এক্স,বিবিসি, জিও নিউজ, আল জাজিরা: রাতভর আফগানিস্তান সীমান্তে ব্যাপক সংঘর্ষের পর হতাহতের সংখ্যা প্রকাশ করেছে পাকিস্তান। দেশটি জানিয়েছে, তাদের সেনাদের হামলায় আফগান তালেবানের ২০০ জনের বেশি সৈন্য ও অন্যান্য যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। এছাড়া আফগানদের হামলায় নিজেদের ২৩ সৈন্য নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে দেশটির সেনাবাহিনী। গত শনিবার রাতে ভয়াবহ রক্তক্ষয়ী এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। গতকাল রোববার পাক সেনাবাহিনীর মিডিং উইং বলেছে, “আফগানিস্তান সীমান্তে রাতভর সংঘর্ষে আমাদের ২৩ সেনা নিহত ২৯ জন আহত হয়েছেন।” সকালে তালেবান সরকারের মুখপাত্র জাবিহুল্লাহ মুজাহিদ দাবি করেছিলেন, তাদের হামলায় ৫৮ পাক সেনা নিহত হয়েছেন। আর নিজেদের ৯ সেনা প্রাণ হারান বলে জানান তিনি।
তবে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী দাবি করেছে, তাদের হামলায় দুই শতাধিক আফগান যোদ্ধা নিহত হয়েছেন। তারা বলেছে, “বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য অনুযায়ী এবং ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ করে দেখা গেছে, রাতের হামলায় তালেবান ও অন্যান্য ২০০ জনের বেশি যোদ্ধা নিহত হয়েছে।” এছাড়া তালেবান সেনাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে দাবি করে পাক সেনাবাহিনী বলেছে, “তালেবানের অবকাঠামো, সেনা পোস্ট, ক্যাম্প, হেডকোয়ার্টার এবং সন্ত্রাসীদের সাপোর্ট নেটওয়ার্কের ক্ষয়ক্ষতি ছিল ব্যাপক। যার সবই হয়েছে সীমান্ত ও কৌশলগত অঞ্চলে।”
আফগানিস্তান-পাকিস্তানকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান সৌদি-কাতারের : রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের পর দুই দেশকে সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানিয়েছে সৌদি আরব ও কাতার। এ নিয়ে সৌদি আরব বলেছে, “পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকায় চলমান উত্তেজনা ও সংঘর্ষের ঘটনা গভীর উদ্বেগের সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছে সৌদি আরব। আমরা উভয় পক্ষকে সর্বোচ্চ সংযম প্রদর্শন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এবং আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের পথ খুঁজে বের করার অনুরোধ জানাই। সৌদি মনে করে, এতে এই অঞ্চলের নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতা বজায় থাকবে এবং উত্তেজনা প্রশমিত হবে।”
দেশটি আরও বলেছে, “শান্তি ও স্থিতিশীলতার আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক সব প্রচেষ্টাকে সমর্থন জানায় সৌদি আরব। ভাতৃপ্রতীম দেশ আাফগানিস্তান ও পাকিস্তানের নিরাপত্তা এমন পথে হোক যেটি শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করবে, সেটিতে সৌদির অব্যাহত সমর্থন থাকবে। অপরদিকে কাতার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলেছে, উভয়পক্ষকে আমরা আলোচনা, কূটনীতি এবং সংযম প্রদর্শনের আহ্বান জানাচ্ছি। এছাড়া এমন পথে দ্বন্দ্ব নিরসন করুন যেটি উত্তেজনা প্রশমন এবং আঞ্চলিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে।
সৌদির মতো কাতারও পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে ভাতৃপ্রতীম দেশ হিসেবে অভিহিত করেছে। স্থায়ী শান্তি আনার ক্ষেত্রে কাতার অবদান রাখতে প্রস্তুত আছে বলেও জানিয়েছে দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। এর আগে, পাকিস্তান গত বৃহস্পতিবার আফগান আকাশসীমা লঙ্ঘন করে, তাদের সীমান্তের ভেতরে একটি বাজারে বোমা হামলা চালিয়েছে বলে দাবি করে তালেবান সরকার। পরে নিজেদের হামলাকে তারা ‘প্রতিশোধমূলক অভিযান’ বলে অভিহিত করেছে। পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মহসিন নাকভি বলেছেন, আফগান হামলাগুলো ‘বিনা উস্কানিতে’ করা হয়েছিল এবং বেসামরিক নাগরিকদের উপর গুলি চালানো হয়েছিল। নাকভী সতর্ক করেছিলেন যে, তার দেশের বাহিনী ‘প্রতিটি ইটের বিনিময়ে একটি পাথর’ দিয়ে পাল্টা জবাব দেবে। ইসলামাবাদ অভিযোগ করেছে, কাবুল তার মাটিতে পাকিস্তানকে লক্ষ্য করে সন্ত্রাসীদের আশ্রয় দিচ্ছে। যদিও এই দাবি প্রত্যাখ্যান করেছে তালেবান সরকার।
