নেপালের আইনশৃঙ্খলার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। গতকাল বুধবার সকাল থেকে বিধিনিষেধমূলক নির্দেশ জারি করে তারা। যা বিকাল ৫টা পর্যন্ত চলবে। এরপর সন্ধ্যা থেকে পরদিন সকাল ৬টা পর্যন্ত কারফিউ জারি থাকবে। সেনাবাহিনী জানিয়েছে, বিক্ষোভের আড়ালে ভাঙচুর ঠেকাতে এ ধরনের পদক্ষেপ প্রয়োজন ছিল। এক বিবৃতিতে সেনাবাহিনী সতর্কতা দিয়ে বলেছে, “এ সময়ে যেকোনো ধরনের বিক্ষোভ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, অথবা ব্যক্তি ও সম্পত্তির ওপর হামলাকে অপরাধমূলক কাজ হিসেবে গণ্য করা হবে এবং সেই অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” এছাড়া ধর্ষণের হুমকি ও নির্দিষ্ট ব্যক্তির ওপর হামলার ব্যাপারেও সতর্কতা দিয়েছে সেনাবাহিনী। রয়টার্স, ডয়চে ভেলে, টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া, সিএনএন, রয়টার্স,দ্য উইক, এনডিটিভি ।

প্রয়োজনীয় সেবাÑ যার মধ্যে আছে অ্যাম্বুলেন্স, ফায়ার ইঞ্জিন, স্বাস্থ্যকর্মী এবং নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা বিধিনিষেধমূলক নির্দেশের বাইরে থাকবে। গত মঙ্গলবার প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি বিক্ষোভের মুখে পদত্যাগের পর নেপালে অস্থিরতা তৈরি হয়। পার্লামেন্ট ভবন, আদালত, মন্ত্রীদের ঘরবাড়িসহ বহু জায়গায় অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। এরপর রাত ১০টার দিকে দেশটির নিয়ন্ত্রণ নেয় সেনাবাহিনী।

গত সোমবার নিরাপত্তা বাহিনীর গুলীতে ১৯ বিক্ষোভকারী নিহত হয়। এরপর সাধারণ মানুষ ক্ষোভে ফুসে ওঠেন। মঙ্গলবার সকালে তারা বিভিন্ন জায়গায় জড়ো হতে থাকেন। এ সময় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে কেপি শর্মা ওলিকে প্রধানমন্ত্রীর পদ ছাড়তে বলেন দেশটির সেনাপ্রধান। কয়েক দশকের দুর্নীতি ও সেগুলোর বিচার না করা, ফেসবুক ইউটিউবসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম বন্ধ করার জেরে প্রথমে বিক্ষোভ শুরু হয়। প্রথমে এটি শান্তিপ্রিয় ছিল। তবে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলীতে বিক্ষোভকারীরা নিহত হলে এটি সহিংস রূপ নেয়।

গতকাল বুধবার সকাল থেকেই সেনারা কাঠমান্ডু ও অন্যান্য শহরে অবস্থান নেন। ওই সময় কড়া নিয়মকানুন জারির পাশপাশি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজ শুরু করেন তারা। সেনাবাহিনী নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর গতকাল বুধবার সকাল থেকেই শান্ত হয়ে আসে নেপাল। সাধারণ মানুষও ঘরবাড়ি থেকে বের হননি। নেপালের সর্বত্র এখন অস্বাভাবিক নিরবতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে। যেসব সরকারি ভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল সেগুলোর আগুন নেভানোর চেষ্টা শুরু হয় বুধবার সকাল থেকে। গতকাল ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও আটকে রাখেন বিক্ষোভকারীরা।

নেপালে বিক্ষোভকারীদের আলোচনায় বসার আহ্বান প্রেসিডেন্টের : তরুণদের দুই দিনের টানা বিক্ষোভ, সংঘাত ও রক্তপাতের পর নেপালে থমথমে অবস্থা বিরাজ করেছে। গতকাল মঙ্গলবার বিকেলে পদত্যাগের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি। এরপরই নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মাঠে নেমেছে সেনাবাহিনী। চলমান এ সংকটের একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে পেতে সহযোগিতার জন্য তরুণ বিক্ষোভকারীদের আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন নেপালের প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাওদেল। গত রাতে এক বিবৃতিতে প্রেসিডেন্ট পাওদেল বলেন, ‘একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায়, নাগরিকদের উত্থাপিত দাবিগুলো আলোচনা ও সংলাপের মাধ্যমে সমাধান করা যায়, যেখানে জেন-জি প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণও থাকতে পারে।’ নেপালের পার্লামেন্টে এখন কোনো দলের স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। তাই আইনপ্রণেতারা খুব সম্ভবত একটি অন্তর্র্বতী সরকার গঠন করবেন।

