ঘুম শরীরের ক্ষতি পূরণ ও শক্তি সঞ্চয়ের একটি প্রাকৃতিক ব্যবস্থা। ঘুম কম হলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়। আমরা যখন ঘুমাই, তখন আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য দায়ী 'লিভিং অরগানিজম' (Living organisms) সবল হয়। কিন্তু আমরা না ঘুমালে এই 'লিভিং অরগানিজম'গুলো কাজ করতে পারে না।

ঘুমের সময় শরীরের বেশিরভাগ সিস্টেমই অ্যানাবলিক অবস্থায় থাকে, যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, স্নায়বিক, কঙ্কাল এবং পেশীতন্ত্র পুনরুদ্ধার করতে সাহায্য করে। এগুলি অত্যাবশ্যকীয় প্রক্রিয়া যা মেজাজ, স্মৃতিশক্তি এবং জ্ঞানীয় ফাংশন বজায় রাখে এবং এন্ডোক্রাইন এবং ইমিউন সিস্টেমের কাজে একটি বড় ভূমিকা পালন করে।

তাই সুস্থ থাকতে হলে নিয়মিত ঘুমের বিকল্প নেই। কারণ সারা দিনের ক্লান্তি দূর করে ঘুম। প্রতি রাতে অন্তত আট ঘণ্টা ঘুমানোর পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা।

ঘুম যেভাবে শরীরের যত্ন নেয়

১. প্রতিরোধক্ষমতা বাড়ায়: অনেকের কয়েক রাত ঘুম না হলে সর্দি-কাশি হয়। এতে অবাক হওয়ার কিছুই নেই। ঘুম প্রতিরোধশক্তি বাড়ায়। আর ঘুমের অভাবে কমে প্রতিরোধক্ষমতা। তাই ঘুমের অভাব হলে সংক্রমণ হওয়ার প্রবণতা বাড়ে।

২. ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে: ঘুম ভালো হলে বিপাক হার ঠিক থাকে। আর ঘুমের অভাবে তা দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেকেই ভাবেন কম ঘুমিয়ে ব্যায়াম করলেই ওজন কমবে। তা ঠিক নয়। বিপাক হার ভালো না থাকলে ওজন কমা সহজ নয়। তাই ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ঘুম খুব জরুরি।

৩. বয়সের ছাপ দেরিতে পড়ে: ঘুমের সময় শরীরের সব অঙ্গ নতুন করে কাজের শক্তি সঞ্চয় করে। যত ভালো ঘুম হবে, ত্বকও তত বেশি যত্নে থাকবে। এ সময় ত্বকের কোষ যত্ন পায়। তাতে ত্বকের তারুণ্য ধরে রাখা যায়।

দিনের ঘুম ভাল, নাকি রাতের ঘুম?

প্রকৃতির সবকিছু সৃষ্টিকর্তার আইন মেনে চলে। মানুষের শারীরবৃত্তীয় কর্মকাণ্ডও তার ব্যতিক্রম নয়। পবিত্র কুরআন মজিদে আল্লাহ বলেছেন, "তিনিই তোমাদের জন্য রাতকে করেছেন আবরণ, নিদ্রাকে করেছেন আরামপ্রদ আর দিনকে করেছেন আবার জীবন্ত হয়ে উঠার সময়।" (সূরা আল ফুরকান, আয়াত ৪৭)

"তিনিই তাঁর রহমাতের দ্বারা তোমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন দিন ও রাত, যাতে তোমরা বিশ্রাম গ্রহণ কর এবং তাঁর অনুগ্রহ তালাশ কর, এবং যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর।" (সূরা আল কাসাস, আয়াত ৭৩)

সাম্প্রতিক এক গবেষণায় জানা গেছে, পুষ্টি ও ব্যায়ামের পাশাপাশি ঘুম আমাদের সার্বিক সুস্বাস্থ্য বজায় রাখতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

অনেকে অহেতুক রাত জেগে দেরি করে ঘুমাতে যান, তারা ঘুমের বহুবিধ উপকার থেকে বঞ্চিত হন। ঘুমাতে যাবার সঠিক সময় হল রাত ১০টা থেকে এগারটার মধ্যে। এ সময় থেকে রাত ২টা বা তিনটা পর্যন্ত সময়ের গভীর ঘুমকে ডেল্টা স্লিপ বলে। এই ঘুমে শরীর ফুল রিল্যাক্সে থাকে। কোষ ও টিস্যু রিজেনারেশন এবং গ্রোথের মাধ্যমে শরীরের ক্ষয় পূরণ হয়। Immune system শক্তিশালী হয়। ডিপ স্লিপ বা ডেল্টা স্লিপ আপনার ঘুমের কোয়ালিটি নির্ধারণ করে।