আফগান ও পাকিস্তান উভয় পক্ষই কুনার-কুররাম অঞ্চলে ছোট অস্ত্র ও কামান ব্যবহার করেছে বলে বিবিসি জানতে পেরেছে। তালেবানদের হামলার ‘তীব্র নিন্দা’ জানিয়ে নাকভি বলেন, বেসামরিক জনগোষ্ঠীর ওপর আফগান বাহিনীর গুলিবর্ষণ আন্তর্জাতিক আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এক্স এ এক পোস্টে পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাকভি বলেছেন, আফগানিস্তান আগুন ও রক্তের খেলা খেলছে। পাকিস্তানের মানুষের জীবন ও সম্পত্তি রক্ষার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন, পাকিস্তানের একজন সামরিক মুখপাত্র। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও কোনো মন্তব্য করেনি। তবে সেখানকার একটি নিরাপত্তা সূত্র বিবিসির কাছে দাবি করেছে, পাকিস্তান-আফগানিস্তান সীমান্তের বেশ কয়েকটি স্থানে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে। এসব স্থানের মধ্যে রয়েছে আঙ্গুর আড্ডা, বাজাউর, কুররাম, দির, চিত্রল এবং বারামচা।
কুররাম জেলার জিরো পয়েন্টে কর্মরত একজন পুলিশ কর্মকর্তা বিবিসিকে জানিয়েছেন, স্থানীয় সময় রাত বারোটা নাগাদ আফগানিস্তানের দিক থেকে ভারী অস্ত্রের মাধ্যমে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। সীমান্তের একাধিক স্থান থেকে ব্যাপক গোলাগুলির খবর পাওয়ার কথা জানিয়েছেন তারা।
এদিকে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের সীমান্তে উত্তেজনা তীব্র হয়ে উঠেছে। আফগান বাহিনীর গুলিবর্ষণের পর পাল্টা হামলায় পাকিস্তানি সেনারা আফগানিস্তানের ভেতরে একাধিক সীমান্ত পোস্ট ধ্বংস করে ১৯টি পোস্ট দখল করেছে বলে দাবি করেছে ইসলামাবাদ। এতে বিপুলসংখ্যক আফগান সেনা ও জঙ্গি নিহত হয়েছে বলে দাবি করেছে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনী। এর আগে আফগানিস্তান দাবি করেছিল, তাদের হামলায় পাকিস্তানের অন্তত ৫৮ সেনা নিহত হয়েছে।
রবিবার জিও নিউজকে গোয়েন্দা সূত্র জানায়, গত শনিবার গভীর রাতে আঙ্গুর আড্ডা, বাজৌর, কুররম, দির, চিত্রাল ও বারামচাসহ একাধিক সীমান্তপথে আফগান বাহিনী বিনা উসকানিতে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এসব হামলার লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করা সশস্ত্র খারেজি গোষ্ঠীগুলোকে সহায়তা করা। সূত্রগুলো জানায়, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সীমান্ত চৌকিগুলো তাৎক্ষণিকভাবে পাল্টা হামলা চালায়। কামান, ট্যাংক, ড্রোন ও বিমান সহায়তায় পরিচালিত ওই হামলায় দোরান মেলা, তুর্কমানজাই ও শাহিদানসহ বহু আফগান পোস্ট গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়। কুররম, জানদোসার ও নওশকির ঘজনালি ঘাঁটি পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। পাকিস্তানি বাহিনী আঙ্গুর আড্ডার এক আফগান পোস্টে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেছে বলেও সূত্রটি জানিয়েছে। খারলাচি, কুনার ও চাঘাই এলাকায় পরিচালিত অভিযানে এক ডজনের বেশি তালেবান ও খারেজি যোদ্ধা নিহত হয়।
আফগান ‘আগ্রাসনের’ নিন্দা জানিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আসিফ আলী জারদারি বলেছেন, সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ একক কোনও দেশের নয়, বরং আঞ্চলিকভাবে এর দায়িত্ব ভাগাভাগি করতে হবে। তিনি বলেন, আমরা আফগানিস্তানের স্থিতিশীলতা ও সমৃদ্ধি কামনা করি। তবে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে কোনও আপস নয়। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ আফগান বাহিনীর হামলাকে ‘অগ্রহণযোগ্য’ মন্তব্য করে সেনাবাহিনীর ‘দৃঢ় ও কার্যকর’ জবাবের প্রশংসা করেছেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানের প্রতিরক্ষায় কোনও ছাড় দেওয়া হবে না। প্রতিটি উসকানির যথাযথ জবাব দেওয়া হবে। শাহবাজ আরও জানান, আফগান মাটিতে অবস্থান নেওয়া ফিতনা আল-খারেজি ও ফিতনা আল-হিন্দুস্তান নামের সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর বিষয়ে ইসলামাবাদ ইতোমধ্যে কাবুলকে তথ্য দিয়েছে। তালেবান প্রশাসনকে নিশ্চিত করতে হবে যে তাদের ভূমি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হবে না।
