ইন্টারনেট: ওয়াকফ সংশোধনী আইন ২০২৫-এর বিরুদ্ধে আন্দোলনের ডাক দিয়ে সর্বভারতীয় মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমিন (এআইএমআইএম) প্রধান আসাদুদ্দিন ওয়াইসি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে উদ্দেশ করে বলেন, ‘তিনি বাবাসাহেব ভীমরাও আম্বেদকরের পায়ের ধুলোরও যোগ্য নন।’’ গত শনিবার হায়দরাবাদের দারুসসালাম-এ অনুষ্ঠিত এক জনসভায় ওয়াইসি ঘোষণা দেন, এই আইন বাতিল করতে কৃষক আন্দোলনের পথ অনুসরণ করে দীর্ঘ লড়াই চালানো হবে।

ওয়াইসি বলেন, ‘এই আইন কার্যকর হওয়ার পর মাত্র এক মাসেই উত্তর প্রদেশে ৫০০টি ওয়াকফ সম্পত্তিকে সরকারি সম্পত্তি ঘোষণা করা হয়েছে। এটি শুধুমাত্র সূচনা।’ তিনি স্মরণ করিয়ে দেন, এআইএমআইএম সুপ্রিম কোর্টের তিন তালাক ও বাবরি মসজিদ রায়কে সম্মান জানিয়েছে ঠিকই, তবে সেই রায়গুলোকে তারা 'অব্যর্থ' মনে করে না। ওয়াইসির ভাষায়, ‘আমরা সাংবিধানিক নৈতিকতায় বিশ্বাস করি বলেই আদালতের রায়কে সম্মান জানাই। কিন্তু আরএসএস সংবিধানকে মান্য করে না, কেবল তার নাম ব্যবহার করে।’ তিনি বিজেপির বিরুদ্ধে সরাসরি অভিযোগ এনে বলেন, ‘যারা ধর্মীয় যুদ্ধের হুমকি দিচ্ছে, তারাই আসলে সংবিধানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালাচ্ছে।’

কেন্দ্রীয় সরকারের একের পর এক পদক্ষেপে সংখ্যালঘুদের উদ্বেগ ওয়াইসি উল্লেখ করেন, ‘তিন তালাক, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ), বেআইনি কার্যকলাপ প্রতিরোধ আইন (ইউএপিএ)-এর প্রসার এবং এবার ইউনিফর্ম সিভিল কোড (ইউসিসি) সবই মুসলিম সম্প্রদায়ের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত শরিয়ত অ্যাপ্লিকেশন অ্যাক্টকে বাতিল করে ইউসিসি চাপিয়ে দেওয়া হচ্ছে, যা বাবাসাহেব আম্বেদকরের আদর্শের বিরোধী।’ ‘ভারতের সৌন্দর্য নরেন্দ্র মোদির মধ্যে নয়, বরং এই দেশের মন্দির, মসজিদ, দরগা এবং জনগণের ভ্রাতৃত্বে নিহিত। যারা এগুলিকে দুর্বল করছে, তারাই আসলে দেশকে দুর্বল করছে,’ বলেন ওয়াইসি।

দাউদি বোহরা সম্প্রদায়কে ‘জোর করে’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে আইনে ওয়াইসি বলেন, ‘সংসদের কমিটির বৈঠকে দাউদি বোহরা সম্প্রদায় স্পষ্টভাবে জানিয়েছিল তারা এই আইনের আওতায় আসতে চায় না এবং তারা সেকশন ২-তে সংশোধনের প্রস্তাবও দিয়েছিল। কিন্তু মোদি সরকার উল্টো পথে হেঁটেছে Í পুরো সম্প্রদায়কে অন্তর্ভুক্ত করেছে এবং কেবল কিছু ট্রাস্টকে ছাড় দিয়েছে।’ তিনি আরও দাবি করেন, ‘সংশোধিত সেকশন ২-এর কারণে মুকেশ আম্বানি এখন এই সম্প্রদায়ের সম্পত্তির মালিক হতে পারেন। সুপ্রিম কোর্ট সাময়িক স্বস্তি দিলেও ১৯৬৩ সালের লিমিটেশন অ্যাক্ট অনুযায়ী বহু ওয়াক্ফ সম্পত্তি হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।’

ওয়াইসি মুসলিম সমাজকে আহ্বান জানান শিয়া সম্প্রদায়ের বিভিন্ন উপশাখার প্রতি সন্দেহ না রেখে ঐক্যবদ্ধ হতে। অন্য ধর্মের মানুষদের কাছেও বোঝাতে বলেন যে হিন্দুদের জন্য যা এন্ডোউমেন্ট অ্যাক্টে আছে, শিখদের জন্য গুরদোয়ারা কমিটি যেমন কাজ করে, তেমনি নীতিমালাই ওয়াক্ফ সম্পত্তির জন্যও প্রযোজ্য হওয়া উচিত। তিনি বলেন, ‘যারা মোদি সরকারের পক্ষে দাঁড়িয়ে এই আইনকে সমর্থন করছে, তারা যেন মনে রাখে যে মৃত্যুর পর তাদের জিজ্ঞাসা করা হবে, তারা আল্লাহর অনুসারী ছিলেন, নাকি মোদির।’ তিনি বলেন, ‘আমরা সবাই এক দীর্ঘ সংগ্রামের মুখোমুখি। আত্মমর্যাদা ছাড়া আমরা মৃতদেহের চেয়েও অধম।’ তিনি ফিলিস্তিনীদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে চলা সংগ্রামের কথা উল্লেখ করে মুসলিম সমাজকে অনুপ্রেরণা নিতে বলেন।

