গুলী বাহিনী ফিলিস্তিনের গাজা সিটিতে হামলা জোরদার করেছে। তারা সেখানে জাতিসংঘের আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত স্কুলসহ অনেক ভবন গুঁড়িয়ে দিচ্ছে। গাজা সিটিতে গতকাল শনিবার গুলী বাহিনীর হামলায় কমপক্ষে ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে গতকাল পুরো গাজা উপত্যকায় নিহত মানুষের সংখ্যা ৬২-তে দাঁড়িয়েছে। ফিলিস্তিনী কর্তৃপক্ষের নিয়ন্ত্রণাধীন এলাকায় জরুরি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান প্যালেস্টিনিয়ান সিভিল ডিফেন্স বলেছে, অবিরাম বোমা হামলা ও অবরুদ্ধ পরিস্থিতির কারণে গাজা সিটির ছয় হাজারের বেশি মানুষ বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। সংস্থার মুখপাত্র মাহমুদ বাসাল বলেন, গাজা সিটির মানুষ এখন চলমান অবরোধ ও হামলার মধ্যে খুবই কঠিন পরিস্থিতিতে জীবনযাপন করছেন। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেছেন, গাজা সিটি দখলের জন্য গুলী বাহিনী ক্রমাগত শহরটিতে হামলা চালিয়ে যাচ্ছে। তারা উড়োজাহাজ থেকে লিফলেট ফেলে ক্ষুধার্ত ও আতঙ্কিত ফিলিস্তিনীদের সতর্ক করছে এবং জীবন রক্ষার জন্য শহর ছেড়ে পালানোর পরামর্শ দিচ্ছে। আল-জাজিরা এএফপি, বিবিসি।
গাজা সিটি থেকে সাংবাদিক হানি মাহমুদ বলেন, গুলী যুদ্ধবিমানগুলো ‘১০ থেকে ১৫ মিনিট অন্তর’ আবাসিক ভবনসহ সরকারি স্থাপনাগুলোতে বোমা হামলা চালাচ্ছে। অনেক সময় সাধারণ মানুষ নিরাপদ স্থানে সরে যাওয়ার মতো যথেষ্ট সময় পান না। হানি মাহমুদ আরও বলেন, হামলার গতি ও ধরন দেখে একটা জিনিস বোঝা যাচ্ছে, তা হলো গুলী সেনাবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে ওই সব এলাকায় চরম চাপ দিচ্ছে, যেখানে বহু বাস্তুচ্যুত পরিবারের বসবাস।
এখন এই উদ্বাস্তু মানুষেরা শহরের পশ্চিম অংশে ভিড় করছেন বলেও উল্লেখ করেন তিনি। তবে গুলী সেনাবাহিনীর বোমা হামলা চলার মধ্যেও গাজা সিটির অনেক বাসিন্দা এখনো সেখানে থাকছেন। কেউ কেউ আবার দক্ষিণের আল-মাওয়াসি শিবিরে যাওয়ার চেষ্টা করার পর আবার শহরে ফিরে আসছেন। আল-মাওয়াসি শিবিরকে ইসরায়েল প্রায়ই হামলার নিশানা করছে। গাজা সিটির দক্ষিণাঞ্চল থেকে আল–জাজিরার প্রতিবেদক হিন্দ খোদারি বলেন, পানিসহ প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়ার আশায় উত্তরের এলাকাগুলো থেকে অনেক পরিবার আল-মাওয়াসি শিবিরে আসছে। গুলী বাহিনীই এগুলো নিয়ে প্রচার চালাচ্ছে। কারণ, ফিলিস্তিনীদের দক্ষিণাঞ্চলের দিকে আকৃষ্ট করাটা ইসরায়েলের কৌশলের অংশ।
গাজা সিটিতে এখনো প্রায় ৯ লাখ মানুষের বসবাস। আল-শিফা হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক মুহাম্মদ আবু সালমিয়া বলেন, স্থানীয় বাসিন্দারা শহরের পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে সরছেন। খুব অল্পসংখ্যক মানুষই দক্ষিণে পৌঁছাতে পারছেন। যাঁরা দক্ষিণে পালাতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁদেরও অনেকে থাকার জন্য জায়গা পাচ্ছেন না। কারণ, আল-মাওয়াসি এলাকা মানুষে ভরে গেছে। দেইর আল বালাহ এলাকাতেও মানুষের অতিরিক্ত ভিড় জমেছে। তাই অনেক মানুষ সেখানে আশ্রয় বা মৌলিক পরিষেবা না পেয়ে আবার গাজা সিটিতে ফিরে আসছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া পোস্টে গুলী সেনাবাহিনী দাবি করেছে, ২ লাখ ৫০ হাজারের বেশি মানুষ গাজা উপত্যকার সবচেয়ে বড় শহরটি ছেড়ে গেছেন। গাজা সিটিতে এখনো প্রায় ৯ লাখ মানুষের বসবাস। আল-শিফা হাসপাতালের প্রধান চিকিৎসক মুহাম্মদ আবু সালমিয়া বলেন, স্থানীয় বাসিন্দারা শহরের পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে সরছেন। খুব অল্পসংখ্যক মানুষই দক্ষিণে পৌঁছাতে পারছেন। যাঁরা দক্ষিণে পালাতে সক্ষম হয়েছেন, তাঁদেরও অনেকে থাকার জন্য জায়গা পাচ্ছেন না। কারণ, আল-মাওয়াসি এলাকা মানুষে ভরে গেছে।