অন্যদিকে, এই ঘুম যদি কেউ না পায় তাহলে বাকি ২৪ ঘন্টায় ২০ ঘন্টা ঘুমালেও ঘুমের আসল তৃপ্তি পাওয়া যায় না।

আর ডেল্টা স্লিপ না পাওয়ার ফলে ব্রেনের কার্যক্ষমতা কমে যাওয়া শুরু করে।পড়তে, খেতে এবং যেকোনো কাজ করতে আলসেমি অনূভুত হয়।

তিনি সঠিকভাবে ব্রেকফাস্ট করেন না। ফুড সার্কেল নষ্ট হয়। তাঁর সারা দিনের কাজের সিস্টেমে গোলযোগ হয়। সূর্যের আলোর মাধ্যমে ভিটামিন ডি থেকে বঞ্চিত হন। শুধু তা–ই নয়, ভিটামিন এ, ই থেকেও বঞ্চিত হন। দিনে ঘুমিয়ে রাত জাগলে মুখের টোনিং নষ্ট হয়ে যেতে পারে। ডার্ক সার্কেল পড়তে পারে। মানসিক অবসাদে ভুগতে পারেন। ওজন বাড়তে পারে। তা ছাড়া রাতে ঘুমের যেমন পরিবেশ, দিনে অনেক ক্ষেত্রেই সেটি পাওয়া যায় না। তাই দিনের ঘুম রাতের মতো গভীর হয় না। ওজন বাড়ার সম্ভাবনা থাকে। কেননা, রাতে দিনের মতো হাঁটাচলা হয় না। কিন্তু জাংক ফুড, ইরিটেটিং ফুড খাওয়ার প্রবণতা বাড়ে। এসব কারণে রাতের ঘুমই সেরা। দিনে ঘুমানো মন্দের ভালো।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়মিত সঠিক মাত্রায় ঘুম না হলে একজন মানুষ ক্রমাগত শারীরিক ও মানসিক সমস্যায় আক্রান্ত হতে পারেন। এর ফলে একটি সুন্দর জীবনও বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে।

অনিয়মিত ঘুম যেসব রোগের ঝুঁকি বাড়ায়-

১. পর্যাপ্ত ঘুম না হলে বা কম হলে উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা বাড়তে পারে। চিকিৎসকদের মতে, ঘুম না হলে শরীরের ‘লিভিং অরগানিজমগুলো ঠিকমতো কাজ করতে পারে না। নষ্ট হতে পারে শরীরের হরমোনের ভারসাম্য। বাড়তে পারে উচ্চ রক্তচাপ ও হাইপার টেনশন।

২. ঘুম কম হলে হার্টের সমস্যা হতে পারে। ঘুমের সময় হৃৎপিণ্ড ও রক্তনালি বিশ্রাম পায়। তাই ঘুম কম হলে প্রতিনিয়ত কার্ডিওভাসকুলার সমস্যা বাড়তে থাকে। ফলে হার্টের সমস্যা বাড়তে থাকে।

৩. ঘুম পর্যাপ্ত না হলে ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে। দীর্ঘদিন রাতে না ঘুমানো বা কম ঘুমানোর ফলে শরীরে ইনসুলিন উৎপাদন ব্যাহত হয়। তাই ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে।

৪. ঘুম শরীরের ক্ষতি পূরণ ও শক্তি সঞ্চয়ের একটি পন্থা। তাই ঘুম কম হলে তা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট হয়। আমরা যখন ঘুমাই, তখন আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার জন্য দায়ী ‘লিভিং অরগানিজম’ (Living organisms)। কিন্তু আমরা না ঘুমালে এই ‘লিভিং অরগানিজম’গুলো কাজ করতে পারে না। ফলে ক্রমশ আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমতে থাকে।

৫. মস্তিষ্কে ওরেক্সিন নামের একটি নিউরোট্রান্সমিটার আছে, যা মস্তিষ্ককে সচল রাখতে সহায়তা করে। প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুম না হলে ওরেক্সিন উৎপাদনের গতি মন্থর হয়ে যায়।

৬. প্রতিদিন পর্যাপ্ত ঘুম না হলে বাড়তে পারে হজমের সমস্যা। না ঘুমালে শরীরের পাচন ক্রিয়ায় সাহায্যকারী অঙ্গ-প্রত্যঙ্গগুলো সঠিকভাবে কাজ করতে পারে না। ফলে খাবার হজমে সহায়ক পাচক রসগুলো উপযুক্ত মাত্রায় নিঃসরণে বাধা পায়।