আল-জাজিরা, এএনআই : ভারতের বিহার রাজ্যে আগামী অক্টোবর বা নবেম্বরে বিধানসভা নির্বাচন হতে পারে। এর আগে রাজ্যের প্রায় আট কোটি ভোটারের নাগরিকত্বের নথিপত্র যাচাইয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। এ নিয়ে রাজ্যের সংখ্যালঘু মুসলিম ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠী গভীরভাবে উদ্বিগ্ন।

ভারতের শীর্ষ নির্বাচন পরিচালনাকারী সংস্থা ভারতীয় নির্বাচন কমিশন (ইসিআই) বিহার রাজ্যের প্রায় আট কোটি ভোটারের নথিপত্র নতুন করে যাচাই–বাছাই করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তথাকথিত ‘অবৈধ বিদেশি অনুপ্রবেশকারীদের’ যাতে চিহ্নিত করা যায়, সে জন্য এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ সিদ্ধান্তের ফলে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্রের দেশে গণহারে ভোটাধিকার হারানো ও মানুষকে দেশছাড়া করার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।

ইসি ২৪ জুন ঘোষণা দিয়েছে, ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য বিহারের প্রায় আট কোটি ভোটারকে ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে আবার ভোটার হিসেবে নিবন্ধন করতে হবে। বিহারের এই ভোটারের সংখ্যা যুক্তরাজ্যের মোট জনসংখ্যার সমান।

এ সময়সীমার মধ্যে যাঁরা নিবন্ধন করতে পারবেন না, তাঁরা ভোটাধিকার হারাবেন। পাশাপাশি ‘সন্দেহভাজন বিদেশি নাগরিক’ হিসেবে তাঁদের চিহ্নিত করা হবে। তাঁদের কারাগারে নেওয়া হতে পারে বা দেশ থেকে বহিষ্কারের মতো কঠিন পদক্ষেপও নেওয়া হতে পারে। বিহারে আগামী অক্টোবর বা নভেম্বর মাসে বিধানসভা নির্বাচন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

সমালোচকেরা বলছেন, এ পদক্ষেপ জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) চালুর একটি গোপন পরিকল্পনার অংশ। এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার তথাকথিত ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ চিহ্নিত করে দেশ থেকে তাড়াতে চায়।

এ সিদ্ধান্ত এমন এক সময় নেওয়া হয়েছে, যখন গত কয়েক সপ্তাহে হাজার হাজার বাংলাভাষী মুসলিমকে আটক করা হয়েছে এবং তাঁদের অনেককে তথাকথিত বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী বলে দেশ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে।

সমালোচকেরা বলছেন, এই পদক্ষেপ জাতীয় নাগরিক নিবন্ধন (এনআরসি) চালুর একটি গোপন পরিকল্পনার অংশ। এর মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সরকার তথাকথিত ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী’ চিহ্নিত করে দেশ থেকে তাড়াতে চায়।

আল-জাজিরার পক্ষ থেকে এ বিষয়ে জানতে নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রশ্ন পাঠানো হলেও কোনো উত্তর পাওয়া যায়নি। এমনকি পরে আবার মনে করিয়ে দেওয়ার পরেও কোনো জবাব দেওয়া হয়নি।

বিতর্কটা কী নিয়ে

ভারতের মানুষের মাথাপিছু আয়ের দিক থেকে বিহার সবচেয়ে দরিদ্র রাজ্য। সরকারি হিসাবে এই রাজ্যে এক-তৃতীয়াংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করেন।

