গাজা দখলের সিদ্ধান্তকে আঞ্চলিক উত্তেজনা বৃদ্ধির ঝুঁকিপূর্ণ পদক্ষেপ বলে সমালোচনা করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস। এর বাস্তবায়ন হলে ফিলিস্তিনীদের উচ্ছেদের সংখ্যা আরও বৃদ্ধি পাবে। গত শুক্রবার প্রকাশিত এক বিবৃতি গুতেরেসের মুখপাত্র এসব কথা বলেন। ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, এই সিদ্ধান্ত একটি বিপজ্জনক উত্তেজনা সৃষ্টি করতে যাচ্ছে। এতে ইতোমধ্যে গুরুতর পরিস্থিতিতে থাকা ফিলিস্তিনিদের পরিণতি আরও মারাত্মক পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে। এর ফলে, বাকি জিম্মিসহ অনেক মানুষের প্রাণের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেতে পারে। রয়টার্স, আল-জাজিরা, মিডল ইস্ট আই, এএফপি, শাফাক নিউজ।
বিবৃতিতে আরও বলা হয়, এই সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে জোরপূর্বক উচ্ছেদ, হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা আরও বৃদ্ধি পাবে। এতে ফিলিস্তিনিদের ভোগান্তির পরিমাণ কয়েকগুণ বেড়ে যাবে। গাজা যুদ্ধের প্রায় দুবছর হওয়ার সময় এসে নতুন এক সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যাপক সমালোচনার সৃষ্টি করেছে ইসরায়েল। গাজা উপত্যকার গাজা সিটির পুরো দখল নেওয়ার জন্য সামরিক অভিযানের আওতা বৃদ্ধির পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা। এই সিদ্ধান্ত আনুষ্ঠানিকভাবে অনুমোদিত হওয়ার আগে বৃহস্পতিবার ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর কাছে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ফক্স নিউজের বিল হ্যামারের প্রশ্ন ছিল, তারা পুরো উপত্যকার দখল নিতে চান কিনা। জবাবে তাদের সে রকম ইচ্ছা থাকার কথা জানিয়েছেন নেতানিয়াহু। তবে দখল নিলেও তা শাসনের পরিকল্পনা নেই দাবি করে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বলেন, দিন শেষে গাজার শাসন আরবের হাতে তুলে দিতেই তারা আগ্রহী।
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি সামরিক অভিযানে ইতোমধ্যে ৬১ হাজারেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। প্রায় দুবছর ধরে চলমান আগ্রাসনে গাজার প্রায় পুরো জনপদ উদ্বাস্তুতে পরিণত হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে তীব্র খাদ্যসংকট। ইসরায়েলের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক বিচার আদালতে গণহত্যার অভিযোগ এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে মামলা দায়ের হলেও এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছে তেল আবিব। ২০২৩ সালের অক্টোবরে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠী হামাসের হামলায় ইসরায়েলে এক হাজার ২০০ জন নিহত এবং প্রায় ২৫০ জনকে জিম্মি করা হয়েছিল বলে ইসরায়েলি পরিসংখ্যানে দাবি করা হয়। ওই হামলার পর থেকেই কয়েক দশকের পুরোনো ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের সর্বশেষ রক্তক্ষয়ী অধ্যায় শুরু হয়।
গাজা দখলের পরিকল্পনায় যুক্তরাজ্যসহ ৫ দেশের নিন্দা: অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি, ইতালি, নিউজিল্যান্ড ও যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা গাজা দখলের ইসরাইলি পরিকল্পনাকে দৃঢ়ভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। শুক্রবার এক যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেন, এই পদক্ষেপ গাজায় ভয়াবহ মানবিক পরিস্থিতিকে আরও অবনতি ঘটাবে, জিম্মিদের জীবন ঝুঁকির মুখে ফেলবে এবং সাধারণ মানুষের ব্যাপক বাস্তুচ্যুতির আশঙ্কা বাড়াবে। বিবৃতিতে আরও সতর্ক করে বলা হয়, এই পরিকল্পনা আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘনের ঝুঁকি তৈরি করছে। পাঁচ দেশের শীর্ষ কূটনীতিকরা বলেন, যেকোনো ধরনের সংযুক্তি (অ্যানেক্সেশন) বা বসতি সম্প্রসারণ আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী। তারা হামাসের প্রতি সব বন্দিকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়ার আহ্বান জানান এবং ইসরাইলের প্রতি জরুরি মানবিক সহায়তা প্রয়োজনীয়দের কাছে পৌঁছানোর কার্যকর সমাধান খুঁজে বের করার অনুরোধ করেন। ইসরাইল ঘোষণা করেছে, তারা গাজা সিটির নিয়ন্ত্রণ নেবে, ভিন্ন প্রশাসন বসাবে এবং হামাসকে নির্মূলের চেষ্টা চালাবে।
