রয়টার্স, ফোর্বস: নিত্যদিনের ব্যস্ততা আর একঘেয়েমি থেকে মুক্তি পেতে, নিজেকে একটু চাঙা করে তুলতে ভ্রমণের চেয়ে ভালো আর কী হতে পারে! ভ্রমণ শুধু মনকে প্রফুল্ল করে তোলে না, বরং জ্ঞানের ভান্ডারও সমৃদ্ধ করে। মানুষ ভ্রমণের জন্য ছুটে যায় সমুদ্রের ধারে, পর্বতের কোলে কিংবা ঘুরে বেড়ায় কোনো ঐতিহাসিক শহরের অলিগলিতে।

সারা বিশ্বে পর্যটকেরা নানা দেশ ভ্রমণে কী পরিমাণ অর্থ ব্যয় করেন, সে–সংক্রান্ত তথ্য প্রকাশ করে বিশ্ব পর্যটন সংস্থা। পর্যটন খাতের ওপর একটি দেশের নির্ভরশীলতা নির্ধারণ করা হয়—বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে পাওয়া রাজস্ব ও দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) অনুপাত হিসাব করে। ফোর্বস সাময়িকীর প্রতিবেদন অনুযায়ী, অর্থনৈতিকভাবে পর্যটনের ওপর সবচেয়ে বেশি নির্ভরশীল ১০ দেশ সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

মালদ্বীপ: ভারত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র মালদ্বীপ। সারা বিশ্বের পর্যটকদের কাছে দারুণ জনপ্রিয় এই দেশ। ২০২২ সালে দেশটি বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে যে আয় করেছে, তা তাদের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) প্রায় ৬৮ শতাংশ। সে বছর ১৭ লাখের বেশি মানুষ মালদ্বীপ ভ্রমণ করেছেন। এ জন্য তাঁরা ৪২০ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছেন। প্রতি পর্যটকের গড় ব্যয় ছিল প্রায় ২ হাজার ৫০০ ডলার। ১ হাজার ১৯০টি ছোট দ্বীপ নিয়ে গঠিত মালদ্বীপ। এর মধ্যে মাত্র ২২০টি দ্বীপে মানুষ বসবাস করে। দেশটির মাথাপিছু আয় (পিপিপি অনুযায়ী) ৩৬ হাজার ৪০০ ডলার। মালদ্বীপে সারা বছরই তাপমাত্রা ২৫ থেকে ৩৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে থাকে। অন্যান্য অনেক দেশের তুলনায় মালদ্বীপ ভ্রমণে ব্যয় খানিকটা বেশি। সেখানকার কিছু হোটেলে প্রতি রাতের ভাড়া ৫ হাজার ডলারের বেশি।

অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা: ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের ছোট্ট দ্বীপদেশ অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডা। ২০২২ সালে দেশটির মোট জিডিপির ৫৫ শতাংশ এসেছে বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে। সে বছর দেশটি ভ্রমণ করেন ২ লাখ ৬৫ হাজার পর্যটক। তাঁরা মোট ৯২ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার ব্যয় করেন। গড়ে প্রতি পর্যটকের ব্যয় সাড়ে তিন হাজার ডলার। অ্যান্টিগুয়া অ্যান্ড বারবুডার পিপিপিভিত্তিক মাথাপিছু আয় ৩১ হাজার ডলার, যা দেশটিকে অপেক্ষাকৃত উচ্চ আয়ের দেশের তালিকায় স্থান দিয়েছে।

সিশেলস: ভারত মহাসাগরের ছোট্ট দ্বীপদেশ সিশেলস। ২০২২ সালে দেশটির মোট জিডিপির ২৩ দশমিক ১ শতাংশ এসেছে বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে। সে বছর ৩ লাখ ৩২ হাজার পর্যটক সিশেলস ভ্রমণ করেন। তাঁরা মোট ৯৩ কোটি ২০ লাখ ডলার ব্যয় করেন। গড়ে প্রতি পর্যটক প্রায় ২ হাজার ৮০০ ডলার খরচ করেন।

শতাধিক দ্বীপ নিয়ে গঠিত সিশেলস। এর মধ্যে মাত্র ৩৩টি দ্বীপে মানুষের বসবাস রয়েছে। পিপিপিভিত্তিক মাথাপিছু আয় ৪০ হাজার ডলার। সিশেলসে সারা বছরই গ্রীষ্মকাল থাকে। তাপমাত্রা সাধারণত ২৪ থেকে ৩০ ডিগ্রির মধ্যে ওঠানামা করে। সৈকতকেন্দ্রিক ছুটির জন্য যা কিছু দরকার, তার সবই এখানকার সাদা বালুর সৈকতগুলোয় পাওয়া যায়।

