ইরান সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, অনলাইন যোগাযোগ, আর্থিক প্রলোভন এবং ইসরাইলি সমাজের সামাজিক–মানসিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে দখলকৃত অঞ্চলে নিজেদের গুপ্তচর নেটওয়ার্ক দ্রুত সম্প্রসারণ করছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে তেহরান ও তেল আবিবের মধ্যে উত্তেজনা এবং তথাকথিত ‘শ্যাডো ওয়ার’ বৃদ্ধি পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে উভয় দেশের গোয়েন্দা লড়াইও আরও তীব্র হয়েছে।
বিশ্লেষকদের মতে, ইসরাইলি সমাজে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা, অর্থনৈতিক সংকট, জাতিগত–ধর্মীয় বিভাজন এবং সরকারের প্রতি ক্রমবর্ধমান অবিশ্বাস ইরানের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে। এই পরিস্থিতিকেই কাজে লাগিয়ে তেহরান সাইবার যোগাযোগের মাধ্যমে বহু ইসরাইলি নাগরিককে টার্গেট করছে।
ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৩ থেকে ২০২৫ সাল পর্যন্ত ইসরাইলে ইরান সম্পর্কিত মোট ৩৯টি গুপ্তচরবৃত্তির ঘটনা শনাক্ত করা হয়েছে—যার মধ্যে ৩১টি ঘটনায় ইসরাইলের নিজস্ব নাগরিকরাই জড়িত ছিলেন। এদের বেশির ভাগের বয়স কিশোর থেকে বিশের ঘরে।
কীভাবে বিস্তৃত হচ্ছে ইরানের নেটওয়ার্ক
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ইরান টেলিগ্রাম, হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রামের মতো প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে আর্থিক প্রলোভন, মানসিক দুর্বলতা ও সামাজিক বিচ্ছিন্নতাকে কাজে লাগিয়ে গুপ্তচর সংগ্রহ করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যেসব ব্যক্তি সমাজে বিচ্ছিন্ন, অর্থনৈতিক সংকটে ভোগেন অথবা সামগ্রিকভাবে ইসরাইলি শাসনব্যবস্থার ভবিষ্যৎ নিয়ে হতাশ, তারাই সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিপূর্ণ।
বাস্তব উদাহরণে ইরানি অনুপ্রবেশ
ইসরাইলের সাবেক জ্বালানি মন্ত্রী গনেন সেগেভের ইরানের জন্য গুপ্তচরবৃত্তি করা এ পর্যন্ত সবচেয়ে উচ্চপর্যায়ের অনুপ্রবেশের উদাহরণ। নাইজেরিয়ায় কর্মরত অবস্থায় তিনি ইরানি কূটনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগে যান এবং পরবর্তীতে সংবেদনশীল নিরাপত্তা ও জ্বালানি অবকাঠামোসহ বিভিন্ন তথ্য তেহরানে সরবরাহ করেন।
শিন বেত জানায়, সেগেভ এনক্রিপটেড যোগাযোগব্যবস্থা ব্যবহার করে হোটেল ও অ্যাপার্টমেন্টে গোপন বৈঠকের মাধ্যমে তথ্য পাঠাতেন। তার মাধ্যমে ইরানি এজেন্টদের ইসরাইলি কর্মকর্তাদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হয়েছিল।
রয় মিজরাহি ও আলমোগ আতিয়াস হাইফার নিকটবর্তী নাজার শহরের এ দুই তরুণ প্রথমে সাধারণ কাজ—বাড়ির ছবি তোলা, পোস্টার লাগানো, গাড়ি বিক্রির সাইনবোর্ড পাঠানো—এসব করলেও পরে তাদের কাজে যুক্ত হয় সিসিটিভি ক্যামেরা বসানো এবং সামরিক তথ্য সংগ্রহের মতো জটিল দায়িত্ব।
