রয়টার্স, কাঠমান্ডু পোস্ট, ইন্ডিয়া টুডে: নেপালে চলমান বিক্ষোভের জেরে প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলির পদত্যাগের পর দেশটিতে ভয়াবহ অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মঙ্গলবার দ্বিতীয় দিনের মতো কারফিউ উপেক্ষা করে হাজার হাজার বিক্ষোভকারী রাস্তায় নেমে আসেন। তারা দেশটির প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করেছেন। এই পরিস্থিতিতে নেপালের প্রতিবেশী ভারত বলছে, তারা নেপালের পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে নজরদারি করছে। এমনকি নেপালের পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি ভারতে পালিয়ে যেতে পারেন বলেও আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে। তবে তার পদত্যাগের পর নেপালের ত্রিভুবন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে সব ধরনের বিমানের উড্ডয়ন এবং অবতরণ বাতিল করে দিয়েছে কর্তৃপক্ষ।

এর মাঝেই সেখান থেকে মাত্র দুটি বিমান থাইল্যান্ড এবং চীনের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছে বলে দেশটির সংবাদমাধ্যম খবর দিয়েছে। তবে এই দুই ফ্লাইটে পদত্যাগ করা প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা অলি ছিলেন কি না তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। এদিকে, নেপালের সঙ্গে সীমান্তে উচ্চ সতর্কতা জারি করে ভারত বলেছে, নেপালে চলমান বিক্ষোভে প্রাণহানির ঘটনায় নয়াদিল্লি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। বিক্ষোভ চলমান থাকায় পরিস্থিতি ঘনিষ্ঠভাবে নজরদারি করা হচ্ছে। ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘‘ঘনিষ্ঠ বন্ধু ও প্রতিবেশী হিসেবে আমরা আশা করছি, সংশ্লিষ্ট সকল পক্ষ সংযম প্রদর্শন করবেন এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে ও আলোচনার মাধ্যমে যেকোনও সমস্যার সমাধান করবেন।’’

বিবৃতিতে আরও বলা হয়েছে, ‘‘আমরা লক্ষ্য করেছি, কর্তৃপক্ষ কাঠমান্ডু এবং নেপালের আরও কয়েকটি শহরে কারফিউ জারি করেছে। নেপালে অবস্থানরত ভারতীয় নাগরিকদের সতর্কতা অবলম্বন এবং নেপালি কর্তৃপক্ষের জারি করা পদক্ষেপ ও নির্দেশনা মেনে চলতে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে।’’ নেপালে চলমান অস্থিরতার মাঝে ভারতের পশ্চিমবঙ্গের পানিটাঙ্কিতে ভারত-নেপাল সীমান্তে উচ্চ সতর্কতা জারি করা হয়েছে। সেখানকার পুলিশ সুপার প্রবীণ প্রকাশ বলেছেন, নেপাল সীমান্তে পুলিশ তল্লাশি চৌকি স্থাপন এবং নিরাপত্তা বাহিনীর অতিরিক্ত সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। কর্তৃপক্ষ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। সীমান্ত পারাপার ও চলমান পরিস্থিতি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে।

মণিপুর যেতে পারছেন না নরেন্দ্র মোদি : ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় মণিপুর রাজ্যে সংখ্যাগরিষ্ঠ মেইতেই ও উপজাতীয় কুকি-জো সম্প্রদায়ের মধ্যে একটা সমঝোতা সূত্র পাওয়া গেছে বলে মনে করা হচ্ছিল। এ কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মণিপুর যেতে পারেন বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর বেরিয়েছিল। তবে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁর সফর সম্ভব নয় বলে দুই পক্ষের তরফে জানানো হয়েছে। মেইতেই সম্প্রদায়ের প্রধান নাগরিক সংগঠন কো-অর্ডিনেটিং কমিটি অন মণিপুর ইন্টেগ্রিটি-কোকোমির তরফে এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, সম্প্রতি কুকি-জো সমাজের সঙ্গে ভারত সরকারের যে আলাপ-আলোচনা হয়েছে, তারপর তাদের পক্ষে কুকি-জো সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনায় বসা সম্ভব নয়।

