কবির আহমদ, সিলেট : সিলেটের সীমান্তবর্তী কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট ও জৈন্তপুর এলাকার বিভিন্ন পর্যটন স্পটে দেশ ও বিদেশ থেকে প্রতিদিন হাজারো পর্যটকদের ঢল নামত। হযরত শাহজালাল (রহঃ) ও হযরত শাহপরান (রহঃ) মাজারেও লাখো পর্যটকের আনাগোনা হরহামেশাই লেগে থাকত। প্রকৃতিকন্যা জাফলং ও বিছনাকান্দি এবং রাতারগুলের টলটলে পানির উপর দিয়ে নৌকা ভ্রমণ না করলে পর্যটকদের ভ্রমণ যেন অপূর্ণই থেকে যেত। কিন্তু গত কয়েক মাসে সাদাপাথর লুটকান্ডে পর্যটকরা সিলেটে আসা কমিয়ে দিয়েছেন। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিএনপি’র অব্যাহতিপ্রাপ্ত কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা সভাপতি সাহাব উদ্দিনকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠালেও পাথরকান্ডে জড়িত অনেকেই এখনো ধরাছোয়ার বাইরে রয়েছেন। ফলে পর্যটকদের মনে ব্যাপক হারে উদ্বেগ-উৎকন্ঠা রয়েছে। ভাঙাচোরা সড়ক, অনুন্নত অবকাঠামো, নিরাপত্তাহীনতা, পরিকল্পনা ও প্রচারের অভাব, দক্ষ জনশক্তি না থাকাসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা পর্যটন বিকাশে অন্যতম বাধা বলে করেন পর্যটন খাতের সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া অবাধে বালু ও পাথর লুটপাটে পর্যটনকেন্দ্রগুলোর সৌন্দর্যহানির কারণেও কমছে পর্যটক।
পাহাড়, ঝর্ণা, নদী, হাওর, অরণ্য, চা বাগান কিংবা জলারবন- কী নেই সিলেটে। প্রকৃতির এক অপরূপ লীলাভূমি সিলেট। প্রকৃতির এই সৌন্দর্য্য আর বৈচিত্রতার কারণে পর্যটকদের অন্যতম পছন্দের স্থান সিলেট। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সিলেটে কমছে পর্যটকদের আগমন। ২০২০ ও ২০২১ সালে করোনার প্রকোপের পর এবং ২০২২ সালের স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যা- প্রাকৃতিক এসব দুর্যোগ ছাড়াও মানবসৃষ্ট নানা প্রতিবন্ধকার কারণে সিলেটে আশানুরুপ পর্যটক সমাগম হচ্ছে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
২০২২ ও ২০২৪ সালে কয়েকদফা বন্যা হয় সিলেটে। সেই বন্যার ক্ষত এখনও রয়ে গেছে সিলেটের বেশিরভাগ সড়কে। নগরসহ সিলেটের পর্যটনকেন্দগুলোর বেশিরভাগ সড়কই ভাঙাচোরা। সিলেটের অন্য দুটি পর্যটন কেন্দ্র বিছনাকান্দি ও রাতারগুল জলারবন। এই দুই স্থানে যাওয়ার সড়কই ভাঙাচোরা। ফলে এসব স্থানে ভোগান্তিতে পড়ছেন পর্যটকেরা। পর্যটন স্পট বিছনাকান্দির দূরত্ব সিলেট থেকে প্রায় ৪২ কিলোমিটার। এ দূরত্বের গোয়াইনঘাট উপজেলার বঙ্গবীর রোড থেকে হাদারপাড় পর্যন্ত ৭ কিলোমিটার সড়কের অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। বন্যায় সড়কের পিচ উঠে বড় বড় গর্তেও সৃষ্টি হলেও তা এখন পর্যন্ত সংস্কার হয়নি। জলারবন খ্যাত রাতারগুলের দুরত্ব