জ্যামাইকা: ক্যারিবীয় অঞ্চলের দ্বীপদেশ জ্যামাইকা। ২০২২ সালে দেশটির মোট জিডিপির ২৩ দশমিক ১ শতাংশ এসেছে বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে। সে বছর দেশটিতে ভ্রমণ করেন ২৫ লাখ পর্যটক। তাঁরা মোট ৩৭০ কোটি ডলার ব্যয় করেন। গড়ে প্রতি পর্যটক দেড় হাজার ডলারের মতো ব্যয় করেন। জ্যামাইকা অপেক্ষাকৃত দরিদ্র দেশ। পিপিপিভিত্তিক মাথাপিছু আয় ১২ হাজার ডলার। দেশটি ১৯৬২ সালে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। স্বচ্ছ পানির সমুদ্র, উজ্জ্বল রোদ আর সাদা বালুর সৈকতের জন্য জ্যামাইকা পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এখানে বছরে প্রায় ১০ মাস সৈকতভিত্তিক পর্যটন মৌসুম থাকে। সৈকত ছাড়াও দেশটির গিরিখাত, জলপ্রপাত আর বনভূমি পর্যটকদের জন্য অন্যতম আকর্ষণ।

বেলিজ: ক্যারিবীয় উপকূলে মেক্সিকোর দক্ষিণে অবস্থিত মধ্য আমেরিকার দেশ বেলিজ। ২০২২ সালে দেশটির মোট জিডিপির ২০ দশমিক ৩ শতাংশ আসে বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে। সে বছর বেলিজ ভ্রমণ করেন ৩ লাখ ৭১ হাজার পর্যটক। তাঁরা মোট ৬০ কোটি ডলার ব্যয় করেন। গড়ে প্রতি পর্যটক খরচ করেন প্রায় ১ হাজার ৬২০ ডলার।

বেলিজ একটি দরিদ্র দেশ। মাথাপিছু আয় ৯ হাজার ৬০০ ডলার। দেশটি ১৯৮১ সালে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। অন্যান্য পর্যটননির্ভর অর্থনীতির দেশগুলোর তুলনায় বেলিজ ভ্রমণে যাওয়া পর্যটকের সংখ্যা বেশ কম। তারপরও দেশটির জিডিপিতে পর্যটন খাতের বড় ভূমিকা রয়েছে। কারণ, দেশটির অর্থনীতির আকার ছোট। আর অর্থনীতির অন্যান্য খাত তেমন উন্নত নয়। বেলিজের উপকূল, প্রাচীন মায়ান মন্দির ও বিখ্যাত ‘ব্লু হোল’ পর্যটক আকর্ষণের প্রধানকেন্দ্র। বেলিজে সারা বছর তাপমাত্রা গড়ে ২৪ থেকে ২৮ ডিগ্রির মধ্যে থাকে।

ক্রোয়েশিয়া: ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী দেশ ক্রোয়েশিয়া। ২০২২ সালে দেশটির মোট জিডিপির ১৮ দশমিক ৯ শতাংশ আসে বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে। সে বছর ১ কোটি ৫৩ লাখ পর্যটক ক্রোয়েশিয়া ভ্রমণ করেন। তাঁরা মোট ১ হাজার ৩৫০ কোটি ডলার ব্যয় করেন। গড়ে প্রতি পর্যটক খরচ করেন প্রায় ৯০০ ডলার। ক্রোয়েশিয়ার মাথাপিছু আয় ৪২ হাজার ৫০০ ডলার। উপকূলীয় অঞ্চল, পাহাড়ি ঢালের প্রসারিত দৃশ্যাবলির জন্য পর্যটকেরা ক্রোয়েশিয়া ভ্রমণের আকৃষ্ট হন। প্রাচীন স্থাপত্য ও ঐতিহাসিক নিদর্শনের জন্যও দেশটি সুপরিচিত। ক্রোয়েশিয়ার ‘দ্য ওল্ড টাউন অব দুব্রোভনিক’ ইউনেসকো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ।

মন্টেনেগ্রো: বলকান উপদ্বীপের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত দেশ মন্টেনেগ্রো। ২০২২ সালে দেশটির মোট জিডিপির ১৮ দশমিক ২ শতাংশ এসেছে বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে। সে বছর ২০ লাখ পর্যটক মন্টেনেগ্রো ভ্রমণ করেন। তাঁরা মোট ১১০ কোটি ডলার ব্যয় করেন। গড়ে প্রতি পর্যটক খরচ করেন প্রায় ৫৫০ ডলার। মন্টেনেগ্রোর মাথাপিছু আয় ২৯ হাজার ডলার, যা দেশটিকে অপেক্ষাকৃত উচ্চ আয়ের দেশের তালিকায় রেখেছে।