বর্তমানে ইসরাইলি সেনারা গাজার প্রায় ৮০ শতাংশ এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রায় ২০ লাখ অধিবাসী মাসের পর মাস ধরে অবিরাম বোমাবর্ষণ, খাদ্য সংকট, একাধিকবার বাস্তুচ্যুতি ও অস্থায়ী আশ্রয়ে বসবাসের মতো চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, এই সময়ে পরিকল্পনাটি প্রকাশ করার পেছনে একাধিক কারণ থাকতে পারে। কেউ কেউ মনে করছেন, প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু ডানপন্থি মন্ত্রিসভার সদস্যদের তুষ্ট করতে চাইছেন। আবার অন্যরা মনে করছেন, গাজায় সৃষ্ট মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ নিয়ে বাড়তে থাকা আন্তর্জাতিক নিন্দা থেকে দৃষ্টি সরাতেও এ ঘোষণা
সৌদি আরব অবশেষে মুখ খুলল নেতানিয়াহুর গাজা দখলের পরিকল্পনা নিয়ে : ফিলিস্তিনের অবরুদ্ধ গাজা ভূখণ্ডের গাজা সিটি দখলে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহুর প্রস্তাব অনুমোদন করেছে দেশটির নিরাপত্তা মন্ত্রিসভা। তবে ইসরায়েলের এই পরিকল্পনার কড়া সমালোচনা করেছে মধ্যপ্রাচ্যের আরেক শক্তিশালী দেশ সৌদি আরব। এক বিবৃতিতে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, গাজা উপত্যকা দখলের সিদ্ধান্তকে তারা সবচেয়ে কঠোর ভাষায় নিন্দা জানাচ্ছে। রিয়াদ অভিযোগ করে, ইসরায়েল অবরুদ্ধ গাজায় ফিলিস্তিনিদের অনাহারে রাখা, নৃশংস আচরণ এবং জাতিগত নিধনের মতো অপরাধ চালিয়ে যাচ্ছে, যা মানবাধিকার ও আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
সৌদি আরব ছাড়াও ইসরায়েলের পরিকল্পনার তীব্র নিন্দা জানিয়েছে ইরাকের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও। ইরাক জানিয়েছে, এ পদক্ষেপ গাজায় নিরপরাধ মানুষের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের ক্ষুধার নীতি, বাস্তুচ্যুত করা এবং গণহত্যার নীতির অংশযা যুদ্ধাপরাধ হিসেবে গণ্য হয় এবং এর জন্য আন্তর্জাতিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা উচিত। বিবৃতিতে আরও জানানো হয়েছে, ইরাক ফিলিস্তিনি জনগণের অবিচ্ছেদ্য অধিকার, বিশেষ করে জেরুজালেমকে রাজধানী করে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে তাদের দৃঢ় সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে। সৌদি আরব ও ইরাকের এই প্রতিক্রিয়া এমন এক সময়ে এসেছে যখন আন্তর্জাতিক মহল ইসরায়েলের গাজায় পূর্ণ দখল পরিকল্পনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছে এবং তা বন্ধের আহ্বান জানাচ্ছে।
ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেবে না যুক্তরাষ্ট্র : ফিলিস্তিনকে রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই যুক্তরাষ্ট্রের। উলটো ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাসকে ধ্বংস করাই জরুরি মনে করে ওয়াশিংটন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ল্যামির সঙ্গে এক বৈঠকে এমনটাই মন্তব্য করেছেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভ্যান্স। দক্ষিণ লন্ডনে ল্যামির ব্যক্তিগত বাসভবনে অনুষ্ঠিত ওই বৈঠকে জেডি ভ্যান্স বলেন, ‘আমাদের ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার কোনো পরিকল্পনা নেই। আমার তো বুঝতেই কষ্ট হয়, ফিলিস্তিন রাষ্ট্র স্বীকৃতি দেওয়া বলতে আদৌ কী বোঝায়! কারণ সেখানে কার্যকর কোনো সরকারই নেই।’
