দ্য গার্ডিয়ান : গাজায় মানবসৃষ্ট দুর্ভিক্ষ চললেও কিছু কিছু এলাকায় বিতরণ করা হচ্ছে রান্না করা খাবার। তা সংগ্রহ করা অভুক্ত ফিলিস্তিনিদের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। অনেকে বিতরণস্থল পর্যন্ত পৌঁছাতেও পারেন না। যারা পারেন, তারা ভাগ্যবান। গত শনিবার গাজার এক শহরে খাবার সংগ্রহের মরিয়া চেষ্টা আমার রান্না করার মতো কিছুই নেই। কাঠ কেনার টাকা নেই। ক্ষুধা নিবারণে সকালে ও রাতে সামান্য খাবার জোটে। কিছু মসলামিশ্রিত পানি, রুটির সঙ্গে শুধু লবণ। শাকসবজি নেই, রান্না করে কিছু খাই না অনেক দিন।
কথাগুলো বলছিলেন গাজা সিটির তুফাহপাড়া থেকে বাস্তুচ্যুত হওয়া ৫৫ বছর বয়সী সাবাহ আনতাইজ। তিনি নিজেও উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত। আনতাইজ বলেন, তাঁর ৬০ বছর বয়সী স্বামী খুবই অসুস্থ। কাজ করতে বা খাবার সংগ্রহ করতে পারেন না। আমাকে সাহায্য করারও কেউ নেই। ইসরায়েলের বিমান হামলায় আমি পরিবারের ১০ সদস্যকেই হারিয়েছি।
গত শনিবার দ্য গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে গাজায় এক ভুক্তভোগীর কণ্ঠে পরিস্থিতির মর্মান্তিক বর্ণনা উঠে এসেছে। কার্যত গাজা এখন ধ্বংসস্তূপ। খাবারের অভাবে অঞ্চলটিতে এখন পুরো মাত্রায় দুর্ভিক্ষ চলছে বলে ঘোষণা দিয়েছে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা ও অপুষ্টির তদারকি প্রতিষ্ঠান ইন্টিগ্রেটেড ফুড সিকিউরিটি ফেজ ক্লাসিফিকেশন (আইপিসি)। ঘোষণায় বলা হয়েছে, ফিলিস্তিনের একসময়ের ব্যস্ত বাণিজ্যিক ও প্রশাসনিক কেন্দ্র গাজা খাদ্যাভাবে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি সৃষ্টির তিনটি মূল সীমা পূরণ করে ফেলেছে। এ দুর্ভিক্ষ সম্পূর্ণরূপে মানবসৃষ্ট। আইপিসি বলেছে, গাজায় যদি যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়িত না হয় এবং প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ পুনরুদ্ধার না করা হয়, তাহলে মৃত্যুর সংখ্যা ব্যাপক বেড়ে যাবে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর গাজায় হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গত মার্চ ও এপ্রিল মাসে গাজায় খাদ্য প্রবেশ সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় দখলদার বাহিনী। সাম্প্রতিক সপ্তাহগুলোতে কিছু বেশি সংখ্যক গাজায় ত্রাণের ট্রাক পৌঁছালেও প্রয়োজনের তুলনায় তা খুবই নগণ্য।
গাজার ৫০ বছর বয়সী ইবতিসাম সালেহ ২০ বার বাস্তুচ্যুত হয়েছেন। তিনি এখন একটি তাঁবুতে থাকেন। তিনি বলেন, ‘খাবার পাওয়ার জন্য লাইনে দাঁড়ানোর শক্তিও আমার নেই। প্রায়ই জ্ঞান হারিয়ে ফেলি।’ আইপিসির প্রতিবেদনে তিনটি সূচকের মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ প্রমাণিত হয়েছে। সূচকগুলো হলো– অনাহার, অপুষ্টি ও মৃত্যুর হার। প্রতি পাঁচ পরিবারের মধ্যে কমপক্ষে একজন চরম খাদ্য ঘাটতির মুখে। প্রায় তিন শিশুর মধ্যে একজন তীব্র অপুষ্টিতে ভুগছে। এ ছাড়া প্রতি ১০ হাজারে ক্ষুধায় দুজনের মৃত্যুর তথ্য মিলেছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা আরও বেশি। কারণ, এ ব্যাপারে কার্যকর পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা নেই। কারণ, বেশির ভাগ অ-আঘাতজনিত মৃত্যুর হিসাব সংরক্ষণ হচ্ছে না। ওই তিনটি সীমা পূরণ হলেই কেবল আইপিসি সেই এলাকায় দুর্ভিক্ষ অবস্থা জারি করে। ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বারবার গাজায় দুর্ভিক্ষের কথা অস্বীকার করে আসছেন। তাঁর বক্তব্য, গাজায় ক্ষুধার পাশাপাশি ত্রাণ সংস্থাগুলো খাদ্য দিচ্ছে।
