গাজা উপত্যকায় ইসরাইলের চলমান আক্রমণ এবং পশ্চিম তীরে নিপীড়ন থেকে ফিলিস্তিনি জনগণকে বাঁচানোর জন্য ‘খুব বেশি সময় বাকি নেই’ বলে সতর্ক করেছেন জাতিসংঘের ফিলিস্তিন-বিষয়ক বিশেষ দূত।
বার্তা সংস্থা আনাদোলুর বরাত দিয়ে মিডল ইস্ট মনিটর জানিয়েছে, জানুয়ারিতে শুরু হওয়ার পর থেকে ইসরাইল কখনো গাজায় যুদ্ধবিরতি মানেনি এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের পক্ষ থেকে ব্যবস্থা না নেয়া পর্যন্ত ইসরাইল তার যুদ্ধাপরাধ বন্ধ করবে না বলে জানিয়েছেন জাতিসংঘের বিশেষ দূত ফ্রান্সেসকা আলবানিজ। ইসরাইলী প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুকে গাজায় নৃশংসতা এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য জবাবদিহি করার সম্ভাবনা নিয়েও আলবানিজ হতাশা প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন, জাতীয় বা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কোনো বিচার পাওয়ার আশা আমি আর করি না। কারণ আপনারা দেখছেন সবাই ক্রমাগতভাবে তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দিতে প্রস্তুত।
তিনি উল্লেখ করেন, অনেক পশ্চিমা ও ইউরোপীয় দেশ নেতানিয়াহুকে তাদের দেশে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত (আইসিসি) কর্তৃক জারিকৃত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা মানতে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, ইসরাইলী সরকার এবং বসতির বাসিন্দারা গাজা ও দখলকৃত পশ্চিম তীরের আরো জমি দখল করে ইসরাইলী রাষ্ট্রের মধ্যে নিয়ে নেওয়ার জন্য তাদের সম্প্রসারণবাদী লক্ষ্য বাস্তবায়ন করছে। আলবানিজ বলেন, ইসরাইলীরা ইউরোপের দুর্বলতা এবং যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসী অবস্থানকে কাজে লাগিয়ে শুধু ফিলিস্তিন নয়, গোটা মধ্যপ্রাচ্যে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করছে। তিনি বলেন, লেবানন, সিরিয়ায় আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে; এটা পাগলামি হবে যদি কেউ ভাবে যে ইসরাইল এখানেই থেমে যাবে। কারণ ইসরাইল স্পষ্ট করে বলেছে যে তারা ভূমধ্যসাগর থেকে জর্ডান নদী পর্যন্ত ভূমি চায়, যেন তারা ইহুদি জাতির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারে।
তিনি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বৈশ্বিক প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি আহ্বান জানান যেন তারা এই পরিকল্পনা নস্যাৎ করতে আরো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী আমাদের দখলদারিত্ব শেষ করতে হবে, গণহত্যা থামাতে হবে, বর্ণবাদ বন্ধ করতে হবে। তবে এই কাজের জন্য একটি মৌলিক উপাদান প্রয়োজন। আর তা হলো রাষ্ট্রগুলোর ইচ্ছাশক্তি, যা বর্তমানে অনুপস্থিত।
মার্চের শুরু থেকেই গাজায় ঢোকার চেকপয়েন্টগুলো বন্ধ করে রেখেছে ইসরাইল। ফলে ঢুকতে পারছে না ত্রাণবাহী ট্রাক। শীঘ্রই এই চেকপয়েন্টগুলো খোলা না হলে, ক্ষুধায় নিশ্চিতভাবেই মৃত্যু হবে বেশিরভাগ গাজাবাসীর।
গাজা উপত্যকার ২৩ লাখ বাসিন্দার জন্য সব ধরনের সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার ছয় সপ্তাহ পার হয়েছে। বছরের শুরুতে যুদ্ধবিরতির সময় যেটুকু খাবার মজুত করা হয়েছিল তা প্রায় শেষ হয়ে এসেছে। জরুরি খাবার বিতরণ থেমে যাচ্ছে, বেকারিগুলো বন্ধ, বাজারগুলো খালি।
খান ইউনিসের একটি শরণার্থী শিবিরে প্লাস্টিকের ছাউনি ঘেরা ঘনবসতিপূর্ণ এলাকায় নিজের পরিবারের সঙ্গে বসবাস করছেন আখরাস (৬৪)। সেখানেই তিনি কার্ডবোর্ড জ্বালিয়ে আগুন জ্বালান এবং একটি শিমের ক্যান গরম করেন। এটাই তাদের শেষ খাবার।
তিনি বলেন, আমরা ১৩ জনের পরিবার। এক ক্যান ফাভা শিম দিয়ে কী হবে?
আখরাস আরও বলেন, ‘আমরা যুদ্ধ বেঁচে গেছি, প্রতিদিন সকাল-বিকেল বোমাবর্ষণ সহ্য করেছি। কিন্তু আমরা ক্ষুধা সহ্য করতে পারবো না। না আমরা, না আমাদের সন্তানরা।’
উত্তরে নুসাইরাত শরণার্থী শিবিরে শত শত ফিলিস্তিনি একটি খোলা জায়গায় রান্না করা গরম ভাতের জন্য একটি সারিতে দাঁড়িয়ে আছেন। ছোট শিশুরা সামনে এগিয়ে আসছে, হাতে বালতি-পরিবারের জন্য কিছু খাবার নিয়ে যেতে চায় তারা।
এই জরুরি খাবার বিতরণ যেসব ত্রাণ সংস্থা চালাচ্ছে। তারা বলছে, যদি নতুন করে খাবার ঢুকাতে না পারে, তাহলে আর কয়েকদিনের মধ্যেই তাদেরও এই খাবার বিতরণ বন্ধ করে দিতে হবে।
বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি আগে গাজার ২৫টি বেকারিতে রুটি সরবরাহ করতো। এখন সবগুলো বেকারি বন্ধ। অল্প পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী বিতরণও বন্ধ হয়ে যেতে চলেছে।
জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থী সংস্থার জুলিয়েট তৌমা বলেছেন, সব ধরনের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র শেষ হয়ে যাচ্ছে।
তিনি বলেন, গত এক মাসের বেশি সময় ধরে ইসরাইলী কর্তৃপক্ষ গাজা অবরোধ করায় জিনিসপত্রের দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে। এর মানে, শিশুরা, নবজাতকেরা না খেয়ে ঘুমোতে যাচ্ছে। প্রতিদিন এই সামগ্রী ছাড়া গাজা গভীর দুর্ভিক্ষের দিকে আরও এক ধাপ এগোচ্ছে।
ইসরাইলি সেনাবাহিনী বলছে, গাজা শাসনকারী হামাস ত্রাণের অপব্যবহার করছে। হামাস যোদ্ধাদের হাতে যাতে ত্রাণ না পৌঁছে, সেজন্যই তারা সব সরবরাহ বন্ধ রেখেছে।
হামাস তাদের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে। বরং ইসরাইলকে ক্ষুধাকে যুদ্ধকৌশল হিসেবে ব্যবহারের অভিযোগ করেছে।
নুসাইরাতে নাইমা ফারজাল্লা বলেছেন, ‘যদি আমরা বোমায় না মরি, তাহলে ক্ষুধায় মরবো।’