জিও নিউজ, দ্য এক্সপ্রেস ট্রিবিউন, ডন : ভারতকে কাশ্মীর বিরোধসহ সব বিবদমান বিষয় নিয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়েছেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ। গত বুধবার সিয়ালকোটের পাসরুর ক্যান্টনমেন্ট পরিদর্শনের সময় ভারতের প্রতি এ আলোচনার প্রস্তাব দেন তিনি। শাহবাজ বলেন, দুই পারমাণবিক শক্তিধর প্রতিবেশী দেশকে পানি বণ্টনসহ যাবতীয় সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে আলোচনায় বসা উচিত।

ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে সাম্প্রতিক সংঘাত চলাকালে পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী ‘বুনইয়ান-উন-মারসুস’ নামে যে অভিযান চালিয়েছিল, তার প্রশংসা করেন শাহবাজ শরিফ। পেহেলগাম হামলার পর ভারতের আক্রমণের জবাবে এই সামরিক অভিযান চালায় পাকিস্তান। এই অভিযান চলাকালে ২৬টি ভারতীয় সামরিক স্থাপনায় আঘাত হানে পাকিস্তান। এর মধ্যে বিমানঘাঁটিও ছিল।

শাহবাজ শরিফ সেনাদের উদ্দেশে দেওয়া বক্তব্যে বলেন, ৬ থেকে ৭ মে ভারতীয় হামলার জবাবে পাকিস্তান পাল্টা যে অভিযান চালিয়েছে, তাতে প্রতিবেশী দেশের বিরাট ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। পাকিস্তান বিমানবাহিনী একাধিক ভারতীয় রাফাল যুদ্ধবিমান ভূপাতিত করেছে। ২৬টি সামরিক লক্ষ্যবস্তুতে পাকিস্তানের আঘাতকে ১৯৭১ সালের যুদ্ধের প্রতিশোধ হিসেবেও বর্ণনা করেন তিনি। ভবিষ্যতে হামলার বিষয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে সতর্ক করেন শাহবাজ। তিনি বলেন, ‘যদি আবার আমাদের ওপর হামলা চালান, তবে সবকিছু হারাবেন। আমরা যুদ্ধের জন্যও প্রস্তুত, আবার সংলাপের জন্যও। এখন সিদ্ধান্ত আপনার।’ সম্প্রতি জাতির উদ্দেশে মোদির দেওয়া ভাষণের প্রসঙ্গ টেনে শাহবাজ বলেন, ‘আমাদের শর্ত দেবেন না। পানি আমাদের রেডলাইনÍআমাদের পানির প্রবাহ থামানোর কথা কল্পনাও করবেন না। হ্যাঁ, পানি ও রক্ত একসঙ্গে বইতে পারে না। আমাদের নীলাম-ঝিলাম পানি প্রকল্পেও আপনারা হামলা চালিয়েছেন। যদি সেখানে বড় আকারের ক্ষতি হতো, তবে বাগলিহারসহ আপনাদের গুরুত্বপূর্ণ বাঁধগুলো আমরা ধ্বংস করে দিতাম।’

শাহবাজ মোদীকে উদ্দেশ করে আবারও বলেন, ‘আসুন, এই আগুন নিভাই, চলুন বসে কাশ্মির ও পানির বিষয়ে কথা বলি।’ পেহেলগাম হামলার পর ভারত পাকিস্তানের সঙ্গে পানি চুক্তি স্থগিত করে। জবাবে পাকিস্তান কড়া প্রতিক্রিয়া জানায়। এদিকে ভারতীয় এক সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বঙ্গা বলেন, ‘সিন্ধু পানি চুক্তিতে স্থগিত করার কোনও ধারা নেই। এটি হয় বাতিল করতে হবে অথবা নতুন একটি চুক্তিতে আসতে হবেÍযা দুই দেশের সম্মতির ভিত্তিতে সম্ভব। বিশ্বব্যাংকের এখানে সিদ্ধান্তগ্রহণের কোনও ভূমিকা নেই, আমরা কেবল মধ্যস্থতাকারী।’

গতকাল বুধবার বিকেলে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপকালে প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ দক্ষিণ এশিয়ায় উত্তেজনা প্রশমনে তার কূটনৈতিক প্রচেষ্টার জন্য ধন্যবাদ জানান। গত দুই সপ্তাহে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে জাতিসংঘ মহাসচিবের এটি ছিল তৃতীয় ফোনালাপ।