গাজা সিটির দক্ষিণাঞ্চল থেকে আল–জাজিরার প্রতিবেদক হিন্দ খোদারি বলেন, পানিসহ প্রয়োজনীয় জিনিস পাওয়ার আশায় উত্তরের এলাকাগুলো থেকে অনেক পরিবার আল-মাওয়াসি শিবিরে আসছে। গুলী বাহিনীই এগুলো নিয়ে প্রচার চালাচ্ছে। কারণ, ফিলিস্তিনীদের দক্ষিণাঞ্চলের দিকে আকৃষ্ট করাটা ইসরায়েলের কৌশলের অংশ। আল-মাওয়াসি এলাকায় ইসরায়েলÑসমর্থিত ত্রাণ সংস্থা জিএইচএফের তিনটি বিতরণকেন্দ্র রয়েছে। এসব বিতরণকেন্দ্রের কাছে অনেক মানুষ গুলীবিদ্ধ হয়ে নিহত হওয়ার পর মানবাধিকার সংস্থা এবং বিভিন্ন দেশের সরকার জিএইচএফের সমালোচনা করেছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, বিতরণকেন্দ্রের আশপাশে এখন পর্যন্ত ৮৫০ জনের বেশি মানুষ গুলীবিদ্ধ হয়েছে।
গাজা সিটিতে ইসরায়েল হামলা শুরু করার আগে থেকেই আল-মাওয়াসি শিবিরে মানুষের ভিড় ছিল। পূর্ব রাফা ও খান ইউনিস অঞ্চল থেকে বাস্তুচ্যুত ফিলিস্তিনীরা সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন। এখন পরিস্থিতি আরও চরমে পৌঁছেছে। নতুন আসা ব্যক্তিরা তাঁদের তাঁবু স্থাপনের জায়গা পাচ্ছেন না।
গাজায় অব্যাহত গুলী হামলায় নিহত আরও ৪৭
ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজায় অব্যাহত ইসরাইলী হামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৪৭ ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। এ নিয়ে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে ইসরাইলের গাজায় আগ্রাসন শুরুর পর এখন পর্যন্ত অন্তত ৬৪ হাজার ৮০৩ জন ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন। এছাড়া একদিনে আরও সাতজন অনাহারে মারা গেছেন। এক বিবৃতিতে ফিলিস্তিনী স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে। মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালগুলোতে ৪৭টি মৃতদেহ আনা হয়েছে এবং আহত হয়েছেন ২০৫ জন। এতে ইসরাইলী হামলায় মোট আহতের সংখ্যা দাঁড়াল ১ লাখ ৬৪ হাজার ২৬৪ জনে। বিবৃতিতে আরও বলা হয়, অনেক ভুক্তভোগী এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে এবং রাস্তায় পড়ে আছেন, কিন্তু উদ্ধারকর্মীরা সেখানে পৌঁছাতে পারছেন না। গত ২৪ ঘণ্টায় মানবিক সহায়তা পাওয়ার চেষ্টা করার সময় ইসরাইলী সেনাদের গুলীতে আরও পাঁচজন ফিলিস্তিনী নিহত হয়েছেন এবং ২৬ জনের বেশি আহত হয়েছেন। এতে মানবিক সহায়তা সংগ্রহের চেষ্টাকালে নিহত ফিলিস্তিনীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২ হাজার ৪৮৪ জনে, আর আহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ১১৭ জনে, যা ২৭ মে থেকে শুরু হওয়া বিতর্কিত গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশনের কার্যক্রম চলাকালীন ঘটেছে।
এছাড়া গত ২৪ ঘণ্টায় আরও সাতজন ফিলিস্তিনী অপুষ্টি ও অনাহারে মারা গেছেন, যাদের মধ্যে দুজন শিশু। এর মধ্য দিযে ২০২৩ সালের অক্টোবর থেকে অনাহার ও দুর্ভিক্ষ-সংক্রান্ত মোট মৃত্যুর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪২০ জনে, যাদের মধ্যে ১৪৫ জন শিশু। গত ২ মার্চ থেকে ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ গাজার সব সীমান্ত ক্রসিং সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দিয়েছে, যা ফিলিস্তিনীদের দুর্ভোগ আরও তীব্র করেছে। জাতিসংঘ-সমর্থিত ক্ষুধা পর্যবেক্ষক সংস্থা ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি) জানিয়েছে, আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে উত্তর গাজায় দুর্ভিক্ষ নিশ্চিত হয়েছে এবং সেপ্টেম্বরের শেষ নাগাদ তা দেইর আল-বালাহ ও খান ইউনুস পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
জিম্মিদের মুক্তির ক্ষেত্রে একমাত্র বাধা নেতানিয়াহু
