ভৌগোলিক সীমা আর জাতিগত পার্থক্য থাকলেও ইরাকের কাকাই সম্প্রদায় ও সিরিয়ার দ্রুজ সংখ্যালঘুদের মধ্যে রয়েছে চমকপ্রদ মিল। এই দুটি সম্প্রদায় শুধু গোপনীয়তা ও পবিত্র ঐতিহ্য রক্ষায় নয়, বরং সাংস্কৃতিক প্রতিরোধের প্রতীক হয়ে উঠেছে—নিজ নিজ রীতিনীতির প্রতি অতুলনীয় আনুগত্যের মাধ্যমে।

উভয় গোষ্ঠীর সদস্যদের জন্য দীর্ঘগোঁফ শুধু সামাজিক শৈলী নয়, বরং এটি এক পবিত্র অঙ্গীকারের প্রতীক। এদের কেউ ধর্মান্তর গ্রহণ করে না, আবার বাইরের কাউকে ধর্মে প্রবেশ করতেও দেওয়া হয় না। ধর্মচর্চা হয় নীরব ও সীমানার ভেতরেই।

কাকাইরা নিজেদের ‘আহলে হক’ বা ‘সত্যের লোক’ হিসেবে পরিচয় দেয়। এদের বিশ্বাসে গোপনীয়তা শুধু আত্মরক্ষার কৌশল নয়, বরং তা ধর্মীয় নীতিরই অংশ। কাকাই প্রবীণ আখো শাওয়াইস কুর্দিশ ফাউন্ডেশন অব প্যারিস-কে বলেন, ‘আমাদের আচার সবসময়ই গোপন রাখা হয়… এসব আচার মানুষের জন্য নয়, বরং ঈশ্বরের জন্য।’

তার ভাষায়, ‘ধর্মীয় অনুষ্ঠান যত গোপন ও ব্যক্তিগত, তা ঈশ্বরের কাছে তত বেশি গ্রহণযোগ্য হয়।’ কাকাইরা মনে করে, এই গোপনতা আসলে ঈশ্বরের সঙ্গে আত্মিক সম্পর্ক গভীর করে।

সিরিয়ার দ্রুজ সম্প্রদায়ের মধ্যে এই গোপনতা একটি প্রতিষ্ঠিত প্রথা। এখানে শুধু একটি বিশেষ গোষ্ঠী উক্কাল বা জ্ঞানী শ্রেণিই ধর্মগ্রন্থ (আল-হিকমাহ আশ-শরিফাহ) পড়তে বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানে অংশ নিতে পারে। বাইরের কাউকে ধর্মে আনতে বা কারও ধর্ম পরিবর্তনও সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। এভাবে তারা ধর্মীয় পরিচয়ের কড়া সীমানা রক্ষা করে চলেছে।

উভয় সম্প্রদায়ই তাদের পবিত্র স্থানগুলোতে গভীর শ্রদ্ধা জানায়। কাকাইরা ইরাক ও ইরানে সুলতান ঈসহাকের মাজারে যায়, আর দ্রুজরা সিরিয়ার হাবিল নবির মাকাম কিংবা ফিলিস্তিনে নবী শুয়াইবের দরগায় যায়। এই তীর্থযাত্রাগুলো শুধু ধর্মীয় নয়, বরং সাংস্কৃতিক স্মৃতিচিহ্ন ও ভূমির সঙ্গে পরিচয়ের গভীর যোগসূত্র।

কাকাইদের মতে, গোঁফ রাখার বিষয়টি ধর্মীয় শপথের প্রতীক। কাকাই গবেষক খুরশিদ আল-কাকাই বলেন, এই লম্বা গোঁফ কেবল একটি সামাজিক রীতি নয়, এটি একটি আত্মিক প্রতিশ্রুতি, যা ব্যক্তিকে তার বিশ্বাস ও সম্প্রদায়ের সঙ্গে যুক্ত রাখে।

এ বিশ্বাস সিরিয়ার দ্রুজদের মধ্যেও প্রতিধ্বনিত হয়। অতীতে গোঁফ ছিল জ্ঞান, শৃঙ্খলা ও আধ্যাত্মিক পরিপক্বতার প্রতীক। যদিও বর্তমানে তা কিছুটা শিথিল, তবুও এটি এখনও এক গুরুত্বপূর্ণ সাংস্কৃতিক পরিচায়ক, বিশেষ করে বয়োজ্যেষ্ঠ ও ধর্মীয় নেতাদের মধ্যে।

সম্প্রতি সুয়ায়দা অঞ্চলে সংঘর্ষের সময় কিছু দ্রুজ পুরুষের জোর করে গোঁফ কেটে ফেলার ঘটনা ঘটলে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানান ইরাকের কাকাই নেতা আব্বাস আল-কাকাই। তিনি বলেন, গোঁফ কাটার ঘটনা একটি জাতিসত্তাকে অপমান করার শামিল। এটি শুধু সহিংসতা নয়, বরং প্রতীকীভাবে পুরো পরিচয় মুছে দেওয়ার চেষ্টা।

কাকাই ও দ্রুজ সম্প্রদায়ের মধ্যে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ মিল হলো—আত্মরক্ষা ও পরিচয় ধরে রাখার লক্ষ্যে নিজেদের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক চর্চাকে গোপন রাখার প্রবণতা। ইরাকের হালাবজার কেল্লা পাহাড় বা সিরিয়ার জাবাল আদ-দ্রুজ—সব জায়গায়ই তারা টিকে থাকার লড়াইয়ে আত্মনিয়ন্ত্রণকেই বেছে নিয়েছে।

তারা ধর্ম প্রচার বা প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে না, বরং চায়—তাদের নিজস্ব ঐতিহ্য ও পরিচয়কে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দিয়ে বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ দেওয়া হোক।

একটি বিভাজিত অঞ্চলে এই দুই সংখ্যালঘু গোষ্ঠী দেখিয়ে দিয়েছে, শক্তি নয়—বিশ্বাসের প্রতি নিরব আনুগত্যও হতে পারে একটি জাতির আত্মার সংরক্ষণ। তাদের গল্প শুধু বেঁচে থাকার নয়, বরং চুপচাপ রুখে দাঁড়ানোর গল্প।