সোনাগাজী (ফেনী) সংবাদদাতা : ফেনী শহর থেকে আনুমানিক ৫ কিলোমিটার দুরে ফেনী-পরশুরাম সড়কের পাশেই গাড়ি থেকে নামতেই বাম পাশে চোখে পড়ে সবুজ টাইলস দিয়ে গড়ে তোলা দৃ’ি নন্দন সুরম্য গেইট। যার পিঠে লিখা কাজির বাগ ইকো-পার্ক, ফেনী। মুল গেইট পার হলেই সবুজ বন -বনানীর এক কোণে ময়ুর পাখির নাচা-নাচি। অমনি মনের মাঝে সুর বাজে কবি যোগিন্দ্রনাথ সরকারের ‘ময়ুর’ কবিতাটির ছন্দে লিখা
আয়রে ময়ুর আয়
প্যাখম ধরে নেচে নেচে
যাদুর কাছে আয়।
আসতে যেতে ঘুমুর বাজে
সোনার নূপুর পায়।
সামনে এগুতে পথ চলতে চলতে দেশীয় নানা প্রজাতের ফুলের গন্ধে আপনার মনকে করবে মাতোয়ারা। মনের অজানতে তখন গেয়ে উঠবেন কবি হেলাল হাফিজের রজনী গন্ধা ফুলকে কেন্দ্র করে লিখা
তোমার জন্য সকাল, দুপুর
তোমার জন্য সন্ধ্যা
তোমার জন্য সকল
গোলাপ এবং রজনীগন্ধা।
বলছিলাম ফেনীর এক মাত্র দৃষ্টি নন্দন প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ঘেরা সৌন্দর্যমন্ডিত বিনোদন স্পট অনন্য সুন্দর ফেনী বন বিভাগের আওতাধীন পর্যটন কেন্দ্র কাজির বাগ ইকো-পার্ক এর কথা। ফেনী শহর তলী থেকে একটু দুরে ফেনী-পরশুরাম রাস্তার পাশেই দৃষ্টি নন্দন বিশাল সবুজের সমারোহ। চোখ যত দূর যায় যেন সবুজ আর সবুজ। প্রকৃতি যেন সবকিছু ঢেলে দিয়েছে ছোট্র এ স্থান জুড়ে। সবুজ প্রকৃতির সাথে মিতালি গড়ে তুলতে কার না মন চায়। আমাদের কর্ম ব্যস্ত জীবনে মানাসিক প্রশান্তি মিলবে এখানে এলে। জীব-বৈচিত্র সংরক্ষণ ও বন্য প্রাণীর অভয়ারণ্য এবং পযর্টকের বিনোদনের জন্য বন বিভাগের প্রচেষটায় গড়ে ওঠা পার্কটিতে রয়েছে বিরল প্রজাতির গাছপালা। হাজারো রকমের নজর কাড়া ফুলের গাছ, কৃত্তিম লেক ও নানা প্রজাতির জীব বৈচিত্রের সমারোহ।
শহর থেকে মাত্র ৫ কিঃমিঃ দূরে ফেনী সদর উপজেলার কাজির বাগ এলাকায় বন বিভাগের সরকারী পাঁচ একর জায়গায় মনোরম পরিবেশ নির্মিত হয়েছে এ সবুজ শ্যামল ইকো-পার্কটি। ইতোমধ্যে পার্কে স্থান পেয়েছে দর্শনাথীদের বসার বেঞ্চ, ছায়ার জন্য দেওয়া হয়েছে ছাতা, দেখার জন্য রয়েছে হরিণ, বানর,ময়ুর, খরগোশ, তিতির রাজ হাস সহ বিভিন্ন প্রজাতির পাখি।শিশুদের খেলার জন্য শিশু কর্ণার, শিশু রাইট, পুকুরে নৌকা ভ্রমন, স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য বোটানিক্যাল গার্ডেন ইত্যাদি। পর্যটক ঢুকতেই চোখে পড়ে নানা ধরনের ফুলের বাগান আর নানা জাতের গাছ-গাছালি। এখানে আছে দেশীয় ফুল গাছের মধ্যে গন্ধরাজ, রজনীগন্ধা, আলবেন্ডা, রংগম, মাধবীলতা আর চেরী দেশীয় ফলের গাছের মধ্যে রয়েছে, কাউফল, ঢেউয়া, হিজর প্রভৃতি। সাগরের নোনা পানির গাছের মধ্য রায়েছে কেওড়া, বাইন, গেওয়া, পাহাড়ী জাতের গাছের মধ্যে হলদু, নাগেশ্বর, চাপালিশ, নাগালিংগম আর আগর, ঔষুধী গাছের মধ্য অর্জুন,বহেরা, খয়ের, শোভাবর্ধণ গাছের মধ্যে কাঞ্চন, পলাশ, বিরল প্রজাতির গাছের মধ্যে বাঁশপাতা, সিভিট। পার্কটির প্রবেশ পথের মুখে বিস্তারিত লেখা আছে খুটির উপর সাঁটানো সাইন বোর্ডে। এখানে হাটার জন্য পাকা সড়ক, পথের পাশে ও বাগানের আশপাশে গল্প করার জন্য বেঞ্চ, বিভিন্ন পশু পাখির অবয়ববে ডাস্টবিন, পার্কের ভেতরে দর্শনাথী শিশুদের জন্য শিশু কর্ণার করা হয়েছে। যেখানে শিশুদের মেরি গো রাউন্ড (ঘূর্ণায়মান) স্লিপার ঢেঁকি, দোলনা, ব্যাঙের ছাতা সহ আনন্দ উপভোগের নানা উপকরণ।