এর আগে চলমান সংকটের সমাধান খুঁজে বের করতে বিক্ষোভকারীদের আলোচনার টেবিলে বসার আহ্বান জানিয়েছেন নেপালের সেনাপ্রধান জেনারেল অশোক রাজ সিগদেল। গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক ভিডিও বার্তায় সেনাপ্রধান এ আহ্বান জানান। নেপালের সেনাপ্রধান বলেছেন, জাতীয় ঐক্য ও ভৌগোলিক অখ-তা রক্ষায় সেনাবাহিনী প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। বিক্ষোভে ব্যাপক প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি হয়েছে। এ অবস্থায় বিক্ষোভকারীদের সংযম প্রদর্শনের আহ্বানও জানিয়েছেন তিনি। ভারতীয় পত্রিকা জানিয়েছে, গতকাল নেপালের সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এক বিজ্ঞপ্তিতে দেশের বর্তমান পরিস্থিতির ‘অন্যায্য সুযোগ’ না নেওয়ার বিষয়ে সবাইকে সতর্ক করা হয়েছে। ওই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, স্থানীয় সময় মঙ্গলবার রাত ১০টা থেকে সেনাবাহিনী দেশের নিরাপত্তা কার্যক্রমের দায়িত্ব নিয়েছে। গত বিকেলে কে পি শর্মা অলির পদত্যাগের ঘোষণার পর নেপালের প্রেসিডেন্ট রামচন্দ্র পাওদেলের পদত্যাগের গুজবও ছড়িয়ে পড়েছিল। কয়েকটি গণমাধ্যমে এ নিয়ে খবরও প্রকাশ পেয়েছিল। পরে নেপালের সেনাবাহিনী জানায়, প্রেসিডেন্ট পাওদেল পদত্যাগ করেননি।

অপতথ্য, মিথ্যা তথ্য, ঘৃণা ছড়ানোসহ নানা অভিযোগে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে নেপালে ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও বার্তা আদান-প্রদানের অ্যাপ নিষিদ্ধ করা হয়। এর আগে কোম্পানিগুলোকে নেপালের আইন মেনে নিবন্ধন করতে এক সপ্তাহ সময় দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু টিকটক, ভাইবারসহ আরও পাঁচটি অ্যাপ সরকারের শর্ত মেনে নিবন্ধন করালেও অন্যগুলো তা করেনি। এতে ফেসবুক, এক্স, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব বা লিংকডইনের মতো অ্যাপ ও প্ল্যাটফর্মগুলোয় নেপাল থেকে ঢোকা যাচ্ছিল না। সরকারের এই সিদ্ধান্ত নেপালি তরুণদের মধ্যে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। সঙ্গে অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেকারত্ব ও রাজনৈতিক নেতা ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের লাগামহীন দুর্নীতির মতো বিষয়গুলো সামনে চলে আসে।

তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও অন্যান্য প্ল্যাটফর্ম বন্ধের কয়েক সপ্তাহ আগে থেকে দেশটিতে ‘নেপো কিডস’ ও ‘নেপো বেবিস’ হ্যাশট্যাগ জনপ্রিয় হচ্ছিল। ধনী রাজনীতিবিদ ও প্রভাবশালী ব্যক্তিদের সন্তানদের বিলাসী জীবনযাপন, স্বজনপ্রীতির কারণে সব ক্ষেত্রে তাদের স্পষ্ট সুবিধাভোগ এবং অনলাইনে এসব নিয়ে তাঁদের নির্লজ্জ প্রদর্শন নেপালের সাধারণ মানুষ, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করছিল।

অনেকের মতে, সম্পদ ও বিশেষ সুবিধার এই নির্লজ্জ প্রদর্শন নেপালের ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে ব্যাপক বৈষম্যকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছে। অনলাইনে তরুণদের এই ক্ষোভ ধীরে ধীরে দানা বাঁধতে শুরু করে। গত সোমবার কয়েক হাজার তরুণ রাজধানী কাঠমান্ডুসহ নেপালের আরও সাতটি শহরে রাজপথে নেমে বিক্ষোভ শুরু করে। জেন জি প্রজন্মের তরুণদের এই বিক্ষোভ দমনে কঠোর হয় সরকার। নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষে সেদিন ১৯ জন নিহত এবং কয়েকশ’ বিক্ষোভকারী আহত হন।

