ফ্রান্সে দীর্ঘ ৪১ বছর কারাভোগের পর অবশেষে মুক্তি পেলেন লেবাননের বামপন্থি রাজনীতিক ও শিক্ষক জর্জ আব্দুল্লাহ। ৭৪ বছর বয়সী এই সংগ্রামী বর্তমানে ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতীক হিসেবে বিবেচিত।
গত শুক্রবার (২৫ জুলাই) ফ্রান্সের একটি দক্ষিণাঞ্চলীয় কারাগার থেকে মুক্তির পর তাকে সরাসরি লেবাননে ফেরত পাঠানো হয়।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৮৭ সালে ফ্রান্সে দুই কূটনীতিক হত্যার দায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলেন আব্দুল্লাহ। নিহতদের একজন ছিলেন মার্কিন, অন্যজন ইসরায়েলি কূটনীতিক। দীর্ঘ সময় ধরে তার মুক্তির দাবি জানিয়ে আসছিল বিভিন্ন বামপন্থি সংগঠন। প্রতিবছর তার মুক্তির দাবিতে ফ্রান্সে বিক্ষোভ হতো এবং তাকে 'সম্মানসূচক নাগরিক' ঘোষণা করেছিল কয়েকটি পৌরসভা।
কারাগারে থেকেও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি প্রকাশ করে নিজের সংগ্রামী অবস্থান ধরে রেখেছিলেন তিনি। এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, দীর্ঘ কারাজীবনের মধ্যেও ফিলিস্তিনিদের সংগ্রামের কথাই তাকে মানসিকভাবে দৃঢ় রেখেছিল।
তার সেলের দেয়ালে বিপ্লবী চে গুয়েভারার ছবি আর সারা বিশ্ব থেকে আসা সহানুভূতির বার্তা সংবলিত পোস্টকার্ড ঝুলানো ছিল। ডেস্কজুড়ে পড়ে থাকত খবরের কাগজ, যেখান থেকে তিনি আন্তর্জাতিক রাজনীতির খোঁজ রাখতেন।
১৯৫১ সালে লেবাননের উত্তরে এক খ্রিস্টান পরিবারে জন্ম নেওয়া আব্দুল্লাহ ’৭০-এর দশকের শেষ দিকে লেবানিজ আর্মড রেভ্যুলুশনারি ফ্যাকশন (এলএআরএফ) নামে একটি মার্কসবাদী সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। এই সংগঠনটি ইসরায়েল এবং যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ইউরোপে কয়েকটি সন্ত্রাসী হামলার দায় স্বীকার করে। এসব হামলার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের দুই কূটনীতিক হত্যার ঘটনাও রয়েছে।
১৯৮৪ সালে লিয়ন শহরে গ্রেপ্তার হন আব্দুল্লাহ। শুরুর দিকে জাল পাসপোর্ট বহনের অভিযোগে তাকে আটক করা হয়, তবে পরে প্যারিসে তার ফ্ল্যাট থেকে অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনা এবং অতিরিক্ত রাজনৈতিক চাপের কারণে তার বিরুদ্ধে আরও কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
যদিও ১৯৯৯ সাল থেকেই তিনি প্যারোলে মুক্তির জন্য উপযুক্ত ছিলেন, কিন্তু বিভিন্ন সময় যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ চাপে তার মুক্তির প্রক্রিয়া বারবার থমকে যায়। এমনকি ২০১৩ সালে তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন ফ্রান্সকে আব্দুল্লাহর মুক্তি ঠেকাতে চিঠি লিখেছিলেন। ফাঁস হওয়া উইকিলিকসের তথ্যে এই বিষয়টি প্রকাশ্যে আসে।
এবার ফ্রান্সের আপিল আদালত জানায়, আব্দুল্লাহ আর রাষ্ট্রের জন্য হুমকি নন এবং তার সাজাও অপর্যাপ্তভাবে দীর্ঘ হয়েছে। তাই তার মুক্তি অনুমোদন দেওয়া হয়, তবে শর্ত থাকে যে, তাকে অবিলম্বে ফ্রান্স ত্যাগ করতে হবে।
আব্দুল্লাহর আইনজীবী বলেন, “এটি ন্যায়ের বিজয় হলেও খুব দেরিতে এসেছে।” এই মুক্তিকে রাজনৈতিক কেলেঙ্কারি হিসেবেও অভিহিত করেন অনেকে। ফরাসি লেখিকা ও নোবেলজয়ী অ্যানি এরনাক্স বলেন, “জর্জ আব্দুল্লাহ রাষ্ট্রীয় বিচার ব্যবস্থার শিকার, আর এ জন্য ফ্রান্সের লজ্জিত হওয়া উচিত।”
অনেক বিশ্লেষকের মতে, ইসরায়েলি কারাগারে ফিলিস্তিনি বন্দিদের কেউই এত দীর্ঘ সময় কারাভোগ করেননি, যেটা করেছে আব্দুল্লাহ।
জর্জ আব্দুল্লাহর ৪১ বছরের বন্দিজীবন ছিল কেবল একটি ফৌজদারি মামলার ফল নয়, বরং এক দীর্ঘ রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের প্রতিফলন, যেখানে বৈশ্বিক কূটনীতির রেষারেষি, আদর্শগত সংঘর্ষ এবং রাষ্ট্রীয় চাপ সবকিছুই মুখ্য ভূমিকা রেখেছে।