গাজায় হামাসের হাতে জিম্মি ইসরাইলী বন্দিদের মুক্তির ক্ষেত্রে একমাত্র বাধা দেশটির প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু— এমনটাই অভিযোগ করেছে জিম্মিদের পরিবারগুলো। ইসরাইলী জিম্মিদের জন্য গঠিত একটি ফোরাম সোশ্যাল মিডিয়ায় লিখেছে, ‘ইসরাইলের গত সপ্তাহের কাতার আক্রমণ থেকে বোঝা যায় যে, প্রতিবার শান্তি চুক্তি আসার পথে, নেতানিয়াহু তা ধ্বংস করে দেন। ‘গত সপ্তাহে, ইসরাইল কাতারের রাজধানী দোহায় হামাসের সিনিয়র নেতাদের লক্ষ্য করে বিমান হামলা চালায়, যার ফলে হামাসের পাঁচ সদস্য ও একজন কাতারি নিরাপত্তা কর্মকর্তা নিহত হয়।
গত শনিবার নেতানিয়াহু বলেছেন, কাতারে হামাস নেতাদের ধ্বংস করলে ‘বন্দিদের মুক্তি এবং যুদ্ধে সমাপ্তি আনার প্রধান বাধা দূর হবে।’ এমন পরিস্থিতির মধ্যে মার্কো রুবিও গত শনিবার ইসরাইল সফর করেছেন এবং নেতানিয়াহুর সঙ্গে দেখা করার কথা রয়েছে। তবে বন্দিদের পরিবারগুলো ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়াকে ‘প্রিয়জনদের বাড়ি ফিরাতে ব্যর্থ হওয়ার সর্বশেষ অজুহাত’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
ফিলিস্তিনের পক্ষে জাতিসংঘে ভোট দিল ভারত
স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে অধিকাংশ সদস্যদেশ। এই প্রস্তাবকে ‘নিউইয়র্ক ঘোষণা’ বলা হচ্ছে। প্রস্তাবে ফিলিস্তিন-ইসরাইল দ্বিরাষ্ট্রীয় সমাধানের প্রচেষ্টায় তৎপরতা আনার কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হলে, সেখানে হামাসের কোনো সংশ্লিষ্টতা থাকবে না। যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক শহরে জাতিসংঘের সদর দপ্তরে এ ভোটাভুটি হয়। প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিয়েছে সাধারণ পরিষদের ১৪২টি দেশ। বিপক্ষে ভোট দিয়েছে মাত্র ১০টি দেশ। তাদের মধ্যে ইসরাইলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র রয়েছে। ভোটদানে বিরত ছিল ১২টি দেশ। সাধারণ পরিষদে প্রস্তাবটি উত্থাপন করেছিল ফ্রান্স ও সৌদি আরব। ‘ফিলিস্তিনের প্রশ্নের শান্তিপূর্ণ নিষ্পত্তি এবং দ্বি-রাষ্ট্র সমাধান বাস্তবায়নের বিষয়ে নিউ ইয়র্ক ঘোষণার অনুমোদন’- এই শিরোনামে এই প্রস্তাবটি উত্থাপন করা হয়। এতে সমর্থনকারী ১৪২টি দেশের মধ্যে ভারতও ছিল। এতে উপসাগরীয় আরব দেশও এটিকে সমর্থন করেছে। তবে প্রস্তাবে আমেরিকা ও ইসরাইল তীব্র বিরোধিতা করেছে। তাদের মতে, এ প্রস্তাব একপাক্ষিক এবং এটি শান্তি আলোচনার পথে বাধা সৃষ্টি করবে। ইসরাইলী রাষ্ট্রদূত এটিকে ‘বাস্তববতা বিবর্জিত’ বলে আখ্যা দিয়েছেন।
প্রস্তাবের বিপক্ষে ভোট দেওয়া অন্যান্য দেশগুলো হলোÑ আর্জেন্টিনা, হাঙ্গেরি, মাইক্রোনেশিয়া, নাউরু, পালাউ, পাপুয়া নিউ গিনি, প্যারাগুয়ে এবং টোঙ্গা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামলা চালায় হামাস। তারই পরিপ্রেক্ষিতে সেদিন থেকে গাজায় নৃশংস হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরাইলী বাহিনী। ৭ অক্টোবর হামাসের হামলার নিন্দা না জানানোর জন্য জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাকে নিয়ে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে আসছে ইসরাইল। তবে উত্থাপন করা প্রস্তাবে স্পষ্টভাবে হামাসের নিন্দা জানানো হয় এবং অস্ত্রসমর্পণ করতে বলা হয়। এই ভোটাভুটি এমন সময় অনুষ্ঠিত হলো যখন চলতি মাসের ২২ তারিখে রিয়াদ ও প্যারিসের সভাপতিত্বে সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বসতে যাচ্ছে। সেখানে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রো ফিলিস্তিনের স্বীকৃতি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বর্তমানে সাধারণ পরিষদের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৪৯টি দেশই ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দেয়।