আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন
(গত সংখ্যার পর)
এয়ারপোর্টের বাইরে হোটেলের জন্য গ্রুপ ট্যুর প্যাকেজের ভাড়া করা টেক্সি ড্রাইভাররা তাদের হোটেলের নাম লিখে একটি কাগজ উঁচু করে ধরে রাখে। অনেকটা গলায় লাগিয়ে রাখার মতো। সেই কাগজে প্যাসেঞ্জারের নামও লেখা আছে। তাতে পর্যটকগণ হোটেলের নাম খুঁজে পেতে এবং নিজ নিজ গাইডকে খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না। আমাদেরকে গাড়ি দেখিয়ে দিয়ে ড্রাইভার কিছু সময়ের জন্য ভেতরে গেলো। ফিরে এসেই তার গাড়িতে করে আমাদের নেয়া হলো হুলহোমালে দ্বীপে। যা এয়ারপোর্ট থেকে দেখা যায়। এয়ারপোর্ট এবং হুলহোমালে দ্বীপটি পুরাই সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে। এই দ্বীপ আর এয়ারপোর্টের মাঝখানে সাগরের উপর একটি সেতুর ব্যবধান রয়েছে মাত্র। সেতুর পিলারে বিশাল বিশাল ঢেউয়ের আঁচড় পড়ে। দূর থেকে দেখতে খুবই সুন্দর দেখায়। বিশ মিনিটের মতো গাড়ি চালিয়ে পৌছালো আমাদের হোটেলে। হোটেলের নাম বিল্লাহ রিসোর্ট। আস্ত ছয় তলা একটা বাড়ি। সামনে ফুল দিয়ে সাজানো, রং বেরংয়ের লেখা।
হোটেলটির দৃশ্য দেখেই আমি অভিভূত। কাঠের সাইনবোর্ড। ঘরের নিচতলা গ্লাস দিয়ে বাঁধাই করা চারপাশ। নিচতলা রেস্তোরাঁ, উপরে আবাসিক হোটেল। রেস্তোরাঁতে দুটি অংশ একটি এসিবিহীন খোলামেলা, ভেতরের অংশটি এসিযুক্ত। ভেতরে ম্যানেজার বসেন, সামনে কম্পিউটার নিয়ে। দেখলাম একজন হিজাবপরা নারী কম্পিউটারের সামনে বসা। সে তখনকার দায়িত্বরত ম্যানেজার। আমি সালাম দিলাম। হালকা মুচকি হেসে তাকালেন কিন্তু সালামের জবাব শুনিনি। নিশ্চয়ই মনে মনে নিয়েছেন। কত শত লোক আসা যাওয়া করে। বাংলাদেশিদের জন্য বাংলাভাষার লোক আছে তাতে বেশ ভালো লাগলো। এগিয়ে এলো বাংলাদেশি সালাউদ্দিন, সে পরিচিত হলো, তার গ্রামের বাড়ি ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায়। খুব মিশুক হাসিখুশি ছেলে। তিন দিনের শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথে ছিলো। দীর্ঘদিন সে এখানে থাকে। এই হোটেলে চাকরি করে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম পরে তার সাথে কথা বলে মালদ্বীপের মুসলিমদের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানা যাবে। সালাউদ্দিন আমাদের ব্যাগসহ তিন তলায় নিয়ে রুম খুলে দিলো।
রুমটা চমৎকার। এক রুমে দুটি সিট। খাটের নমুনাই মুগ্ধ করে। কপি চিনি হালকা বিস্কুট এবং পানির বোতল রয়েছে। চা বানানোর জন্য আছে মগ হিটার। খাদ্য গরম করার জন্য মাইক্রো ওভেন। কাঠের আলমিরা ও জামা রাখার হ্যাংগার। বিশাল ড্রেসিং টেবিল দেখে নিজেকে নিয়ে নিজে গবেষণা করতে পারবেন। দক্ষিণ পাশে খোলা জানালা ও ছোট একটি বারান্দা রয়েছে। বারান্দাতে দাঁড়ালে সামনের বিশাল খোলা জায়গা দেখা যায়।
রাস্তার দিকে তাকালে দেখা যায় হোটেলের সামনে লাইন ধরে দাঁড়ানো শতাধিক স্কুটি। শহরের প্রায় প্রতিটি পরিবারে রয়েছে স্কুটি। ছেলে মেয়ে বুড়ো সবার জন্য স্কুটি রয়েছে। দ্বীপের কারণে এখানে অন্যান্য যানবাহন কমই দেখা গেলো। সবার নিজস্ব ¯কুটি ব্যবহার সহজ। বাসা বাড়ি, স্কুল কলেজ মসজিদ মন্দির সংস্কৃতি কেন্দ্র সবগুলোর সামনে সারি সারি স্কুটি দাঁড়ানো দেখা যায়। যে এলাকায় স্কুল আছে সেখানের আশেপাশে কোনো বাসা বাড়ি নেই। কোন স্কুলের সামনে অপেক্ষায় কোনো অভিভাবক নেই, সবাই স্ব স্ব কর্মতে ব্যস্ত থাকে। তবে একটা বিরাট বৈষম্য সেখানে, কোন ভিনদেশি বাচ্চাদের পড়াশোনার সুযোগ নেই। সব স্কুলে শুধু মালদ্বীপের স্থায়ী নাগরিকদের সন্তানরা পড়াশোনা করে। আর কেউ করতে পারে না। অবশ্য ভিনদেশী যারা সেখানে শ্রমিক, তাদের খুব কম লোকেরই ফ্যামেলি থাকে। ফলে বিদেশীদের বাচ্চারাও সেখানে নেই বললেই চলে।
এয়ারপোর্টের কাছেই হোলহুমালে দ্বীপ। সাধারণত যারা কম মূল্যের প্যাকেজ ট্যুরে ঘুরতে আসেন তাদেরকে এই দ্বীপেই হোটেল দেয়া হয়। তাই এয়ারপোর্টেও কাছাকাছি এই দ্বীপে মানুষের সমাগম বেশি। এখানে কেউ ইচ্ছা করলে এয়ারপোর্ট থেকে হেঁটেও চলে আসতে পারবেন। একটি মাত্র সেতুর এপিঠ ওপিঠ। তবে মজার বিষয় হলো সেখানে সাগরের ঢেউ আর গর্জন ভেঙ্গে চলে সারাক্ষণ, রাত দিন সব সময় জেগে আছে এসব দ্বীপ। ক্লান্তিহীন ঢেউয়ের পরে ঢেউ ছলাৎ ছলাৎ করে কূলে এসে বালির সাথে মিশে যাচ্ছে। সুরম্য সৌন্দর্যে ঘেরা এই দ্বীপগুলো মানুষকে আকর্ষণ করে, বিমোহিত করে। ঘুরে ফিরে দেখতে গেলে মনে পড়ে আল্লাহ কুরআনে বলেছেন - কুল সিরু ফিল আরদে ওয়াবতাগু মিন ফাদলিল্লাহ। তোমরা দেখো এবং আল্লাহর নেয়ামত তালাশ করো। সত্যি সব আল্লাহর অপূর্ব নেয়ামত। সাধারণত জ্ঞান বৃদ্ধির জন্যও ভ্রমণের গুরুত্ব অপরিসীম। কবি নজরুল বলেছেন, ‘হয়তো দেখো নয়তো লেখো’।
(চলবে)