৪ এপ্রিল, রয়টার্স : দক্ষিণ কোরিয়ায় সামরিক আইন জারি করাকে কেন্দ্র করে অভিশংসিত হয়েছিলেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ইউন সুক ইওল। অবশেষে গতকাল শুক্রবার দেশটির সাংবিধানিক আদালত ইউনের স্থায়ী অপসারণের পক্ষে রায় দিয়েছে। দেশটির রাজনৈতিক পরিস্থিতির সম্ভাব্য ভবিষ্যৎ নিয়ে ব্রিটিশ বার্তাসংস্থা রয়টার্স এ প্রতিবেদন তৈরি করেছে।

পরবর্তী পদক্ষেপ: দক্ষিণ কোরিয়ার সংবিধান অনুযায়ী, মেয়াদ শেষ হওয়ার আগে প্রেসিডেন্ট পদে শূন্যতা তৈরি হলে পরবর্তী ৬০ দিনের মধ্যে নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। জাতীয় নির্বাচন কমিশন ফল ঘোষণা করা মাত্রই নতুন প্রেসিডেন্ট দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। সে পর্যন্ত ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করবেন দেশটির প্রধানমন্ত্রী হান ডাক সু।

আগেরবার যা হয়েছিল: সর্বশেষ ২০১৭ সালে, দেশটির তৎকালীন প্রেসিডেন্ট পার্ক গিয়ুন হিয়ে অভিশংসিত হয়েছিলেন। একই বছর মার্চের ৯ তারিখ সাংবিধানিক আদালত তাকে অপসারণের পক্ষে রায় দেয়। এর দুমাস পর প্রেসিডেন্ট নির্বাচন আয়োজিত হয়েছিল। পার্কের উত্তরসূরী নির্বাচনের পরদিনই দায়িত্ব গ্রহণ করেন।

কে হতে পারেন পরবর্তী প্রেসিডেন্ট?: সাম্প্রতিক জরিপে দেখা গেছে, বিরোধীদলীয় নেতা লী জায়ে মিউং জনপ্রিয়তায় এগিয়ে রয়েছেন। ২০২২ সালের নির্বাচনে হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের পর ইউনের কাছে পরাজিত হয়েছিলেন তিনি। বিরোধীদলীয় এই নেতার বিরুদ্ধে আপাতত শক্ত কোনও প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায়, প্রেসিডেন্ট পদে তার আসীন হবার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে।

অবশ্য আইনি জটিলতার কারণে লীর নির্বাচন করা নিয়ে কিছুটা শঙ্কা রয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প সংক্রান্ত একটি ইস্যুতে তার বিরুদ্ধে ঘুষের মামলা রয়েছে। এই মামলার বাঁধা টপকে তিনি নির্বাচনে অংশ নিতে পারেন কিনা, সেটা জানার জন্য কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে।

পরবর্তী প্রেসিডেন্টের অগ্রাধিকারে থাকতে পারে যে বিষয়গুলো: ইউন সুক ইওলের সামরিক আইন জারি কেন্দ্র করে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি পুরো টালমাটাল হয়ে পড়েছিল। ওই অবস্থায় মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের ভারসাম্য বজায় রাখতে বেশ হিমশিম খাচ্ছিল সিউল। এদিকে, শত্রু মিত্র সবার ওপরই দেদারসে শুল্ক আরোপ করে সবাইকে তটস্থ করে রেখেছেন ট্রাম্প।

সবদিক বিবেচনায় বলা যায়, দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামলে মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক ভারসাম্যপূর্ণ একটি অবস্থায় নিয়ে আসাই হবে পরবর্তী প্রেসিডেন্টের জন্য সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।

এছাড়া, উত্তর কোরিয়া ও রাশিয়ার সঙ্গেও তাল মিলিয়ে চলার ক্ষেত্রেও নতুন প্রেসিডেন্টকে কৌশলী ভূমিকা পালন করতে হবে।

ইউনের ভবিষ্যৎ কী?: ইউনের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগও আনা হয়েছে। ওই মামলার কারণে গত ১৫ জানুয়ারি তাকে গ্রেফতারও করা হয়। দেশটির ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনও ক্ষমতাসীন প্রেসিডেন্ট সেবার আটক হন।

পরবর্তীতে মার্চ মাসে আদালতের এক রায়ে জামিনে বেরিয়ে যান ইউন। তবে, মামলা এখনও চলমান আছে। রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ প্রমাণিত হলে অপসারণেই কেবল ইউনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এমনকি মৃত্যুদণ্ডও দেওয়া হতে পারে।

অবশ্য, সামরিক আইন জারির পেছনে রাষ্ট্রদ্রোহের চক্রান্তের অভিযোগ বরাবরই অস্বীকার করে এসেছেন ইউন। তার দাবি, পুরো সামরিক শাসন জারির কোনও উদ্দেশ্য তার কখনোই ছিল না। কেবল মাত্র দেশদ্রোহী শক্তির মূলোৎপাটনের জন্যই সামরিক আইন জারি করেছিলেন তিনি।

ইউনের অপসারণে কি সংকট কাটবে?: এটি নির্ভর করবে ইউনের সমর্থক ও তার বিরোধীদের বিক্ষোভ চলমান থাকবে কিনা, তার ওপর। সামরিক আইন জারি করার ছয় ঘণ্টার মধ্যেই বিরোধীদলের চাপে তা প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়েছিলেন ইউন। তবে কিছুদিন পরেই তাকে অভিশংসিত করে পার্লামেন্ট। এরপর থেকেই তার সমর্থক ও বিরোধীদের পাল্টাপাল্টি বিক্ষোভে সিউলের রাজনৈতিক অঙ্গন উত্তপ্ত ছিল। সামরিক আইন জারি করার কারণে দক্ষিণ কোরিয়ার রক্ষণশীল ও উদারপন্থীদের মধ্যে বিভাজন আরও সুস্পষ্ট আকার ধারণ করে। এছাড়া, সামরিক আইন জারি করায় সেনাবাহিনীর ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উত্থাপিত হওয়ায় রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের আন্তঃসম্পর্কে টানাপড়েন দেখা দেয়। ইউনের সামরিক আইন জারির নাটকীয়তার আগে থেকেই অবশ্য পার্লামেন্টে ক্ষমতাসীন ও বিরোধীদের রেষারেষি তুঙ্গে ছিল। ইউনের একাধিক সিদ্ধান্ত বাতিল হয়ে যাচ্ছিল বিরোধীদের কারণে। অনেক বিশ্লেষকের ধারণা, বিরোধীদের এই ঝামেলা এড়াতেই সামরিক আইন জারি করেছিলেন ইউন। তাই, ইউন সুক ইওলের অপসারণের মধ্য দিয়েই দক্ষিণ কোরিয়ার রাজনৈতিক সংকট কেটে যাবে, তা নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।