আল জাজিরা ও বিবিসি রয়টার্স : ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্পের নির্দেশে চালানো বিমান হামলার পর যুক্তরাষ্ট্রের ডেমোক্রেট আইনপ্রণেতারা তীব্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। তারা এই পদক্ষেপকে ‘কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়া যুদ্ধ শুরু করার গুরুতর সংবিধান লঙ্ঘন’ বলে অভিহিত করছেন এবং প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে ইমপিচমেন্ট দাবি তুলছেন। নিউ ইয়র্কের কংগ্রেসওম্যান আলেক্সান্দ্রিয়া ওকাসিও-কর্তেজ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বলেন, এই পদক্ষেপ মার্কিন সংবিধান এবং কংগ্রেসের যুদ্ধক্ষমতা আইনের গুরুতর লঙ্ঘন। এটি ইমপিচমেন্টের স্পষ্ট ও নির্ভুল ভিত্তি। তিনি আরও বলেন, ট্রাম্প একপেশে, অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়ে একটি যুদ্ধ শুরু করার ঝুঁকি নিয়েছেন। যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে আটকে দিতে পারে।

মিশিগানের কংগ্রেসওম্যান রাশিদা তালিব বলেন, মধ্যপ্রাচ্যে ‘নিরস্ত্র ধ্বংসাত্মক অস্ত্রের মিথ্যা’ অপবাদ দিয়ে আমরা যে অন্তহীন যুদ্ধ পেয়েছি, তার পরিণতি দেখেছি। আমরা এবার সেই ফাঁদে পা দেব না। তিনি কংগ্রেসকে ‘তাৎক্ষণিক হস্তক্ষেপের’ আহ্বান জানিয়েছেন। ম্যাসাচুসেটসের কংগ্রেসম্যান জিম ম্যাকগভার্ন পরিস্থিতিকে সরাসরি ‘পাগলামি’ বলে আখ্যায়িত করেছেন। তিনি বলেন, ট্রাম্প কংগ্রেসের অনুমতি ছাড়াই ইরানকে বোমা মেরেছেন। আমাদেরকে অবৈধভাবে আরেকটি মধ্যপ্রাচ্য যুদ্ধের মধ্যে জড়িয়ে ফেলেছেন। আমরা কি কিছুই শিখিনি? এই ঘটনার পর রিপাবলিকানদের একাংশ ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে ‘সাহসী পদক্ষেপ’ বলে প্রশংসা করলেও, ডেমোক্রেটদের মধ্যে প্রায় সর্বসম্মতিক্রমে এটিকে সংবিধান লঙ্ঘন, যুদ্ধ ক্ষমতা আইনের অগ্রাহ্য এবং স্বৈরতান্ত্রিক সিদ্ধান্ত বলে নিন্দা জানানো হচ্ছে। এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন কংগ্রেস কি প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণে ওয়ার পাওয়ার্স অ্যাক্ট প্রয়োগ করবে? ট্রাম্পের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক ইমপিচমেন্ট প্রস্তাব আনা হবে কি? সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো যুক্তরাষ্ট্র কি এখন একটি যুদ্ধের ভেতরে ঢুকে পড়েছে, কংগ্রেসের ইচ্ছার বিরুদ্ধে? আমেরিকার ডেমোক্র্যাট বলেন আর রিপাবলিকান বলেন সবগুলোই যুদ্ধবাজ দাঙ্গাবাজ। পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে এই দু দলের বাহিরে আমেরিকানদের উচিত অন্য কোনো দল বেছে নেয়া।

ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ঘটনাকে সংবিধানের চরম লঙ্ঘন বলেছেন মার্কিন সিনেটর বার্নি স্যান্ডার্স। বার্নি স্যান্ডার্স বলেন, ‘আমি একমত। আমি আপনাদের একটা কথা বলতে চাই, এই মাত্র যে খবরটা শুনলাম, যেটা আপনারাও শুনলেন, সেটা শুধু উদ্বেগজনকই নয়; বরং চরমভাবে সংবিধানবিরোধী।’ স্যান্ডার্স আরও বলেন, ‘আপনারা সবাই জানেন, এ দেশকে যুদ্ধের দিকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কেবল মার্কিন কংগ্রেসের আছে। প্রেসিডেন্টের সেই অধিকার নেই।’ গত শনিবার দিবাগত রাতে ইরানের তিনটি পারমাণবিক স্থাপনায় হামলা চালায় মার্কিন বোমারু বিমান। বার্নি স্যান্ডার্সসহ কয়েক নেতা ট্রাম্পের ইরানে হামলার সিদ্ধান্তের নিন্দা জানালেও এখন পর্যন্ত ডেমোক্রেটিক পার্টির শীর্ষ নেতারা এ বিষয়ে কোনো বিবৃতি দেননি।

যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ প্রতিনিধি পরিষদে ডেমোক্রেটিক ককাসের নেতা হাকিম জেফরিজ এবং সিনেটের নেতা সিনেটর চাক শুমারদুজনই এখনো কোনো বিবৃতি দেননি। দুজনই ইসরায়েলের সরব সমর্থক এবং ইরানের বিষয়ে কঠোর ও আগ্রাসী অবস্থান নিয়েছেন। গত শুক্রবার এক বিবৃতিতে জেফরিজ বলেছিলেন, ইরানকে কখনোই পারমাণবিক সক্ষমতা অর্জনের সুযোগ দেওয়া যাবে না এবং ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকার রয়েছে। তবে সেদিন তিনি এটাও বলেছেন, কেবল মার্কিন কংগ্রেসেরই যুদ্ধ ঘোষণার অধিকার আছে। সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে, ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থকদের মধ্যে ৬৫ শতাংশই ইরানের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের জড়িত হওয়ার বিরোধিতা করছে, আর মাত্র ১৫ শতাংশ এতে সমর্থন দিয়েছে।

ডেমোক্র্যাটরা মুখ বন্ধ রাখলেও নিজেদের প্রেসিডেন্টের পক্ষে কথা বলতে শুরু করেছেন রিপাবলিকান পার্টির নেতারা। মার্কিন সিনেটের সংখ্যাগরিষ্ঠের নেতা জন থুন বলেছেন, ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় বোমা হামলার সিদ্ধান্তে তিনি ট্রাম্পের পাশে আছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে এক পোস্টে থুন লেখেন, ইরানের শাসকেরা, যাঁরা যুক্তরাষ্ট্রের মৃত্যু কামনা ও ইসরায়েলকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার প্রতিজ্ঞা করেছেন, তাঁরা শান্তি প্রতিষ্ঠার সব ধরনের কূটনৈতিক পথ বাতিল করেছেন। হাউস স্পিকার ও রিপাবলিকান নেতা মাইক জনসন বলেছেন, ট্রাম্পের ইরানের ওপর অপ্রত্যাশিত হামলা তাঁর ‘আমেরিকা প্রথম’ বৈদেশিক নীতির প্রতি প্রতিশ্রুতি প্রকাশ করে।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক পোস্টে তিনি আরও লেখেন, ‘ইরানে সামরিক অভিযান আমাদের শত্রু ও মিত্র উভয়ের কাছেই স্পষ্ট বার্তা হওয়া উচিত যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প যা বলেন তা করেন।’ দক্ষিণ ক্যারোলাইনার সিনেটর লিন্ডসে গ্রাহাম প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পকে অভিনন্দন জানিয়ে বলেন, তিনি (ট্রাম্প) সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ইরানের শাসনব্যবস্থার এটাই প্রাপ্য।

রিপাবলিকান সিনেটর রজার উইকার প্রেসিডেন্টের প্রশংসা করে বলেন, ইরানের কারণে অস্তিত্বের ওপর যে হুমকির সৃষ্টি হয়েছে, তা নির্মূলে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প একটি সচেতন ও সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। তবে কয়েকজন রিপাবলিকান নেতা ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের সমালোচনাও করেছেন। কেনটাকির রিপাবলিকান সিনেটর থমাস ম্যাসি বলেছেন, ‘এটি সংবিধানসম্মত নয়।’ ক্যালিফোর্নিয়ার ডেমোক্রেটিক প্রতিনিধিদের একজন সারা জ্যাকবস বলেন, ‘এ হামলা একধরনের উত্তেজনা বৃদ্ধি, যা যুক্তরাষ্ট্রকে আরেকটি অন্তহীন ও প্রাণঘাতী যুদ্ধে প্রবেশ করাতে পারে।’ ফিলিস্তিন বংশোদ্ভূত মার্কিন কংগ্রেসের সদস্য রাশিদা তালিব বলেন, ‘আইনপ্রণেতাদের অনুমোদন ছাড়াই ট্রাম্পের ইরানের ওপর হামলার নির্দেশ দেওয়া মার্কিন সংবিধানের চরম লঙ্ঘন।