পাকিস্তানি গোয়েন্দা সূত্রগুলোর দাবির বরাতে জিও নিউজ লিখেছে, অভিযানে আফগান বাহিনীর মানোজাবা ব্যাটালিয়নের সদর দফতর ধ্বংস করা হয়েছে। ব্রাবচা অঞ্চলে দুররানি ক্যাম্প ১ ও ২ পুরোপুরি গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। সেখানে অন্তত ৫০ তালেবান যোদ্ধা নিহত হয়। ভিডিও ফুটেজে দেখা গেছে, পাকিস্তানি বাহিনী আফগান পোস্টে হামলা চালানোর সময় পোস্টগুলোতে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড ঘটে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর দাবি, এই অভিযান আফগান জনগণের বিরুদ্ধে নয়, বরং সীমান্তপারের সন্ত্রাসী ঘাঁটিগুলোর বিরুদ্ধে। বেসামরিক এলাকা বা সাধারণ নাগরিকদের লক্ষ্যবস্তু করা হয়নি।
পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহসিন নাকভি আফগান হামলাকে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন বলে উল্লেখ করেছেন। তিনি বলেন, আফগানিস্তান আমাদের শত্রু রাষ্ট্রের প্রভাবে বিপজ্জনক খেলায় নেমেছে। তবে পাকিস্তান আগুনের খেলায় জবাব দেবে আগুন দিয়েই। পাকিস্তানের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের উপজাতীয় নেতারা সেনাবাহিনীর প্রতি সংহতি জানিয়ে বলেছেন, আমরা বাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ব। যারা দেশের বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলবে, তাদের আর কোনও ছাড় দেওয়া হবে না।
ধর্মীয় নেতা মাওলানা তাহির আশরাফি এক ভিডিও বার্তায় আফগান সরকারের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছেন, পাকিস্তান কোনও পরাশক্তি নয়, কিন্তু আমাদের ধৈর্য সীমিত। আন্তঃসীমান্ত সন্ত্রাসবাদের অবসান না ঘটলে আরও কঠোর জবাব দেওয়া হবে। সীমান্তে সংঘর্ষের পর সৌদি আরব, ইরান ও কাতার পরিস্থিতি নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সৌদি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে পাকিস্তান ও আফগানিস্তানকে সংযম ও সংলাপের মাধ্যমে উত্তেজনা প্রশমনের আহ্বান জানিয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য উত্তেজনা কমানো অপরিহার্য। ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বকায়ি বলেন, দুই দেশের মধ্যে তাৎক্ষণিক সংলাপই এখন জরুরি। প্রয়োজনে তেহরান মধ্যস্থতা করতে প্রস্তুত। কাতারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ও একই আহ্বান জানিয়ে বলেছে, সীমান্ত সংঘাত পুরো অঞ্চলের শান্তিকে বিপন্ন করতে পারে। আফগানিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্বাভাবিক করছে ভারত তালেবান ক্ষমতায় ফেরার পর ২০২১ সাল থেকে পাকিস্তানে সীমান্তপারের হামলা ও সন্ত্রাসী তৎপরতা বেড়েছে। ইসলামাবাদ অভিযোগ করছে, আফগান ভূখণ্ড ব্যবহার করে তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) তাদের দেশে হামলা চালাচ্ছে।
জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের পর্যবেক্ষণ দলও সম্প্রতি প্রতিবেদনে জানিয়েছে, আফগান তালেবান প্রশাসন টিটিপিকে লজিস্টিক ও আর্থিক সহায়তা দিচ্ছে। পাকিস্তান চার দশকের বেশি সময় ধরে আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। তবে ২০২৩ সালের পর থেকে অননুমোদিত আফগানদের ফেরত পাঠানো শুরু করেছে ইসলামাবাদ। সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৫ সালের এপ্রিল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫ লাখ ৫৪ হাজার আফগানকে ফেরত পাঠানো হয়েছে।