ইন্টারনেট: ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে পাকিস্তান ও ইরান সীমান্তে একে অপরের ভূখ-ে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে সামরিক উত্তেজনার সূচনা করেছিল। যদিও দুই দেশ পরবর্তীতে সম্পর্ক মেরামত করে, ১৭ মাস পর ইরানের পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরাইলি হামলা এবং ইরানের জেনারেল ও পারমাণবিক বিজ্ঞানীদের হত্যার ঘটনায় পাকিস্তান কড়া ভাষায় নিন্দা জানিয়েছে। ইসরাইলের হামলাকে ‘ভূখ-ের সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন’ ও ‘উস্কানিমূলক আচরণ’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে পাকিস্তান বলেছে, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় ও জাতিসংঘের দায়িত্ব হলো আন্তর্জাতিক আইন রক্ষা করা, এই আগ্রাসন থামানো এবং দোষীকে জবাবদিহির আওতায় আনা।’ ইরান-ইসরাইল সংঘর্ষ ছয় দিনে গড়িয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের উদ্বেগের পেছনে রয়েছে তেহরানের সঙ্গে জটিল সম্পর্ক, বেলুচিস্তানে নিরাপত্তা আশঙ্কা এবং ইসরাইলি বিমানবাহিনীর প্রভাব পাকিস্তান সীমান্তে ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা।
তাৎক্ষণিক প্রভাব: ইসরাইলি হামলায় ইরানে ২২০ জনের বেশি নিহত হয়েছে, আহত হয়েছে এক হাজারেরও বেশি। ইরানের পাল্টা হামলায় ইসরাইলে ২০ জনের বেশি নিহত হয়েছে। পাকিস্তান ইতোমধ্যে ১৫ জুন থেকে বেলুচিস্তানের পাঁচটি সীমান্ত ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছে। ইরান থেকে ইতোমধ্যে ৫০০-র বেশি পাকিস্তানি নাগরিক, বিশেষ করে তীর্থযাত্রী ও শিক্ষার্থী, দেশে ফিরে এসেছেন। তাফতান সীমান্ত শহরের সহকারী কমিশনার নাইম আহমেদ জানান, ‘ গত সোমবার আমরা ইরানে পড়াশোনা করা ৪৫ জন শিক্ষার্থীকে ফেরত এনেছি, এর আগেও প্রায় ৫০০ তীর্থযাত্রী দেশে ফিরেছেন।’ তাফতান চাগাই জেলার একটি সীমান্ত শহর। এখানেই ১৯৯৮ সালে পাকিস্তান পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। এখানেই রয়েছে রেকো ডিক ও সাঈদাক খনি।
দ্বন্দ্বপূর্ণ সম্পর্কের ইতিহাস: ইরান ও পাকিস্তান একে অপরের বিরুদ্ধে সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোকে আশ্রয় দেওয়ার অভিযোগ তোলে। জানুয়ারিতে ইরান জইশ আল-আদলকে লক্ষ্য করে পাকিস্তানের বেলুচিস্তানে ক্ষেপণাস্ত্র ছোঁড়ে। এর পাল্টা জবাবে পাকিস্তান ইরানে বেলুচ বিদ্রোহীদের অবস্থানে হামলা চালায়। পরবর্তীতে উত্তেজনা প্রশমিত হলেও বর্তমানে ইসরাইল-ইরান সংঘর্ষে পাকিস্তান আবার আলোচনায় এসেছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইসহাক দার সংসদে জানান, ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি তাকে বলেছেন, ‘ইসরাইল যদি আর হামলা না চালায়, তবে তারা আলোচনায় ফিরতে প্রস্তুত।’ পাকিস্তান অন্যান্য দেশকেও এ বার্তা দিয়েছে।
বেলুচিস্তান: প্রধান নিরাপত্তা উদ্বেগ: বিশ্লেষকদের মতে, পাকিস্তানের প্রধান উদ্বেগ বেলুচিস্তানে যুদ্ধের প্রভাব। খনিজসমৃদ্ধ এই প্রদেশে একাধিক বিদ্রোহ ঘটেছে। এখানে অবস্থিত গওয়াদর বন্দর, চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডরের (সিপিইসি) মূল কেন্দ্র। বেলুচ বিচ্ছিন্নতাবাদী গোষ্ঠী যেমন বিএলএ ও বিএলএফ দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানে স্বাধীনতার জন্য লড়ছে। এদের অনেকে ইরান সীমান্তে অবস্থান করে। সিঙ্গাপুরভিত্তিক বিশ্লেষক আব্দুল বাসিত বলেন, ‘যুদ্ধে উত্তেজনা বাড়লে এই গোষ্ঠীর সদস্যরা পাকিস্তানে ঢুকে পড়তে পারে—এমন আশঙ্কাতেই সীমান্ত বন্ধের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’ আফগান শরণার্থীদের মতো পরিস্থিতি এড়াতে চায় ইসলামাবাদ: সোভিয়েত আফগান যুদ্ধ থেকে শুরু করে ২০২১ সালে তালেবান ক্ষমতায় আসার পর পর্যন্ত পাকিস্তানে লাখ লাখ আফগান শরণার্থী আশ্রয় নেয়। ২০২৩ সাল থেকে পাকিস্তান প্রায় ১০ লাখ শরণার্থী ফেরত পাঠিয়েছে। বিশ্লেষকদের মতে, ইরান সীমান্তেও যদি একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে পাকিস্তানে শরণার্থী সংকট দেখা দিতে পারে—যা ইসলামাবাদ এড়াতে চায়।
ইসরাইলি বিমান ক্ষমতা নিয়ে শঙ্কা: ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহু দাবি করেছেন, ইসরাইল তেহরানের আকাশ নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে। পাকিস্তান ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেয় না, তাই চাইবে না এই প্রভাব সীমান্ত ঘেঁষে পৌঁছে যাক। বিশ্লেষক উমের কারিম বলেন, ‘পাকিস্তান চায় না ইসরাইল সম্পূর্ণ বিমান আধিপত্য অর্জন করুক, কারণ এতে তাদের পশ্চিম সীমান্তে নিরাপত্তা ভারসাম্য নষ্ট হবে।’