আইনের বিরুদ্ধে লড়াই চলবে আইনি ও সামাজিক স্তরে মাওলানা রাহমানি: সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ডের চেয়ারম্যান মাওলানা খালিদ সাইফুল্লাহ রাহমানি। তিনি বলেন, ‘আইনগত লড়াই এখনও শেষ হয়নি, আমরা আশা করছি সুপ্রিম কোর্ট এই অন্ধকার আইন বাতিল করে দেবে।’ তিনি বলেন, ‘নতুন সংশোধিত আইনে বলা হয়েছে কেউ যদি ১২ বছর ধরে অবৈধভাবে ওয়াকফ সম্পত্তি দখলে রাখে, তাহলে সে তার মালিক হয়ে যাবে। অথচ দানকারীকে মুসলমান হতে হবে অন্তত পাঁচ বছর ধরে, যা পূর্বে ছিল না।’

‘এই অঞ্চলে সব ধর্মের মানুষ পারস্পরিক সৌহার্দ্য বজায় রেখেছে। হিন্দুরাও ওয়াক্ফের জন্য জমি দান করেছে, আর নিজামরা অন্যান্য সম্প্রদায়কে জমি দিয়েছেন। এই আইন তা বন্ধ করে দিচ্ছে,’ তিনি বলেন। তিনি মুসলিম সমাজকে ঐক্যবদ্ধভাবে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান, কারণ তার মতে, ‘ওয়াক্ফ রক্ষা করতে না পারলে শরিয়তও রক্ষা করা সম্ভব হবে না।’ তরুণ সমাজকে আহ্বান জানিয়ে বলেন, তারা যেন সোশ্যাল মিডিয়াকে ব্যবহার করে শান্তিপূর্ণ ও গঠনমূলক বিতর্কের মাধ্যমে বিভ্রান্তিকর প্রচারকে মোকাবিলা করে।

সর্বদলীয় উপস্থিতি, শান্তির আহ্বান : সভায় অন্ধ্রপ্রদেশের ওয়াইএসআরসিপি, তামিলনাড়ুর ডিএমকে-সহ বহু রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা এবং দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে পণ্ডিত ও বিশিষ্টজনেরা উপস্থিত ছিলেন। জনসমাগম এতটাই ছিল যে, ‘একটা বালির কণাও পড়লে মাটিতে পৌঁছাত না,’ মন্তব্য করেন আয়োজকেরা। ওয়াইসি ও মাওলানা রাহমানি উভয়েই শান্তি ও সম্প্রীতি বজায় রাখার আহ্বান জানান এবং বলেন, ‘এই আন্দোলনে অমুসলিমদেরও যুক্ত করতে হবে, যাতে বিজেপি সরকারকে এই বিতর্কিত আইন বাতিলে বাধ্য করা যায়।’ এদিকে ভারতের হায়দরাবাদে ওয়াকফ (সংশোধনী) আইনের প্রতিবাদে এক বিশাল জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়েছে। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল’ বোর্ড (এআইএমপিএলবি) এবং আসাদউদ্দিন ওওয়াইসির নেতৃত্বাধীন অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলেমিন (এআইএমআইএম)-এর ডাকে গত শনিবার রাতে ওই সমাবেশে হাজার হাজার মনুষ যোগ দেন। ‘সংবিধান বাঁচাও, ওয়াক্ফ বাঁচাও’ শীর্ষক এই জনসমাবেশে উপস্থিত ছিলেন ভারতীয় কংগ্রেস, ভারত রাষ্ট্র সমিতি, ওয়াইএসআর কংগ্রেস পার্টি এবং দ্রাবিড় মুনেত্র কড়গমসহ একাধিক রাজনৈতিক দলের সদস্যরা। এআইএমআইএমর সদর দপ্তর দারুসসালামে আয়োজিত সমাবেশ থেকে আগামী ৩০ এপ্রিল রাত ৯টায় ঘরে ঘরে আলো নিভিয়ে ‘বাত্তি গুল’ প্রতীকী প্রতিবাদ পালনের ঘোষণা দেওয়া হয়।

সমাবেশে এআইএমআইএম প্রধান ও হায়দরাবাদের সংসদ সদস্য আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বলেন, ‘আমরা মাথানত করবো না। যারা আমাদের মুছে দিতে চায়, আমরা তাদেরই মুছে দেবো। ‘ তিনি বলেন, সংসদে আমি যে আইন ছিঁড়ে ফেলেছিলাম, তা শুধু মুসলিমদের পক্ষেই নয়, বরং সব ধর্মের মানুষের হয়ে কাজটি করেছিলাম। এই ধরনের দমনমূলক আইনে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হবেন।

সমাবেশে এআইএমপিএলবির সভাপতি মৌলানা খালেদ সাইফুল্লাহ রহমানি বলেন, আমরা আদালতের ওপর আস্থা রাখি। আমরা বিশ্বাস করি, এই আইনের ওপর স্থগিতাদেশ আসবে। তিনি অভিযোগ করেন, এই আইন ওয়াক্ফ সম্পত্তি পুনরুদ্ধারকে প্রায় অসম্ভব করে তুলেছে। তার মতে, আইনটি কার্যকর হলে মুসলিমরা নিজেদের জমির ওপরও ‘ভিজিটর’ হয়ে পড়বে। ‘মক্কা মসজিদ থেকে যেকোনো মসজিদকেই ওয়াক্ফ নয় বলে ঘোষণা করা যেতে পারে। ভেতরে ঢুকে কেবল দর্শনার্থীর মতো দেখা যাবে। কত ভয়ংকর এই আইন!’