তবে বিহার ভারতের তৃতীয় সর্বোচ্চ জনবহুল রাজ্য। রাজনৈতিকভাবে এই রাজ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ২০০৫ সাল থেকে বেশির ভাগ সময়ই মোদির বিজেপি আঞ্চলিক জনতা দলের (ইউনাইটেড) সঙ্গে জোট বেঁধে বিহারে ক্ষমতায় রয়েছে। মাঝেমধ্যে বিরোধীদের সরকার এলেও তা অল্প সময়ের জন্য।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, রাজ্যের আসন্ন নির্বাচনের আগে ভোটার যাচাইয়ের এই সিদ্ধান্তে বিহারের দরিদ্র মানুষের মধ্যে চরম উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। নথিপত্র সংগ্রহ করতে গিয়ে তাঁদের দিশেহারা অবস্থা।

বিরোধী দল ও সুশীল সমাজের নেতারা বলছেন, এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের পক্ষে নাগরিকত্ব প্রমাণ করা সম্ভব নয়। ফলে অনেকেই ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।

ভারতের প্রধান বিরোধী দল কংগ্রেস ও তাদের বিহারের নির্বাচনী জোটসঙ্গী রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) নির্বাচন কমিশনের এ সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে গত বুধবার ‘বিহার বন্ধ’ কর্মসূচি পালন করেছে। বিহারের রাজধানী পাটনায় এই বিক্ষোভের নেতৃত্ব দেন বিরোধীদলীয় নেতা রাহুল গান্ধী।

বিরোধী নেতারা ও কিছু নাগরিক সংগঠন এই প্রক্রিয়া বাতিলের অনুরোধ জানিয়ে সুপ্রিম কোর্টে আবেদন করেছে। আদালতে এই আবেদন নিয়ে শুনানি হবে।

এই ভোটার তালিকা যাচাই কার্যত এনআরসির অংশ। কারণ, নির্বাচন কমিশন জনগণকে তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে বাধ্য করছে

রাজ্যের শাসক দল বিজেপি নির্বাচন কমিশনের এ সিদ্ধান্তের প্রতি জানিয়ে দাবি করছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার থেকে বিপুলসংখ্যক মুসলিম অভিবাসী ভারতে ঢুকেছে। সুতরাং তারা চায়, এ পদক্ষেপ সারা দেশেই চালু করা হোক। আল–জাজিরা বিজেপির মুখপাত্র অনিল বালুনির কাছে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলেও তিনি কোনো উত্তর দেননি।

তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও নির্বাচন–সংক্রান্ত স্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেছেন, এই পদক্ষেপ ভারতের গণতন্ত্র ও ভোটারদের অধিকার নিয়ে গভীর উদ্বেগ তৈরি করছে।

নির্বাচন কমিশনের ব্যাখ্যা কী

গত ২৪ জুন নির্বাচন কমিশন দাবি করেছে, ভোটার তালিকায় যেন অযোগ্য কেউ না থাকে, তা নিশ্চিত করতেই এ কাজ শুরু করা হয়েছে। তারা দাবি করেছে, দ্রুত নগরায়ণ, মানুষের ঘন ঘন স্থান পরিবর্তন, নতুন ভোটার যুক্ত হওয়া, মৃত ব্যক্তিদের নাম তালিকায় থাকা এবং বিদেশি অনুপ্রবেশকারীদের নাম ঢুকে পড়াÑ এসব কারণে তালিকাটি আবার খতিয়ে দেখা জরুরি।

সর্বশেষ এমন একটি সম্পূর্ণ যাচাই হয়েছিল ২০০৩ সালে। তবে তারপর থেকে নিয়মিত ভোটার তালিকা হালনাগাদ ও কাটছাঁট করা হয়েছে। এমনকি গত বছর জাতীয় নির্বাচনের আগেও হালনাগাদ করা হয়েছে।

ইসির মতে, যারা ২০০৩ সালে ভোটার তালিকায় ছিলেন, তাঁদের শুধু আবার নিবন্ধন ফর্ম জমা দিলেই হবে; কিন্তু যাঁরা পরে যুক্ত হয়েছেন, তাঁদের জন্মতারিখ, জন্মস্থান ও মা-বাবার পরিচয়পত্রের প্রমাণ জমা দিতে হবে।