এমন পরিস্থিতিতে চাপে পড়ে যায় অলি সরকার। বিক্ষোভকারীদের শান্ত করতে সোমবারই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়। কিন্তু আগের দিন বিক্ষোভকারীদের ওপর সরকারের অতিরিক্ত বলপ্রয়োগের প্রতিবাদে গত মঙ্গলবার ভোর থেকেই তাঁরা আবার রাস্তায় নামেন। তাঁদের থামাতে কারফিউ জারি করা হয়। বিক্ষোভকারীরা কারফিউ উপেক্ষা করে বিভিন্ন সরকারি ভবন ও সরকারের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের বাড়ি ও দলীয় কার্যালয়ে হামলা, ভাঙচুর চালান এবং আগুন দেন।

গতকালও দুই বিক্ষোভকারী নিহত হন। এ নিয়ে দুই দিনের বিক্ষোভে অন্তত ২২ জন নিহত হয়েছেন বলে সিএনএনকে জানিয়েছেন কাঠমান্ডুর সিভিল সার্ভিস হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক মোহন রেগমি। আরও চার শতাধিক বিক্ষোভকারী আহত হয়েছেন বলে জানান তিনি। গত বিকেলে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অলির সরে দাঁড়ানোর ঘোষণার পর প্রেসিডেন্ট পাওদেল তাঁর পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেন এবং পার্লামেন্টকে নতুন সরকার গঠনের আহ্বান জানান। সিএনএনকে এ তথ্য জানিয়েছেন নেপালভিত্তিক জননীতি বিশ্লেষক বিনয় মিশ্রা। তবে নেপালের পার্লামেন্টে এখন কোনো দলের স্পষ্ট সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। তাই আইনপ্রণেতারা খুব সম্ভবত একটি অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবেন। অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বে কারা থাকবেন, তা নিয়ে আলোচনায় জেন-জিদের প্রতিনিধিরাও থাকবেন বলে মনে করেন সহকারী অধ্যাপক মিশ্রা।

কাঠমান্ডু বিমানবন্দর সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে : নেপালের প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগ করার পরেও দেশটিতে অশান্তি অব্যাহত রয়েছে। রাজধানী কাঠমান্ডুর বিমানবন্দর এখনো বন্ধ। দেশটির অন্যতম প্রধান এই বিমানবন্দরটি সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। নেপালের পার্লামেন্ট ভবন, সিংহদরবার, নেতা-মন্ত্রীদের বাড়িসহ বহু প্রতিষ্ঠানে মঙ্গলবার আগুন লাগিয়ে দেয় বিক্ষোভকারীরা। এলাকা ছেড়ে পালিয়েছেন একাধিক মন্ত্রী। আক্রমণ চালানো হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রী প্রচ-ের বাড়িতেও। তিনিও বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছেন। কান্তিপুর টেলিভিশনের ডেপুটি এডিটর রুপেশ জানিয়েছেন, “আমাদের অফিসেও আক্রমণ চালানো হয়েছে। আমাকে মারধর করা হয়েছে। পরিস্থিতি এখনো অগ্নিগর্ভ। সেনাবাহিনী শান্তিপূর্ণ আলোচনার আহ্বান জানিয়েছে।” গত বুধবার সকালে কাঠমান্ডুর একাধিক জায়গার দখল নিয়েছে সেনাবাহিনী। সিংহদরবার অঞ্চলে সেনাবাহিনী টহল দিচ্ছে। বিমানবন্দর এবং পশুপতিনাথ মন্দিরেও সেনা প্রহরা বসেছে। তবে বিমানবন্দর এখনো পর্যন্ত খোলা হয়নি। বুধবার বিকেলের দিকে বিমানবন্দর খুলতে পারে বলে কাঠমান্ডু বিমানবন্দরের সূত্র জানিয়েছে।

