রহমত মাগফিরাত নাজাতের মাস রমযান

মিয়া হোসেন : অতিবাহিত হচ্ছে পবিত্র রমযানের রহমতের দশক। আজ ৫ম রোযা। পবিত্র মাহে রমযানের রোযা পালনকারীদের জন্য যেমনি আল্লাহ অনেক সওয়াব ও সম্মানের কথা ঘোষণা করেছেন, তেমনি ইচ্ছাকৃতভাবে পবিত্র রমযানের রোযা পালন করা থেকে বিরত থাকলে তার জন্য রয়েছে কঠোর শাস্তি। এমন কী কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে একটি রোযা ভাঙ্গলে তার জন্য কাফফারা আদায় করতে হয়। আর এ কাফফারাও বড় ধরনের। একটি রোযার জন্য কাফফারা হলো কোন প্রকার বিরতি ছাড়া ৬০ দিন লাগাতার রোযা রাখা। যদি কারো কাফফারার রোযা আদায়ের শক্তি না থাকে, তাহলে একটি ফরয রোযার জন্য ৬০ জন মিসকিনকে দু'বেলা পেট ভরে খাওয়াবে অথবা একজন মিসকিনকে ষাট দিন দু'বেলা করে খাওয়াবে। প্রত্যেক মিসকিনকে প্রত্যেহ এক সাদকায়ে ফিতরার পরিমাণ আটা বা গম দিবে অথবা আটা বা গমের দাম দিবে। একই রমযান মাসে একাধিক রোযা ভেঙ্গে থাকলে একটি কাফফারা ওয়াজিব হবে। কিন্তু কাযা রোযা বিরতির সাথে বা বিরতিহীনভাবে আদায় করা যায়। যদি কাযা রোযা শেষ হওয়ার পূর্বে বর্তমান বৎসরের রোযা এসে পড়ে, তাহলে র্বুমান বৎসরের রোযা শেষে কাযা রোযা শুরু করতে হবে।

রোযার ফিদিয়া আদায় করা সর্ম্পকে আল্লাহ তাআলা বলেছেন, আর যাদের জন্য তা (সিয়াম পালন) কষ্টকর হবে, তাদের কর্তব্য ফিদিয়া তথা একজন দরিদ্রকে খাবার প্রদান করা।” [সূরা বাক্বারাহ, ২ : ১৮৪]

ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু আনহুমা এ আয়াতের তাফসিরে বলেছেন, "আয়াতের উদ্দেশ্য হচ্ছে- অশীতিপর বৃদ্ধ ও বৃদ্ধা যারা রোযা পালনে অক্ষম। তারা উভয়ে প্রতিদিনের বদলে একজন মিসকীন খাওয়াবেন।"[এটি বর্ণনা করেছেন ইমাম বুখারি (৪৫০৫)]'ফাতাওয়াল লাজনাদ্ দায়িমা (১০/১৯৮) তে এসেছে, যখন ডাক্তারগণ এই সিদ্ধান্ত দেন যে, আক্রান্ত রোগের কারণে আপনি রোযা পালন করতে পারবেন না এবং এ রোগ থেকে সুস্থতাও আশা করা যায় না তখন আপনাকে বিগত ও আগত মাসগুলোর প্রতিদিনের পরিবর্তে একজন মিসকীন খাওয়াতে হবে, যার পরিমাণ হল দেশীয় খাদ্যদ্রব্য যেমন খেজুর বা অন্য কোন খাদ্যের অর্ধ সা’। যদি ছুটে যাওয়া দিনগুলোর সমসংখ্যক দিন একজন মিসকীনকে রাতের বা দুপুরের খাবার খাইয়ে থাকেন তবে তা যথেষ্ট হবে। কিন্তু অর্থদানের মাধ্যমে ফিদিয়া দিলে সেটা যথেষ্ট হবে না।

