বিবিসি : ইতালির উত্তরাঞ্চলীয় ফ্রেগোনা শহরের সরু মূল সড়ক দিয়ে যাওয়ার সময় স্থানীয় মেয়র জাকোমো দে লুকা কিছু দোকানপাট দেখালেন। এর মধ্যে আছে দুটি সুপারমার্কেট, একটি সেলুন, কিছু রেস্তোরাঁ। কিন্তু দোকানগুলোর শাটার ফেলে রাখা। সাইনবোর্ডগুলো মলিন। এখন আর চালু নেই।

ইতালির অনেক শহরের মতোই পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত সুন্দর শহর ফ্রেগোনা এখন প্রায় জনশূন্য। কারণ, স্থানীয় বাসিন্দারা আগের চেয়ে অনেক কম সন্তান নিচ্ছেন, অনেকে আবার বড় শহরে চলে যাচ্ছেন, কেউ কেউ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন। এখন স্থানীয় প্রাথমিক বিদ্যালয়টিও বন্ধ হওয়ার পথে। আর এ নিয়েই সবচেয়ে বেশি দুশ্চিন্তায় আছেন শহরের মেয়র।

দে লুকা ব্যাখ্যা করে বলেন, নতুন বছরে প্রথম শ্রেণির ক্লাস চালু করা যাচ্ছে না। কারণ, সেখানে মাত্র চারজন শিশু আছে। তাঁরা এটা বন্ধ করে দিতে চান।

নিয়ম অনুযায়ী, স্কুল পরিচালনার জন্য তহবিল পেতে হলে প্রতিটি ক্লাসে অন্তত ১০ জন শিক্ষার্থী থাকতে হয়। ভেনিস শহর থেকে গাড়ি চালিয়ে ফ্রেগোনায় যেতে এক ঘণ্টা লাগে। মেয়রের হিসাব অনুযায়ী, ফ্রেগোনার জনসংখ্যা গত দশকে প্রায় এক-পঞ্চমাংশ কমেছে। চলতি বছর জুন মাস পর্যন্ত ফ্রেগোনা শহরে মাত্র চারটি শিশুর জন্ম হয়েছে। শহরের বাকি প্রায় ২ হাজার ৭০০ বাসিন্দার বেশির ভাগই প্রবীণ। দে লুকার কাছে রিসিপশন ক্লাস (প্রাথমিক শ্রেণি) বন্ধ হয়ে যাওয়া যেন এক মোড় ঘোরানো ঘটনা। তিনি আশঙ্কা করছেন, যদি শিশুরা ফ্রেগোনার বাইরে গিয়ে পড়ালেখা শুরু করে, তাহলে তারা আর এ শহরের দিকে ফিরে তাকাবে না। এ কারণে মেয়র এখন আশপাশের এলাকা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমনকি কাছের একটি পিৎজা কারখানাতেও গেছেন। তাঁর একটাই চেষ্টা, যেভাবেই হোক সেখানকার অভিভাবকদের রাজি করানো, যেন তাঁদের সন্তানদের ফ্রেগোনার স্কুলে ভর্তি করান এবং স্কুলটি বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ তৈরি হয়।

ইতালির একজন নারী এখন গড়ে মাত্র ১ দশমিক ১৮ হারে সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। এটি দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে কম জন্মহার। এ হার ইউরোপীয় ইউনিয়নের গড় হার ১ দশমিক ৩৮-এরও নিচে। আর স্থিতিশীল জনসংখ্যার মানদ- ২ দশমিক ১ হার থেকে তো অনেকটাই নিচে। মেয়র বলেন, ‘আমি মিনিবাস পাঠিয়ে শিশুদের সেখান থেকে নিয়ে আসার প্রস্তাব দিয়েছি। আমরা প্রস্তাব দিয়েছি, শিশুরা চাইলে সন্ধ্যা ছয়টা পর্যন্ত স্কুলে থাকতে পারবে। সব খরচ দেবে পৌরসভা।’ দে লুকা আরও বলেন, ‘আমি ভীষণ উদ্বিগ্ন। যদি এভাবে চলতেই থাকে, এ এলাকা শেষ হয়ে যাবে।’