২ সেপ্টেম্বর ত্রিপক্ষীয় স্তরে মণিপুর সরকার, ভারত সরকার এবং দুই প্রধান উপজাতি সংগঠনের মধ্যে অস্ত্রবিরতি চুক্তি নবায়ন করা হয়। ২০০৮ সালে সই হওয়া এই চুক্তি বহাল থাকার কারণে বিদ্রোহী এবং সশস্ত্র কুকি-জো সংগঠনগুলো এবং সরকারি নিরাপত্তা বাহিনী একে অপরকে আক্রমণ করে না। মেইতেই সম্প্রদায়ের বিভিন্ন সংগঠন দীর্ঘদিন ধরে এই চুক্তির বিরোধিতা করছে। তাদের বক্তব্য, এই চুক্তি থাকার কারণে মিয়ানমার থেকে উপজাতি সংগঠনগুলো অস্ত্র আনতে পারছে, নির্বিঘ্নে মাদক চোরাচালান চালাতে পারছে। মেইতেইদের সংগঠন কোকোমির মাঝারি স্তরের এক নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘এ কারণেই আমরা মনে করছি, আলোচনায় বসার প্রশ্নে আমাদের বিশেষ কোনো গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না। তা যদি দেওয়া হতো, তাহলে এই চুক্তি এ রকম একটা সময়ে সরকার নবায়ন করত না। কিন্তু এটি করার কারণে মনে হচ্ছে, সরকার উপজাতীয় সম্প্রদায়ের যাবতীয় দাবি মানতে প্রস্তুত।’

ওই নেতা বলেন, এ অবস্থায় ১৩ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে মণিপুর সফর করা সম্ভব নয়। যে দুটি উপজাতি সংগঠনের সঙ্গে কথা বলে রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকার অস্ত্রবিরতি চুক্তি নবায়ন করেছে, তারা হলো কুকি ন্যাশনাল অর্গানাইজেশন ও ইউনাইটেড পিপলস ফ্রন্ট। এই দুই সংগঠনের কাছেই এখনো অস্ত্র রয়েছে। আরও একাধিক সংগঠন এই অস্ত্রবিরতি চুক্তির মধ্যে রয়েছে। তবে এই দুই সংগঠনই সবার পক্ষ থেকে চুক্তির বিষয়ে প্রতিনিধিত্ব করে। অন্যদিকে, সরকারের তরফে জানানো হয়, কুকি-জো সংগঠন ২ নম্বর জাতীয় সড়ক (মণিপুর-নাগাল্যান্ড মহাসড়ক) দীর্ঘদিন পর খুলে দিয়েছে। সেখানে অবরোধ নেই। সরকারি বক্তব্যের অর্থ, ওই সড়কের যেসব অংশ বিভিন্ন কুকি-জো সংগঠন নিয়ন্ত্রণ করত, সেখানে এখন মেইতেই সম্প্রদায়ের মানুষ যেতে পারবেন। তবে কুকি-জো সমাজের তরফে তাদের নাগরিক সংগঠন ‘কুকি-জো কাউন্সিল’ এই ধারণার বিরোধিতা করে বলেছে, ২ নম্বর জাতীয় সড়ক বরাবরই খোলা ছিল এবং সেখান দিয়ে অবাধে গাড়ি চলাচল করতে পারে। কাউন্সিলের পক্ষ থেকে আরও বলা হচ্ছে, এখন যদি বোঝানোর চেষ্টা করা হয়, ওই সড়ক খুলে গেছে এবং সেখান দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ সম্প্রদায় যাতায়াত করতে পারবে, তবে সেই বক্তব্য সঠিক নয়। মেইতেইদের সেখানে ‘স্বাগত জানানো হচ্ছে না’।