ফের হামলা চালাতে পারে ভারত : এদিকে চলমান যুদ্ধবিরতি ভেঙে ভারত ফের হামলা চালাতে পারে সতর্কবার্তা দিয়েছেন পাকিস্তানের প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা আসিফ। সেই সঙ্গে তিনি বলেছেন, ভারতের পক্ষ থেকে উসকানি এলে তার শক্ত জবাব দেবে পাকিস্তান। গত বুধবার পাকিস্তানি সংবাদমাধ্যম জিও নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে খাজা আসিফ বলেন, “পাকিস্তান অযৌক্তিক হামলার জেরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার রাজনৈতিক মূলধন হারিয়েছেন। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর তীব্র সমালোচনার কারণে বর্তমানে তিনি নিজের দেশের রাজনীতিতে কোনঠাসা অবস্থায় আছেন এবং নিজের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করতে তিনি এখন মরিয়া।”

“ফলে এই অবস্থায় তিনি ফের পাকিস্তানে হামলার নির্দেশ দেবেন এমন আশঙ্কা যথেষ্ট পরিমাণে আছে। তবে ভারত যদি কোনো প্রকার বেপরোয়া পদক্ষেপ নেয়, সেক্ষেত্রে পাকিস্তান তার দৃঢ় জবাব দেবে এবং শুধু তা ই নয় বৈশ্বিক চাপও সহ্য করতে হবে ভারতকে।”

“এখানে আর একটি কথা আমি বলব যুদ্ধবিরতির জন্য পাকিস্তানের ওপর কোনো বৈশ্বিক চাপ কাজ করেনি। যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য মিত্ররাষ্ট্র এই প্রস্তাব দিয়েছে, সমর্থন করেছে এবং এ কারণেই আমরা যুদ্ধবিরতিতে রাজি হয়েছি।” “এখন ভারতের মিত্রদের উচিত হবে, মোদিকে যে কোনো প্রকার বেপরোয়া সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত রাখা।” গত ২২ এপ্রিল ভারতের জম্মু-কাশ্মির রাজ্যের অনন্তনাগ জেলার পেহেলগামের বৈসরন উপত্যকায় হামলা চালিয়ে ২৬ জন পর্যটককে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল দিয়ে হত্যা করে একদল সন্ত্রাসী। নিহত এই পর্যটকদের সবাই পুরুষ এবং অধিকাংশই হিন্দু ধর্মাবলম্বী। এ ঘটনার কয়েক ঘণ্টা পর দায় স্বীকার করে বিবৃতি দেয় দ্য রেজিস্ট্যান্স ফ্রন্ট (টিআরএফ) নামের একটি সন্ত্রাসী গোষ্ঠী। প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত কাশ্মিরভিত্তিক জঙ্গিগোষ্ঠী লস্কর-ই তৈয়বার একটি শাখা এই টিআরএফ। অতর্কিত এই হামলার পর তাৎক্ষণিকভাবে সিন্ধু নদের পানি বণ্টনচুক্তি ও পাকিস্তানি নাগরিকদের ভিসা বাতিলসহ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে কয়েকটি কূটনৈতিক পদক্ষেপ নেয় ভারত। জবাবে ভারতের জন্য আকাশসীমা বন্ধ, ভিসা বাতিলসহ কয়েকটি পাল্টা পদক্ষেপ নেয় পাকিস্তানও।

দুই দেশের মধ্যে চলমান এই উত্তেজনার মধ্যেই গত মঙ্গলবার পাকিস্তানের অধিকৃত কাশ্মিরসহ বিভিন্ন এলাকায় ‘অপারেশন সিঁদুর’ নামে এক সংক্ষিপ্ত সেনা অভিযান পরিচালনা করে ভারতের প্রতিরক্ষা বাহিনী। নয়াদিল্লির তথ্য অনুযায়ী, এ অভিযানে ৭০ জন পাকিস্তানি সন্ত্রাসী নিহত হয়েছে। তবে পাকিস্তানের দাবি, নিহত হয়েছে ৩১ জন এবং আহত হয়েছে ৫৭ জন। ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর ‘অপারেশন সিঁদুর’-এর তিন দিনের মধ্যে ‘অপারেশন বুনইয়ানুম মারসুস’ শুরু করে পাকিস্তান। আরবি ‘বুনিয়ানি উল মারসুস’-এর বাংলা অর্থ সীসার প্রাচীর। এদিকে পাল্টাপাল্টি এই সংঘাতের মধ্যেই তৎপর হয় যুক্তরাষ্ট্র এবং মার্কিন কর্মকর্তাদের চাপে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হয় নয়াদিল্লি ও ইসলামাবাদ। ১০ মে শনিবার থেকে কার্যকর হয়েছে এই যুদ্ধবিরতি।

যুদ্ধবিরতির ২ দিন পর সোমবার জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। টেলিভিশনে সম্প্রচারিত সেই ভাষণে পাকিস্তানের প্রতি কঠোর বার্তা দিয়ে মোদি বলেন, ভারত শুধু তার অভিযান স্থগিত রেখেছে। যদি এর সুযোগ নিয়ে পাকিস্তান সীমান্তে কোনো প্রকার উসকানিমূলক তৎপরতা চালায়, তাহলে ফের অভিযান শুরু করবে ভারত।