এদিকে এরপর নেপালের ভবিষ্যৎ কী হবে, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে। জেন জি আন্দোলনের সদস্য রজত দাস জানিয়েছেন, “আমরা সম্পূর্ণ রাজনৈতিক পরিবর্তন চাইছি। এখন নেপালের রাজনৈতিক পরিকাঠামো আমরা মানছি না। সবকিছু নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার।” বস্তুত নতুন রাজনৈতিক পরিকাঠামো নিয়ে জেন জি আন্দোলনকারীদের মধ্যেও দ্বিমত আছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞেরা। নেপালের সিনিয়র সাংবাদিক ভাস্কর রাজ জানিয়েছেন, “পরিস্থিতি শান্ত না হলে ভবিষ্যৎ কী হবে, তা বলা কঠিন। সেনাবাহিনী আপাতত বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামলানোর চেষ্টা করছে। এরপর আলোচনার মাধ্যমে সমাধানসূত্র খুঁজতে হবে।” তবে নেপালের একটি রাজনৈতিক থিংকট্যাংকের সূত্র জানিয়েছে, জেন জি আন্দোলনকারীদের অন্যতম পছন্দের নেতা কাঠমান্ডুর বর্তমান মেয়র বলেন্দ্র শাহ। তিনি স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে মেয়র নির্বাচনে অংশ নিয়েছিলেন এবং বিপুল ভোটে জয়ী হয়েছিলেন। সামাজিক স্তরে তিনি জনপ্রিয়। গতকাল বুধবার বলেন্দ্রও বিক্ষোভকারীদের শান্তিপূর্ণ আলোচনার আহ্বান জানিয়েছেন। আলোচনার মাধ্যমে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। তবে বলেন্দ্রই পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হবেন কি না, তা এখনো স্পষ্ট নয় বলে মনে করছেন ওই রাজনৈতিক থিংক ট্যাংকের সূত্র।

নেতারা কোথায় : প্রধানমন্ত্রী কেপি শর্মা ওলি পদত্যাগ করার পর তার বাড়িতে আক্রমণ হয়েছে। মঙ্গলবার একটি চপারে করে তাকে উড়ে যেতে দেখা যায়। সূত্র জানিয়েছে, সেনাবাহিনী তাকে এবং আরও বেশ কিছু মন্ত্রীকে নিজেদের সেফ হাউসে রেখেছে। মনে করা হচ্ছে, প্রচ-কেও সেফ হাউসে রাখা হয়েছে। কেউ এখনো পর্যন্ত দেশের বাইরে যেতে পারেননি বলে মনে করা হচ্ছে। অন্যদিকে জেন জি আন্দোলনকারীদের একটি বড় অংশের অভিযোগ, সেনাবাহিনী শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে নেতা-মন্ত্রীদের আশ্রয় দিচ্ছে। যদিও বিক্ষোভকারীদের সকলে এই অভিযোগের সঙ্গে একমত নন। গত মঙ্গলবার কাঠমান্ডু ছাড়াও পোখরাসহ নেপালের আরও বেশ কিছু শহরে এই বিক্ষভ ছড়িয়েছে। সেখানেও স্থানীয় প্রশাসনিক ভবনে আগুন লাগানো হয়েছে।

কারাগার থেকে পালালেন সাবেক মন্ত্রী : নেপালে বিক্ষোভ-অস্থিরতার সুযোগে কারাগার থেকে পালিয়েছেন দেশটির সাবেক প্রতিমন্ত্রী সঞ্জয় কুমার শাহ। ২০১২ সালে বোমা হামলা ও হত্যার দায়ে ললিতপুর জেলার নাক্কু কারাগারে যাবজ্জীবন কারাবাসের সাজা খাটছিলেন তিনি। এক প্রতিবেদনে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম জানিয়েছে, সঞ্জয় কুমার শাহ এর সঙ্গে আরও কয়েকজন হাই প্রোফাইল কারবন্দি পালিয়েছেন, এদের মধ্যে দেশটির চতুর্থ বৃহত্তম রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রীয় স্বতন্ত্র পার্টির প্রেসিডেন্ট রবি লামিচানেও আছেন।