দুর্ভিক্ষ সম্পূর্ণরূপে মনুষ্যসৃষ্ট: কয়েক সপ্তাহ ধরে বিশ্বজুড়ে ক্ষুধার্ত শিশুদের ছবি ছড়িয়ে পড়েছে। তাতে দেখা গেছে, না খেয়ে শিশুদের পেট ফুলে উঠেছে, হাড় বেরিয়ে গেছে। গাজায় প্রায় দুই বছরের যুদ্ধে ফিলিস্তিনিদের খাদ্য সরবরাহ প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ইসরায়েল দীর্ঘদিন ধরে পণ্য প্রবেশে বাধা দিচ্ছে। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এই বিধিনিষেধ আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে গত মার্চ থেকে ইসরায়েলের প্রায় তিন মাসের সর্বাত্মক অবরোধ গাজার পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি ঘটায়। সমালোচনার মুখে গাজা হিউম্যানিটেরিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) প্রতিষ্ঠা করা হয় খাদ্য সরবরাহের জন্য। কিন্তু এই ব্যবস্থাটি একটি মৃত্যুফাঁদ হিসেবে কার্যকর করা হয়। জাতিসংঘের ৪০০ বিতরণ কেন্দ্র বন্ধ করে দিয়ে মাত্র চারটি কেন্দ্র থেকে খাদ্য বিতরণ শুরু হয়। আর এই বিতরণ কেন্দ্র প্রতিনিয়ত চলছে ক্ষুধার্ত মানুষ হত্যা। খাবার আনতে গিয়ে এ পর্যন্ত এক হাজার ৭৬০ ত্রাণপ্রত্যাশীকে হত্যা করা হয়েছে।
ইসরায়েলের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ বাড়ায় জুলাইয়ের শেষ দিকে তারা প্রতিদিন কিছু বেশি ট্রাক গাজায় প্রবেশের অনুমতি দিতে শুরু করে। তবে এ ক্ষেত্রে ত্রাণ সরবরাহে ‘কৌশলগত বিরতি’ পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তোলে। এক কেজি আটার দাম ৮৫ ডলারেও বেশি উঠে যায়। ত্রাণ সংস্থাগুলো বলছে, প্রতিদিন যেখানে ৬০০ ত্রাণবাহী ট্রাক গাজার জন্য প্রয়োজন, সেখানে অর্ধেকের কম সংখ্যক ট্রাক অনুমতি দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া আকাশপথে ত্রাণের অনুমতি মিললেও অব্যবস্থাপনার কারণে খাদ্য সংগ্রহ বাসিন্দাদের জন্য আতঙ্কজনক হয়ে উঠেছে।
বিশ্বব্যাপীপ্রতিক্রিয়া : ইসরায়েলি সরকারের বেশ কিছু কর্মকর্তা শনিবার আইপিসির প্রতিবেদন প্রত্যাখ্যান করেছেন। ইসরায়েলের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আইপিসির প্রতিবেদনটিকে ‘হামাসের ভুয়া প্রচারণার সঙ্গে মানানসই করে তৈরি বানোয়াট প্রতিবেদন’ বলে অভিযোগ করেছে। ইসরায়েলি সামরিক সংস্থা কোগাটের দাবি, হামাসের দেওয়া আংশিক তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মিথ্যা এবং পক্ষপাতদুষ্ট প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে আইপিসি। ইসরায়েলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, দুর্ভিক্ষের বৈশ্বিক মান আইপিসি নিজেই পরিবর্তন করেছে। তবে আইপিসি এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করেছে।
জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেন, দখলদার শক্তি হিসেবে ইসরায়েলের উচিত আন্তর্জাতিক আইনের অধীনে থাকা। জনগণের খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহ নিশ্চিত করা তাদের দায়িত্ব। আমরা এ পরিস্থিতি অব্যাহত রাখতে দিতে পারি না। জাতিসংঘের মানবিক প্রধান টম ফ্লেচার বলেছেন, গাজায় খাদ্য প্রবেশে ইসরায়েলের পরিকল্পিত বাধাদানেই দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়েছে। যুক্তরাজ্যের পররাষ্ট্র সচিব ডেভিড ল্যামি বলেছেন, মানবসৃষ্ট বিপর্যয় ডেকে আনা একটি অত্যাচার। জাতিসংঘের মানবাধিকারপ্রধান ভলকার তুর্ক বলেন, অনাহারকে যুদ্ধের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা যুদ্ধাপরাধ।
দুর্ভিক্ষ ঘোষণা দেরি হয়ে গেছে : ইউনিসেফ : আনুষ্ঠানিকভাবে দুর্ভিক্ষ ঘোষণা ইতোমধ্যেই অনেক দেরি হয়ে গেছে বলে জানিয়েছে ইউনিসেফ। কারণ, এখন এখানে শিশুদের বেঁচে থাকার কোনো পরিবেশ নেই। এ পর্যন্ত গাজায় অপুষ্টিতে মৃত্যু বেড়ে ২৭৩ জনে দাঁড়িয়েছে, যার মধ্যে শিশু ১১২ জন। গত ২৪ ঘণ্টায় হামলায় আট ত্রাণপ্রত্যাশীসহ কমপক্ষে ৭১ জন নিহত হয়েছেন। ইসরায়েলি হামলায় এ পর্যন্ত কমপক্ষে ৬২ হাজার ৬২২ জন নিহত ও এক লাখ ৫৭ হাজার ৬৭৩ জন আহত হয়েছেন। ৩ লাখ ৩২ হাজার শিশু অপুষ্টিতে ভুগছে।