বিহারে মোট ভোটারের সংখ্যা প্রায় ৭ কোটি ৯৬ লাখ। ইসির হিসাবমতে, এর মধ্যে ২ কোটি ৯০ লাখের মতো ভোটারকে তাঁদের পরিচয় প্রমাণ করতে হবে। তবে নিরপেক্ষ বিশ্লেষকেরা বলছেন, প্রকৃত সংখ্যা চার কোটির বেশি হতে পারে।

এ প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনের কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফরম বিতরণ করবেন। ভোটারদের সেই ফরমের সঙ্গে প্রমাণপত্র যুক্ত করে ২৬ জুলাইয়ের মধ্যে জমা দিতে হবে। এরপর ১ আগস্ট খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হবে। হালনাগাদ ভোটার তালিকায় যাঁদের নাম বাদ পড়বে, তাঁরা এক মাসের মধ্যে আপত্তি জানাতে পারবেন।

বিরোধী দল ও সুশীল সমাজের নেতারা বলছেন, এত অল্প সময়ের মধ্যে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের পক্ষে নাগরিকত্ব প্রমাণ করা সম্ভব নয়। ফলে অনেকেই ভোট দেওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে পারেন।

অ্যাসোসিয়েশন ফর ডেমোক্রেটিক রিফর্মসের (এডিআর) সদস্য এবং দীর্ঘ ২৫ বছর ধরে নির্বাচনী স্বচ্ছতা নিয়ে কাজ করছেন জগদীপ ছোক্কার। তিনি বলেন, ২০০৩ সালের পর যাঁরা নতুন ভোটার হয়েছেন, তাঁদের সবাইকে যাচাই–বাছাই করার সিদ্ধান্ত বিহারের বিগত ২২ বছরের সব নির্বাচনের বৈধতা নিয়েই প্রশ্ন তুলবে।

জগদীপ বলেন, ‘তাহলে কি নির্বাচন কমিশন বলছে, ২০০৩ সাল থেকে বিহারের সব ভোটেই দুর্নীতি হয়েছে? তাহলে কি এত বছরে যেসব নেতা নির্বাচিত হয়েছেন, তাঁরা সবাই অবৈধ?’

এ ধরনের পদক্ষেপে মুসলিমদের ওপর প্রভাব বেশি পড়ে। কারণ, নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (সিএএ) অনুসারে, হিন্দু, শিখ, জৈন, বৌদ্ধ, পারসি ও খ্রিষ্টানদের নাগরিকত্ব পেতে সুবিধা দেওয়া হয়; কিন্তু মুসলিমদের নয়।

এ আইন ২০১৯ সালে ভারতের লোকসভায় পাস হয় এবং ২০২৪ সালের মার্চ মাসে তা কার্যকর করে মোদি সরকার।

ফলে অবৈধভাবে ভারতে থাকা অমুসলিমদের নাগরিকত্ব পাওয়ার সুযোগ থাকলেও মুসলিমদের থাকে না। তাঁদের থাকে কারাগারে যাওয়া বা দেশছাড়া হওয়ার ঝুঁকি।

বিহার রাজ্যে মোট জনসংখ্যার ১৭ শতাংশ মুসলিম, যেটা সংখ্যায় প্রায় ১ কোটি ৭৬ লাখ।

অপূর্বানন্দ বলেন, এই ভোটার তালিকা যাচাই কার্যত এনআরসির অংশ। কারণ, নির্বাচন কমিশন জনগণকে তাদের নাগরিকত্ব প্রমাণ করতে বাধ্য করছে।

জগদীপ ছোক্কারের এডিআর প্রথম সুপ্রিম কোর্টে এই যাচাইপ্রক্রিয়া বন্ধ করতে আবেদন করেছিলেন। তিনি বলছিলেন, এর ফলাফল ভয়াবহ হতে পারে। এমনকি পুরো বিহার রাজ্যের অর্ধেক মানুষই ভোটাধিকার হারাতে পারেন।