আল-জাজিরা : গভীর রাত। প্রায় ২টা। একেবারে নিস্তব্ধ গাজা সিটির আসাহাবা মেডিকেল কমপ্লেক্সের প্রসূতি ও গাইনোকোলজি জরুরি বিভাগ। খোলা জানালা দিয়ে আসছে ঠাণ্ডা বাতাস। থেমে থেমেই ফাঁকা করিডরগুলোকে আলোকিত করছে ক্ষীণ নীল আলো। ক্ষণে ক্ষণে গর্জে উঠছে ইসরাইলি ড্রোন। এরই মধ্যে হঠাৎ শোনা যায় এক নারীর গলা ফাটা চিৎকার। চোখ বেয়ে নামছে বেদনার অশ্রু। শরীরে রক্তক্ষরণ, কষ্টে বারবার আঁতকে উঠছে সে। পরীক্ষা করতেই জানা গেল, তার গর্ভের ১০ সপ্তাহের শিশুটি আর নেই। একই দিন ভোর ৬টা। জাবালিয়া শিবিরের এক মায়ের কোলজুড়ে জন্ম নেয় একটি মেয়ে শিশু। যেন জীবন আর মৃত্যু-দুই-ই চলছে সামন তালে। হামলার আতঙ্কের মধ্যে পুরো রাত পার করার পর হাসপাতালে আসেন এই মা ও তার পরিবার। যদিও গাজার কোথাও আর নিরাপদ নয়।
আসাহাবা হাসপাতালে ইন্টার্নশিপ করছেন নাদা আলমাধুন। এক বছরের ইন্টার্নশিপের ইতোমধ্যেই ছয় মাস পেরিয়ে গেছে। এরই মধ্যে গাইনোকোলজিস্ট হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। নাদা বলেছেন, ‘সাধারণত আমাকে অন্য বিভাগেও কাজ করতে হয়। প্রতি বিভাগে দুই মাস করে। কিন্তু আমি ইতোমধ্যেই সিদ্ধান্ত নিয়েছি গাইনোকোলজিস্ট হব। এই বিভাগে আমি আন্দদের সঙ্গে কাজ করতে চাই। এখানে জীবন শুরু হয়, যা আমাকে শেখায় কিভাবে কঠিন সময়েও আশা বাঁচিয়ে রাখতে হয়।’ তিনি আরও বলেছেন, ‘গাজায় জন্ম, বোমাবর্ষণ, ক্ষুধা ও আতঙ্ক একসঙ্গে বিরাজ করে। জীবন ও মৃত্যু এখানে একই সুতোয় গাঁথা। তবুও মায়েরা তাদের সন্তানকে এই অনিশ্চিত পৃথিবীতে নিয়ে আসার স্বপ্ন দেখেন। তারা লড়াই করেন। এসব আমাকে বিস্মিত করে।’ সন্তান জন্ম দেওয়া মোটেই সহজ নয়। শারীরিক ও মানসিকভাবে এটি ক্লান্তিকর। গাজার মায়েরা সব ব্যথা সহ্য করেন। কোনো ব্যথানাশকও পান না তারা। গত মার্চ মাস থেকে হাসপাতালে ব্যথানাশক অথবা অন্য কোনো চিকিৎসা সরঞ্জাম নেই বললেই চলে। ফলে চিকিৎসা করা খুবই কঠিন হয়ে পড়েছে। এদিকে ক্ষুধার কারণেও অনেক গর্ভবতী নারী ক্লান্ত হয়ে পড়েন। ঠিকমতো ওজন বাড়াতে পারে না তারা। ফলে ভয়াবহ ঝুঁকিতে পড়ে তাদের জীবন। অপুষ্টিতে ভোগার কারণে অনেক সময় প্রসব দীর্ঘায়িত হয় এবং মায়েদের জন্য যন্ত্রণাও বেড়ে যায়। এতে নবজাতকের জীবনও ঝুঁকিতে পড়ে। নাদা বলেছেন, আমরা বোমায় না মরলেও ক্ষুধায় মরব। দিন দিন এ ভয়াবহতা আরও প্রকট হচ্ছে। কিন্তু সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হলো গাজার মানুষের সহিষ্ণুতা এবং ধৈর্য। তারা বিশ্বাস করে তাদের সন্তানরা একদিন একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করবে। যত প্রাণ হরণ করা হোক না কেন, তারা নিজেদের অস্তিত্বের বিরুদ্ধে লড়াই করবে। গাজাকে কখনো মুছে ফেলা যাবে না। নাদা জানিয়েছেন, এক শিফটে, এক গর্ভবতী নারী আসেন চেকআপের জন্য। আমি আলট্রাসাউন্ডের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তার দিকে ঘুরে মজা করে জিজ্ঞেস করলাম, ‘তুমি ছেলে চাও নাকি মেয়ে?’ সে বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে বলল, ‘ছেলে।’ আমি তার এ দৃঢ়তা দেখে অবাক হয়ে পেছনে গিয়ে তার মায়ের কাছ থেকে জানতে পারলাম, ‘সে মেয়ে চায় না। কারণ সে ভয় পায় যে তার বড় বোনের মতো সে মেয়েটিকেও হারিয়ে ফেলবে।’ নাদা বলেছেন, ‘গাজায় প্রতিটি মুহূর্তই এখন বেদনার। খুশির সময়ও ট্র্যাজেডি লুকিয়ে থাকে। নিরাপত্তা আমাদের থেকে বহু দূরে।’