যুক্তরাজ্যের ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেওয়ার সম্ভাবনা প্রসঙ্গে ভ্যান্স বলেন, ‘এটা এমন একটি বিষয়, যা নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই, যুক্তরাজ্য তার নিজের সিদ্ধান্ত নেবে। তবে প্রেসিডেন্ট (ট্রাম্প) যা পরিষ্কার করে বলেছেন, ইসরাইল ও গাজার বর্তমান পরিস্থিতিতে আমাদের দুটি স্পষ্ট লক্ষ্য রয়েছেÍ প্রথমত, আমরা নিশ্চিত করতে চাই যে, হামাস যেন আর কখনো নিরীহ ইসরাইলি নাগরিকদের ওপর হামলা চালাতে না পারে, যা হামাসকে সম্পূর্ণ ধ্বংসের মধ্য দিয়েই তা সম্ভব বলে আমরা মনে করি। দ্বিতীয়ত, প্রেসিডেন্ট গাজায় ভয়াবহ মানবিক সংকটের চিত্র দেখে গভীরভাবে বিচলিত হয়েছেন। তাই আমরা চাইএই মানবিক সমস্যা সমাধান হোক।’ এর আগে গত ২৯ জুলাই যুক্তরাজ্য ঘোষণা দেয়, ইসরাইল যদি গাজা উপত্যকায় মানবিক ত্রাণ সরবরাহে বাধা দেয় ও সেখানে তার সামরিক অভিযান বন্ধ না করে তবে তারা সেপ্টেম্বরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে। তার আগে গত ২৪ জুলাই ফরাসি প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁও ঘোষণা দেন, প্যারিস একই অধিবেশনে ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেবে।২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলি ভূখণ্ডে ঢুকে অতর্কিত হামলা চালায় ফিলিস্তিনি প্রতিরোধ আন্দোলন হামাসের যোদ্ধারা। এদিন ১ হাজার ২০০ জনকে হত্যার পাশাপাশি ২৫১ জনকে জিম্মি হিসেবে ধরে নিয়ে যায় তারা। হামাসের হামলার জবাব দিতে এবং জিম্মিদের মুক্ত করতে ওই দিন থেকেই গাজায় অভিযান শুরু করে ইসরাইলি বাহিনী। ১৫ মাসেরও বেশি সময় ধরে টানা অভিযান চালানোর পর যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যস্থতাকারী অন্যান্য দেশগুলোর চাপে বাধ্য হয়ে গত ১৯ জানুয়ারি গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। কিন্তু বিরতির দু’মাস শেষ হওয়ার আগেই গত ১৮ মার্চ থেকে ফের গাজায় অভিযান শুরু করে আইডিএফ।
গাজায় অনাহারে মৃতের সংখ্যা দুইশ’ ছাড়াল : বিগত ২৪ ঘণ্টায় গাজায় তীব্র অনাহারে আরও চারজনের মৃত্যু হয়েছে।গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় এ তথ্য জানিয়েছে। তারা জানায়, ক্ষুধাজনিত মৃত্যুর মোট সংখ্যা ২০১ জনে দাঁড়িয়েছে। সেখানকার লোকজন তীব্র অনাহার এবং অপুষ্টির শিকার হচ্ছেন। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে নারী ও শিশুরা। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় অবিরত হামলা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।
এরপর থেকে রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত ওই উপত্যকায় ইসরায়েলি হামলায় কমপক্ষে ৬১ হাজার ৩৩০ ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১ লাখ ৫২ হাজার ৩৫৯ জন আহত হয়েছে। এদিকে গাজা সিটি দখলের জন্য ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা অনুমোদন করেছে দেশটির নিরাপত্তা বিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটি। মন্ত্রিসভা যুদ্ধ শেষ করার জন্য পাঁচটি নীতিও গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে রয়েছে হামাস বা ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ নয়- এমন একটি বিকল্প বেসামরিক সরকার গঠন করা। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় জানিয়েছে, সেনাবাহিনী গাজা সিটির নিয়ন্ত্রণ নেবে যেখানে লাখো ফিলিস্তিনি বাস করে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর এই পদক্ষেপ ইসরায়েলেও ব্যাপক বিরোধিতার মুখে পড়েছে। হামাসের হাতে জিম্মিদের পরিবারগুলোও বলছে, এর ফলে জিম্মিদের জীবন ঝুঁকিতে পড়বে। আরও বেশি ফিলিস্তিনী বেসামরিক নাগরিক নিহত হওয়ার আশঙ্কাও রয়েছে।