রোযা অবস্থায় অনেকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও কিছু কিছু কাজ করে ফেলেন। আবার কেউ কেউ ভুলবশত কিছু খেয়ে ফেলেন। এসব কাজ করার পর তারা মনে করেন রোযা ভঙ্গ হয়ে গেছে। কিন্তু বেশ কিছু কাজ আছে যা রোযা ভঙ্গ হয়েছে মনে করলেও মূলত রোযা ভঙ্গ হয়নি। যে সব কারনে রোযা ভঙ্গ হয়নি বরং মাকরুহ হয়, তা হলো, যদি কোন রোযাদার কোন কিছু মুখে দিয়ে স্বাদ গ্রহণ করে। কোন জিনিস দাঁত দ্বারা চিবালে। কিন্তু নিজের সন্তানকে প্রয়োজনবোধে শক্ত খাদ্য চিবিয়ে নরম করে দিলে তাতে রোযা মাকরূহ হবে না। নিজের স্ত্রীকে সঙ্গমের ইচ্ছা ব্যতীত চুম্বন করলে। চোখে সুরমা ব্যবহার করলে। বিনা প্রয়োজনে মিছওয়াক করলে, যদি দাঁতের মাড়ি থেকে রক্ত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। গোঁফের উপর তেল লাগালে। মিথ্যা কথা বললে। অপরের দুর্নাম রটনা করলে। অশ্লীল ও বেহায়াপনা কথাবার্তা বললে অথবা গালাগালি করলে। রোযাদার ইফতার না করলে। শরীরে ভিজা কাপড় জড়ায়ে রাখলে বা গরমের জ্বালায় বারবার কুলি করে ঠা-া লাগালে। দাঁতের ভিতর হতে ক্ষুদ্র কোন বস্তু বের করে চিবিয়ে খেয়ে ফেললে রোযা মাকরূহ হয়ে যাবে। অশ্লীল গান-বাদ্য শ্রবণ করা। রোযাবস্থায় এমন কোন কাজ করা যাতে শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে এবং রোযা ভেঙ্গে ফেলার আশংকা হয়। কুদৃষ্টি থেকে চোখের হেফাজত না করা। সারাদিন নাপাক অবস্থায় থাকা। ইচ্ছাকৃতভাবে মুখে থু থু জমা করে গিলে ফেলা। ঝগড়া-বিবাদ করা। ইত্যাদি কারণে রোযা ভাঙ্গবে না তবে রোযা মাকরুহ হয়ে যাবে বলে হাদীসে উল্লেখ আছে।

এ ছাড়া রোযা অবস্থায় স্বপ্নদোষ হলে। জিহ্বা দ্বারা রান্না করা খাদ্যদ্রব্যের লবণের পরিমাণ পরীক্ষা করে থু থু ফেলে দিলে। অনিচ্ছাকৃতভাবে মশা-মাছি, ধুলাবালি, গাড়ির ধোঁয়া গলার ভিতরে প্রবেশ করলে। রোযার কথা ভুলে গিয়ে পানাহার বা যৌনাচার করলে। রোযা অবস্থায় শরীরে বা মাথায় তেল ব্যবহার করলে, চোখে সুরমা লাগালে। আতর বা অন্য কোন সুগন্ধি ব্যবহার করলে। ডুব দিয়ে গোসল করলে এবং কানে পানি ঢুকলে রোযা নস্ট হবে না।

রমযান মাসের মধ্যে যদি কোন অমুসলমান মুসলমান হয়, অথবা কোন নাবালেগ বালেগ হয় তবে তাদের ওপর পরবর্তী রোযাগুলো ফরয হবে। বিগত দিনগুলোর রোযা কাযা করার প্রয়োজন হবে না। তবে উন্মাদ ব্যক্তি মুসলমান ও বালেগ হলেও সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত তার উপর রোযা ফরজ হবে না। তবে সে যদি রমযান মাসের কোন অংশে সুস্থ হয়ে ওঠে, তবে এই রমযানের দিনগুলোর রোযা রাখা তার জন্য জরুরি হবে। তেমিনভাবে হায়েয-নেফাসগ্রস্ত স্ত্রীলোক যদি রমযানের মধ্যে পাক হয়ে যায় অথবা অসুস্থ ব্যক্তি যদি সুস্থ হয়ে ওঠে কিংবা কোন মুসাফির যদি মুকীম হয়ে যায় তবে রমযানের দিনগুলোর রোযা তাদের পক্ষে জরুরি হবে।