বাসেম ও তাহের সাফাদি গোলান মালভূমির মাসাদা গ্রামের এই দুই দুর্জ বাসিন্দা ইরানি গণমাধ্যমকর্মীর কাছে সেনা চলাচলের তথ্য পাঠাতেন। পারিবারিক যোগাযোগকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে ইরান গুপ্তচরবৃত্তির নেটওয়ার্ক তৈরি করে—এই ঘটনা তার উদাহরণ।
রাফায়েল রৌনি ২১ বছর বয়সি এই ইসরাইলি সেনা হাটজেরিম এয়ারবেসের মতো কৌশলগত সামরিক ঘাঁটিতে কর্মরত ছিলেন। ইসরাইলের চ্যানেল–১৫-এর দাবি, রৌনি দীর্ঘ সময় ধরে ইরানি এজেন্টদের সঙ্গে যোগাযোগে ছিলেন এবং অর্থের বিনিময়ে সংবেদনশীল সামরিক তথ্য সরবরাহ করেছেন।
শিমন আজারজার ইরানের বিরুদ্ধে ১২ দিনের যুদ্ধে ইরানের জন্য গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে গ্রেফতার হন ২৭ বছর বয়সি আজারজার। সাইবার যোগাযোগের মাধ্যমে তিনি রামাত দাভিদ বিমানঘাঁটির ছবি ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলার স্থান সম্পর্কে তথ্য পাঠিয়েছেন বলে অভিযোগ। এমনকি একবার হামলা থেকে পালাতে পালাতে তিনি ইরানি এজেন্টকে বার্তা পাঠিয়েছিলেন—আমি এখন তোমাদের ক্ষেপণাস্ত্র থেকে পালাচ্ছি; কোন জায়গায় আঘাত হেনেছে সে তথ্য দিতে পারি।
তথ্য ও বিশ্লেষণ
ওয়াশিংটন ইনস্টিটিউটের গবেষক সারা বুচ ও ম্যাথিউ লেভিটের মতে, ২০২৪ সালে ইরান-সম্পৃক্ত গুপ্তচরবৃত্তি পূর্ববছরের তুলনায় ৪০০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এমনকি তারা এক ঘটনায় ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু, সাবেক যুদ্ধমন্ত্রী ও শিন বেতের সাবেক প্রধানের বিরুদ্ধে হত্যাচেষ্টার ষড়যন্ত্রের কথাও প্রকাশ করে।
ইসরাইলি পুলিশের নিরাপত্তা বিভাগের প্রধানের দাবি—হামাস–ইসরাইল যুদ্ধের সুযোগে তেহরান ইসরাইলি নাগরিকদের আরও বেশি রিক্রুট করছে।
ইসরাইলের প্রতিক্রিয়া
ইসরাইল আটক–বিচার, সাইবার পর্যবেক্ষণ ও জনসচেতনতা ক্যাম্পেইনের মাধ্যমে ইরানি নেটওয়ার্ক মোকাবিলার চেষ্টা করছে। ইজি মানি, হেভি কস্ট নামে প্রচারণায় নাগরিকদের সতর্ক করা হচ্ছে। তবে নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের স্বীকারোক্তি—মানবিক দুর্বলতা ও সামাজিক হতাশার সুযোগ নিয়ে ইরানের অনুপ্রবেশ অব্যাহত রয়েছে।
ইরান ইসরাইলের অভ্যন্তরে ডিজিটাল মাধ্যম, আর্থিক প্রলোভন এবং সমাজের ভেতরের মানসিক–রাজনৈতিক দুর্বলতাকে কাজে লাগিয়ে বহুমাত্রিক ও দীর্ঘমেয়াদি গুপ্তচর নেটওয়ার্ক তৈরি করেছে। বিভিন্ন বয়সের এবং ভিন্ন পটভূমির ব্যক্তিদের ব্যবহার করে তেহরান যে কৌশলে সেনা ঘাঁটি, সরকারি প্রতিষ্ঠান ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের তথ্য সংগ্রহ করছে—তা দু’দেশের শ্যাডো ওয়ারকে নতুন মাত্রায় নিয়ে গেছে।
এই তথ্যগুলোই দেখায়, ভবিষ্যতেও ইসরাইলের নিরাপত্তাজনিত সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হয়ে থাকবে মানবিক ফাঁকফোকর, আর সেটিই ইরানের প্রধান লক্ষ্যবিন্দু।
সূত্র: মেহের নিউজ এজেন্সি