পার্কের শেষপ্রান্তে পশু-পাখির জন্য চিড়িয়া খানার আদলে আলাদা কর্ণার করা হয়েছে। সেগুলোতে হরিণ, বানর, খরগোশ, ময়ুর, আর বন মোরগের জন্য আলাদা বেষ্টনী। পার্কের মাঝ খানেই মূলত রয়েছে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির আদর্শ বাগান, নার্সরী সেন্টার, বিভিন্ন বনজ, ফলদ, ঔষুধী বিরল ও বিলুপ্ত প্রজাতির সমম্বয়ে একটি বোটানিক্যাল গার্ডেন এবং সূদৃশ্য ফুলের বাগান।
বিশ্রামাগারের সামনেই একটি সুদৃশ্য ফোয়ারা, পাশেই পুকুর। পুকুরের চারপাশে চারটি পাকা ঘাট, মাঝখানে সুন্দর ফোয়ারা, পুকুরে ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য একটি সুন্দর নৌকা। পার্কটির মূল আকর্ষণ হচ্ছে পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। পার্কের ঠিক মাঝ বরাবর প্রায় ৫০ ফুট উঁচু এই পর্যবেক্ষণ টাওয়ার। টাওয়ারের উপর উঠে দর্শনাথীরা আশপাশের গ্রাম সহ সৌন্দর্য্য উপভোগ করা যায় অনায়াশে। মনের আনন্দে ছবি ও ভিডিও ধারণ করতে অনেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়ে এ টাওয়ারে। কাজির বাগ ইকো-পার্কে ঘুরতে আসা সাংবাদিক এম. এমরান পাটোয়ারি সহ বেশ ক’জন দর্শনার্থী জানান, এ ইকো-পার্ক টি বিনোদোনের সত্যিই মনোরম স্পট। যেখানে রয়েছে প্রকৃতির সাথে সমগ্র সবুজের মিতালি। চারদিকে শুধু সবুজের সমারোহ। যাহা যে কোন পর্যটককে কাছে টানে বারবার। ফেনীতে এত বিশাল এলাকা জুড়ে এমন মনো মুগ্ধকর নিরিবিলি আর কোন পর্যটন কেন্দ্র নেই। এখানে এলেই সকল পেশার মানুষের প্রকৃতির সাথে মন ছুঁয়ে যায়।
সমাজিক বনবিভাগ ফেনী সদর উপজেলার রেঞ্জ কর্মকর্তা বাবুল চন্দ্র দাস জানান, কাজির বাগ ইকো-পার্কটি সরকারের সামাজিক বনবিভাগের একটি জন সাধারনের জন্য বিনোদনের সুযোগ সৃষ্টি প্রকল্প। ফেনী জেলা ছাড়া ও দেশের বিভিন্ন জেলার বিনোদনপ্রেমীরা সারা বছর এখানে বিনোদন করতে আসে। সপ্তাহের প্রতিদিনই দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত সর্ব সাধারণের জন্য খোলা থাকে। গত বছর ভারতের উজানের পানির ঢলে সৃষ্ট স্মরণ কালের ভয়াবহ বন্যায় ইকো-পার্কের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। সেগুলো অনেকাংশে সামাল দেয়া হয়েছে। পর্যটক আকর্ষণ করতে শিশুদের জন্য পারিবেশ বান্ধব শিক্ষনীয় আরো কিছু রাইড স্থাপন করা প্রয়োজন। বর্ষাকালে দর্শনাথীদের জন্য পার্কের বিভিন্ন অংশে কয়েকটি টংঘর-গোল ঘর নির্মাণ করা, প্রতিটি গাছের মধ্যে পরিচিতি নেম প্লেট লাগানো সহ পার্ক এলাকায় রংকরা, আধুনিকী করণ করা গেলে দর্শনাথীদের বাড়তি আকর্ষণ সৃষ্টি হবে। সামাজিক বন বিভাগের ফেনীর বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ রুহুল আমিন জানান, এ ইকো-পার্কের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীব-বৈচিত্র্যের সমৃদ্ধি করণ। বন্য প্রানির আবাস স্থল ও প্রজনন ক্ষেত্র উন্নয়ন, স্থানীয় জন সাধারনের বিনোদনের সৃষ্টিসহ রাজস্ব আয়ের সম্ভাবনাকে কাজে লাগিয়ে রাজস্ব আয় বৃদ্ধি। তিনি আরো জানান, গত ২০২৪-২০২৫ অর্থ বছরে এ ইকো-পার্ক থেকে ১৫,৬৮,৬৫৩ টাকা রাজস্ব আয় হয়েছে। পার্ক এলাকায় ড্রেনেজ ব্যাবস্থার উন্নয়ন, বর্ষায় জলাবদ্ধতা দূরীকরণ সর্বোপরি এটিকে দৃষ্টিনন্দন ও আধুনিকী করণ করা গেলে এখাত থেকে আরো বেশী পরিমাণে সরকারি রাজস্ব আয় করতে পারবে। এ জন্য সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এতদ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপ নেয়া বিশেষ প্রয়োজন।