ইসমা‘ঈল (রহঃ) আবূ বাকর ইবনু ‘আব্দুর রহমান (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, আমি আমার পিতার সঙ্গে রওয়ানা হয়ে ‘আয়িশা (রাঃ) -এর নিকট পৌঁছলাম। তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে সাক্ষ্য দিচ্ছি, তিনি ইহতিলাম ছাড়া স্ত্রী সহবাসের কারণে জুনুবী অবস্থায় সকাল পর্যন্ত থেকেছেন এবং এরপর সাওম (রোযা) পালন করেছেন। তারপর আমরা উম্মে সালামা (রাঃ) -এর নিকট গেলাম। তিনিও অনুরূপ কথাই বললেন। আবূ জা‘ফর বলেন, ‘আবদুল্লাহ (রহঃ)- কে আমি জিজ্ঞাসা করলাম, কোন ব্যক্তি সাওম (রোযা) ভঙ্গ করলে সে কি স্ত্রী সহবাসকারীর মত কাফফারা আদায় করবে? তিনি বললেন, না; তুমি কি সে হাদীসগুলো সম্পর্কে জানো না যাতে বর্ণিত আছে যে, যুগ যুগ ধরে সাওম (রোযা) পালন করলেও তার কাযা আদায় হবে না? (সহীহ বুখারী)

‘উসমান ইবনু আবূ শায়বা (রহঃ) আবূ হুরায়রা (রাঃ) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, এক ব্যক্তি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে এসে বলল, এই হতভাগা স্ত্রী সহবাস করেছে রমযানে। তিনি বললেন, তুমি কি একটি গোলাম আজাদ করতে পারবে? লোকটি বলল, না। তিনি বললেন, তুমি কি ক্রমাগত দু’মাস সিয়াম পালন করতে পারবে? লোকটি বলল, না। তিনি বললেন, তুমি কি ষাটজন মিসকীন খাওয়াতে পারবে? সে বলল, না। এমতাবস্থায় নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর নিকট এক ‘আরাক অর্থাৎ এক ঝুড়ি খেজুর এল। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, এগুলো তোমার তরফ থেকে লোকদেরকে আহার করাও। লোকটি বলল, আমার চাইতেও বেশী অভাবগ্রস্ত কে? অথচ মদিনার উভয় লাবার অর্থাৎ হররার মধ্যবর্তী স্থলে আমার পরিবারের চাইতে অধিক অভাবগ্রস্ত কেউ নেই। নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, তাহলে তোমার পরিবারকেই খাওয়াও। (সহীহ বুখারী)

ইয়াহইয়া ইবনু ইয়াহইয়া (রহঃ) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সহধর্মিণী আয়িশা এবং উম্মু সালামা (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তাঁরা উভয়ই বলেন, রমযান মাসে ইহতিলাম ছাড়াই স্ত্রী সহবাসের কারণে জানাবাতের অবস্থায় রাসুলুল্লাহ আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর ভোর হতো, এরপর তিনি সাওম (রোযা) পালন করতেন। (সহীহ মুসলিম)

উমার ইবনু আবূ সালামাহ্ (রাযিঃ) থেকে বর্ণিত। একদা তিনি রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞেস করলেন, সওম পালনকারী ব্যক্তি চুম্বন করতে পারে কি? তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, কথাটি উম্মু সালামাকে জিজ্ঞেস কর। (তাকে জিজ্ঞেস করার পর) তিনি বললেন, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরূপ করেন। এরপর তিনি বললেন, হে আল্লাহর রসূল! আল্লাহ তো আপনার পূর্বাপর সমুদয় গুনাহ ক্ষমা করে দিয়েছেন। তখন রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকে বললেন, শোন, আল্লাহর শপথ আমি আল্লাহ তা’আলাকে তোমাদের সকলের চেয়ে অধিক ভয় করি। (সহীহ মুসলিম)