান দীর্ঘদিন তালেবানের প্রধান পৃষ্ঠপোষক হলেও এখন ইসলামাবাদ তাদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তুলছে। অন্যদিকে কাবুল পাকিস্তানের মানবাধিকার লঙ্ঘন ও আফগান শরণার্থী বহিষ্কারের সমালোচনা করছে। পাকিস্তানভিত্তিক নিরাপত্তা গবেষণা সংস্থা পিআইসিএসএস জানিয়েছে, ২০২৫ সালের প্রথম ছয় মাসে সন্ত্রাসী হামলা বেড়েছে ৫ শতাংশ। নিহতের সংখ্যা আগের বছরের তুলনায় ১২১ শতাংশ বেশি। কেবল এ সময়েই প্রাণ হারিয়েছেন ৭৩৭ জন, যাদের মধ্যে নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্য ও বেসামরিক নাগরিক রয়েছেন। অন্যদিকে চীন অভিযোগ করেছে, পূর্ব তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্ট (ইটিআইএম) আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করে তাদের বিরুদ্ধে হামলা চালাচ্ছে।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক মুহাম্মদ ফয়সালের মতে, চীনের মূল লক্ষ্য পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা জোরদার করা। এজন্যই তারা ইসলামাবাদ-কাবুলের বিরোধ কমাতে চাইছে। তিনি বলেন, তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) আফগান ভূখণ্ড থেকে হামলা চালাচ্ছে, আবার বালুচ বিচ্ছিন্নতাবাদীরাও আশ্রয় পাচ্ছে আফগানিস্তানে।
সিঙ্গাপুরের গবেষক আবদুল বাসিত বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের আফগানিস্তান ছাড়ার পর দক্ষিণ এশিয়ায় চীনই প্রধান ভূরাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠেছে। পাকিস্তান-আফগান বিরোধ মেটানো ছাড়া সিপিইসি পূর্ণ সম্ভাবনায় কাজে লাগবে না। তবে বেইজিং কতটা ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত, তা নিয়েই প্রশ্ন রয়েছে। কূটনীতিকদের অনেকে মনে করেন, চীন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা নিতে পারে বটে, তবে গ্যারান্টর হিসেবে দায়িত্ব নেবে কি না, তা এখনও অনিশ্চিত।