দেশজুড়েই সমস্যা : ইতালির জনসংখ্যা সংকট শুধু ফ্রেগোনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। গত এক দশকে পুরো দেশের জনসংখ্যা কমেছে প্রায় ১৯ লাখ। টানা ১৬ বছর ধরে জন্মহার কমছে। ইতালির একজন নারী এখন গড়ে মাত্র ১ দশমিক ১৮ হারে সন্তানের জন্ম দিচ্ছেন। এটি দেশটির ইতিহাসে সবচেয়ে কম জন্মহার। এ হার ইউরোপীয় ইউনিয়নের গড় হার ১ দশমিক ৩৮-এরও নিচে। আর স্থিতিশীল জনসংখ্যার মানদ- ২ দশমিক ১ হার থেকে তো অনেকটাই নিচে।

সন্তান জন্মে উৎসাহ দিতে নানা উদ্যোগ নেওয়ার পরও জর্জিয়া মেলোনির ডানপন্থী সরকার জন্মহার বাড়াতে পারেনি। মেয়র এখন আশপাশের এলাকা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। এমনকি কাছের একটি পিৎজা কারখানাতেও গেছেন। তাঁর একটাই চেষ্টা, যেভাবেই হোক সেখানকার অভিভাবকদের রাজি করানো, যেন তারা তাঁদের সন্তানদের ফ্রেগোনার স্কুলে ভর্তি করান এবং স্কুলটি বাঁচিয়ে রাখার সুযোগ তৈরি হয়।

ফ্রেগোনার মূল চত্বরে ভ্যালেন্তিনা দোত্তোর নামের স্থানীয় এক নারীর সঙ্গে বিবিসির আলাপ হয়। তাঁর সঙ্গে ছিল ১০ মাসের মেয়ে দিলেত্তা।

ভ্যালেন্তিনা বলেন, একটা সন্তান নেওয়ার আগে এখন অনেক চিন্তা করতে হয়। দিলেত্তার জন্মের প্রথম বছরে ভ্যালেন্তিনা সরকার থেকে মাসে প্রায় ২০০ ইউরো (বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ২১ হাজার টাকা) ভাতা পান। তবে অল্পের জন্য তিনি সরকারের নতুন ঘোষিত ‘বেবি বোনাস’ স্কিম পাননি। এ স্কিমের আওতায় ২০২৫ সালে জন্ম নেওয়া শিশুদের জন্য এক হাজার ইউরোর নতুন অনুদান ঘোষণা করা হয়েছে। এ ছাড়া সরকার নতুন করে কর রেয়াত এবং বাবা-মায়ের জন্য ছুটির সময়সীমাও বাড়িয়েছে। তবুও বাস্তব জীবনের খরচ, অনিশ্চয়তা আর ভবিষ্যতের চিন্তাই মানুষকে সন্তান নেওয়া থেকে পিছিয়ে রাখছে।

তবে ভ্যালেন্তিনাকে এখন কাজের জায়গায় ফিরতে হচ্ছে। কারণ, সাশ্রয়ী দামে শিশুসেবা পাওয়া এখনো খুব কঠিন। ভ্যালেন্তিনা বলেন, ‘শিশু কম, কিন্তু শিশুদের রাখার জায়গাও খুব কম। আমি ভাগ্যবান। কারণ, আমার দাদি আমার মেয়েকে দেখাশোনা করেন। তা না হলে আমি জানি না তাকে কোথায় রেখে যেতাম।’

এ কারণেই ভ্যালেন্তিনার অনেক বন্ধু মা হতে সাহস পান না।

ভ্যালেন্তিনা বলেন, ‘চাকরি, স্কুল, খরচ—সবকিছু মিলিয়ে এটা কঠিন কাজ। কিছুটা সহায়তা পাওয়া যায়, তবে তা সন্তান নেওয়ার জন্য যথেষ্ট নয়।’

‘এতে সমস্যা মিটবে না’ : ভেনেতো অঞ্চলের কিছু কোম্পানি নিজেদের উদ্যোগেই সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। ফ্রেগোনা থেকে একটু নিচের দিকে নামলেই ভেনেতো নামের বড় এ শিল্প এলাকার দেখা পাওয়া যায়। সেখানে অনেক ছোট ও মাঝারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এমনই একটি কোম্পানি ইরিনক্স। তারা অনেক আগেই বুঝেছিল যে কর্মীদের সন্তানদের দেখাশোনা নিয়ে সমস্যা হচ্ছে। তাই ইরিনক্স আরও সাতটি কোম্পানির সঙ্গে মিলে কারখানার কাছেই একটি শিশু দেখাশোনার কেন্দ্র খুলে দেয়। এটি একদম ফ্রি না হলেও অনেকটা সস্তা আর সুবিধাজনক। এটি ইতালিতে নেওয়া প্রথম এমন ধরনের উদ্যোগ।