ফেসবুক, টুইটার, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রামসহ ২৬টি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নিষেধাজ্ঞা আরোপ এবং সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে শিক্ষার্থী ও তরুণ প্রজন্মের মাত্র দুই দিনের তীব্র আন্দোলনে নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলির নেতৃত্বাধীন সরকারের পতন হয়েছে। তবে আন্দোলনের দুই দিন ব্যাপক সহিংসতাও হয়েছে নেপালে। নিরপত্তা বাহিনীর গুলীতে ৮ সেপ্টেম্বর ১৯ জন আন্দোলনকারী নিহত হয়েছেন, আহত হয়েছেন আর ও শতাধিক। পরের দিন ৯ সেপ্টেম্বর বিক্ষোভ ভয়াবহ সহিংস রূপ নেয়। আন্দোলনকারীরা পার্লামেন্ট, মন্ত্রি এমপিরেদ বাসভবনসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর-লুটপাট-অগ্নিসংযোগ করা শুরু করেন। কারাগারগুলোতেও শুরু হয় অস্থিরতা। কয়েদিরা বিদ্রোহ করেন এবং দলে দলে ফটক থেকে বের হয়ে যান। সঞ্জয় কুমার শাহও তাদের মধ্যে একজন। নেপালের জনকপুর জেলার এই সাবেক এমপি এবং প্রতিমন্ত্রী দেশটির রাজনৈতিক দল সদ্ভাবনা পার্টির জেষ্ঠ্য নেতা। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জিতে তিনি পার্লামেন্টে প্রবেশ করেন। এর চার বছর পর ২০১২ সালের ৩০ এপ্রিল জনকপুরের রামানন্দ চক এলাকায় এক বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় ৫ জন নিহত হন। হামলার প্রধান পরিকল্পনাকারী হিসেবে গ্রেপ্তার হন সঞ্জয় কুমার শাহ। এছাড়া তার বিরুদ্ধে অরুন সিংহানিয়া নামের এক রেডিও সাংবাদিককে হত্যার অভিযোগও রয়েছে। পুলিশ জানিয়েছে, সঞ্জয় নিজে হত্যা না করলেও এই ষড়যন্ত্রের হোতা ছিলেন।

২০১৩ সাল থেকে কারাগারে ছিলেন সঞ্জয় কুমার শাহ। সেই হিসেবে প্রায় এক যুগেরও বেশি সময় ধরে কারাগারে ছিলেন তিনি। শিক্ষার্থী জনতার ভয়াবহ বিক্ষোভের মুখে গতকাল মঙ্গলবার দুপুরে পদত্যাগ করেন নেপালের প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা অলি। দায়িত্ব নেওয়ার মাত্র এক বছরের মাথায় পতন ঘটল তার নেতৃত্বাধীন সরকারের।

পার্লামেন্ট ভবনে সেনা প্রহরা : বিক্ষোভে উত্তাল নেপালের পার্লামেন্ট ভবনের নিরাপত্তায় গতকাল বুধবার সেখানে সেনা প্রহরার ব্যবস্থা করা হয়েছে। টানা দুদিনের সহিংসতায় প্রধানমন্ত্রী কে পি শর্মা ওলির পদত্যাগ ও রাজধানী কাঠমা-ুতে অনির্দিষ্টকালের কারফিউ জারিকে ঘিরে রাজধানীর রাস্তাঘাট হয়ে পড়েছে প্রায় জনশূন্য। সেনাবাহিনীর মুখপাত্র রাজা রাম বাসনেত বলেন, আমরা প্রথমে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছি। সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা আমাদের প্রধান লক্ষ্য। গত সপ্তাহে নেপালে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিষিদ্ধ করার সিদ্ধান্ত থেকে বিক্ষোভের সূত্রপাত। নিষেধাজ্ঞা পরে তুলে নেওয়া হলেও সোমবার সহিংসতা ছড়িয়ে পড়লে ১৯ জন নিহত হন। গত মঙ্গলবার ক্ষুব্ধ বিক্ষোভকারীরা পার্লামেন্ট ভবনে আগুন ধরিয়ে দিলে প্রধান হল পুড়ে যায়। সেনা দমকল বাহিনীর চেষ্টায় পরে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা হয়।

গত মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্ট ভবন, কয়েকজন মন্ত্রীর বাসভবন এবং ওলির ব্যক্তিগত বাসভবনেও আগুন দেওয়া হয়। অবশ্য ওলির পদত্যাগের পর সহিংসতা কিছুটা স্তিমিত হয়। কাঠমান্ডুর প্রধান বিমানবন্দর সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত বন্ধ থাকায় ফ্লাইট চলাচলও ব্যাহত হয়। সেনাবাহিনী এক ঘোষণায় জানিয়েছে, কারফিউ বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত বহাল থাকবে এবং পরিস্থিতি মোকাবিলায় সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো সমন্বয় করছে। স্থানীয় সংবাদমাধ্যম জানায়, কর্তৃপক্ষ ও বিক্ষোভকারীদের মধ্যে আলোচনা আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে। তবে এ বিষয়ে স্বাধীনভাবে নিশ্চিত হতে পারেনি ।