আড্রিয়াটিক সাগর বরাবর মন্টেনেগ্রোর ২৯৬ কিলোমিটার দীর্ঘ উপকূলরেখায় ছড়িয়ে আছে অনেক সংরক্ষিত প্রাচীন শহর। ইতিহাস ও স্থাপত্যে সমৃদ্ধ দেশ মন্টেনেগ্রো। দেশটির জনপ্রিয় পর্যটনগন্তব্যগুলোর মধ্যে রয়েছে ১৫ শতকের বসতি সভেতি স্তেফান।

বার্বাডোজ: ক্যারিবিয়ান অঞ্চলের দ্বীপদেশ বার্বাডোজ, যা ভেনেজুয়েলার উত্তরে অবস্থিত। ২০২২ সালে দেশটির মোট জিডিপির ১৬ দশমিক ২ শতাংশ এসেছে বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে। সে বছর বার্বাডোজ ভ্রমণ করেন ৪ লাখ ৪৩ হাজার পর্যটক। তাঁরা মোট ৯২ কোটি ৯০ লাখ ডলার ব্যয় করেন। গড়ে প্রতি পর্যটকের খরচ ছিল প্রায় ২ হাজার ১০০ ডলার।

বার্বাডোজে জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত প্রচুর বৃষ্টি হয়। ফলে এই সময়ে পর্যটকের সংখ্যা কমে যায়। তবে জানুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত শুষ্ক মৌসুম ভ্রমণের জন্য আদর্শ সময়। সাদা বালু ও সবুজাভ সমুদ্রের সৌন্দর্যের জন্য বার্বাডোজকে ক্যারিবিয়ানের অন্যতম সেরা ছুটির গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়।

আলবেনিয়া: আলবেনিয়া বলকান উপদ্বীপের পশ্চিম অংশে অবস্থিত। ২০২২ সালে দেশটির মোট জিডিপির ১৬ দশমিক ২ শতাংশ এসেছে বিদেশি পর্যটকদের কাছ থেকে। সে বছর আলবেনিয়ায় ভ্রমণ করেন ৬৭ লাখ পর্যটক। তাঁরা মোট ৩০০ কোটি ডলার ব্যয় করেন। গড়ে প্রতি পর্যটকের খরচ ছিল প্রায় ৪৪০ ডলার। আলবেনিয়ার মাথাপিছু আয় ১৭ হাজার ৮০০ ডলার। পর্যটকদের কাছে দেশটির স্বচ্ছ পানি ও সাদা বালুর সমুদ্রসৈকত বিশেষভাবে আকর্ষণীয়। পাশাপাশি দেশটির ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো দেখতেও অনেক পর্যটক আলবেনিয়ায় যান। আলবেনিয়ায় চিকিৎসাভিত্তিক পর্যটনও জনপ্রিয়।

ফিজি: দক্ষিণ-পশ্চিম প্রশান্ত মহাসাগরীয় ছোট দ্বীপদেশ ফিজি। ২০২২ সালে দেশটির মোট জিডিপির ১৪ দশমিক ৩৩ শতাংশ আসে বিদেশি পর্যটকদের ব্যয় থেকে। সে বছর ৬ লাখ ৩৬ হাজার পর্যটক ফিজি ভ্রমণ করেন। তাঁরা মোট ৭০ কোটি ডলার ব্যয় করেন। গড়ে প্রতি পর্যটকের খরচ ছিল প্রায় ১ হাজার ১০০ ডলার। ফিজি একটি স্বল্প আয়ের দেশ। মাথাপিছু আয় ১৪ হাজার ডলার। দেশটি ১৯৭০ সালে যুক্তরাজ্যের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে। সাদা বালুর সৈকত, নারকেলগাছ আর সমুদ্রের স্বচ্ছ পানি ফিজিকে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে তুলেছে; পাশাপাশি দেশটির গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বনাঞ্চল, গোলাকৃতি কুঁড়েঘরবিশিষ্ট গ্রাম, উৎসব-ঐতিহ্য ভ্রমণকারীদের কাছে দারুণ আকর্ষণীয়। ফিজির জলবায়ু গ্রীষ্মপ্রধান। সবচেয়ে শীতল সময়েও দেশটিতে গড় তাপমাত্রা থাকে ২২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।