সিলেট থেকে প্রায় ২৬ কিলোমিটার। এ সড়কের পাঁচ কিলোমিটার অংশই ভাঙাচোরা। এ ছাড়া ওই সড়কের চানুপুর থেকে মোটরঘাট পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার সড়ক কাঁচা। এতে বৃষ্টির দিনে পর্যটকদের যাতায়াতে চরম সমস্যা হয়। সড়কের বেহাল অবস্থার কারণে সিএনজিচালিত অটোরিকশা আর লেগুনা ছাড়া কোনো গাড়িই যেতে চায় না রাতারগুল ও বিছনাকান্দিতে।
কুমিল্লার দেবিদ্বার থেকে সিলেটের প্রকৃতিকন্যা জাফলংয়ে সপরিবারে বেড়াতে আসা সঞ্চয় দেবনাথ বলেন, সিলেটের প্রকৃতি খুবই সুন্দর। পাহাড়, নদী, হাওর, ঝর্ণা, বন- সবই আছে এখানে। কিন্তু নগর থেকে পর্যটনস্পটগুলোতে আসার সড়কগুলো ভয়াবহ রকমের খারাপ। এই সড়কগুলোই সিলেটের পর্যটনের ‘পথের কাটা’ হয়ে আছে। এসব সড়ক দিয়ে কেউ একবার আসলে আর কোনোদিন আসতে চাইবে না।
এদিকে সিলেটে পরিবহন খাতের অব্যবস্থাপনার কারণেও পর্যটকদের দুর্ভোগে পরতে হয়। এপসভিত্তিক পরিবহন সেবা এখানে জনপ্রিয় না হওয়ায় পর্যটকদের কাছ থেকে ইচ্ছেমত ভাড়া হাকান চালকরা। পর্যটকদের কাছ থেকে মাঝিরা নৌকা ভাড়াও বাড়তি রাখেন বলে অভিযোগ রয়েছে। হাওর পর্যটন নিয়ে গবেষণা করা শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ইমদাদুল হক বলেন, সিলেটে পরিবহন খাতে বিশৃঙ্খলা রয়েছে। এখানকার চালকরা সিলেটের মানুষ না হলে ভাড়া বেশি রাখেন। এছাড়া ভাড়া গাড়ি নেওয়ার মতো কোন কাউন্টার বা টিকিটের ব্যবস্থা নেই। ফলে যাত্রীদের যেমন বাড়তি ভাড়া গুণতে হয় তেমনি নিরাপত্তা নিয়েও শঙ্কায় থাকতে হয়।
সিলেটের বিভিন্ন পর্যটকনকেন্দ্রে পর্যটকদের কাছ থেকে নৌকা ভাড়া বাড়তি রাখা হয় জানিয়ে পরিবেশবাদী সংগঠন ভূমিসন্তান বাংলাদেশের সমন্বয়ক আশরাফুল কবীর বলেন, বিভিন্ন এলাকার নৌকাভাড়া প্রশাসন থেকে নির্ধারণ করে দেয়া উচিত। ওইসব এলাকায় চলাচলকারী নৌকাগুলিকেও নিবন্ধন ও নজরদারির আওতায় আনা প্রয়োজন। তিনি বলেন, প্রতিবছর জাফলং ও লালাখালে পানিতে ডুবে অনেক পর্যটক মারা যান। প্রতিবছর এমন ঘটনা ঘটলেও পর্যটকদের নিরাপত্তায় তেমন কোন ব্যবস্থা নেই। পর্যটন পুলিশ বলে পুলিশের একটি বিশেষ ইউনিট থাকলেও পর্যটন কেন্দ্রগুলোতে তাদের তেমন কার্যক্রম চোখে পরে না।
এছাড়া সিলেটে আসা পর্যটকদের কাছে প্রধান দুটি আকর্ষনীয় স্থান গোয়াইনঘাটের জাফলং ও কোম্পানীগঞ্জের সাদাপাথর। অথচ এ দুটি জায়গাই এখন লুটপাটকারীদের অভয়রান্য। গত বছর ৫ আগস্টের সরকার পরিবর্তনের পর থেকে পাথর লুটে নিয়ে মরুভূমিতে পরিণত করা হয় সাদাপাথরকে। একই অবস্থা জাফলংয়েরও। এই দুই স্থানেই চলছে অবাধে বালি লুট। সাম্প্রতিক সময়ে প্রশাসনের কড়াকড়ির কারণে লুটপাট কিছুটা কমলেও একেবারে বন্ধ হয়নি। লুটপাটের কারণে সৌন্দর্য হারিয়েছে এসব পর্যটন এলাকা। ফলে কমেছে পর্যটক।