আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন
(শেষাংশ)
অর্থাৎ হয়তো অনেক লেখাপড়া করে বিশ্ব সম্পর্কে জানো, নয়তো দেশ বিদেশ ঘুরে পৃথিবীর জ্ঞান অর্জন করো।
আমাদের হোটেলটি দ্বীপের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত, ফলে বাসা থেকে বের হলেই সমুদ্র দেখা যায়। আমরা একটু রেস্ট নিয়ে খাওয়ার জন্য বের হলাম। আগেই শুনেছি সবখানে বাঙালী হোটেল থাকে। বাসা থেকে বের হলেই দুই গলি পর রাজ্জাকের হোটেল। সেখানে সবাই ভাত খেলাম, আমাদের কর্তাবাবুরা বিল চুকিয়ে দিলো। আমি মালদ্বীপের মুদ্রাটা ধরেও দেখতে পেলাম না। ওরা ঠান্ডা খায়, আন্ডা খায়, আরো কত কিছু খায়, আমি ওসব খাই না। ফলে তারা যত বিল বলে ততই সই। সেখানে বাংলাদেশি টাকায় তিনশো সাড়ে তিনশো টাকায় গরু বা মাছ দিয়ে বেশ খাওয়া যায়। সব পুরুষ চালিত হোটেল। খাওয়ার পর বের হলাম দ্বীপটি দেখতে। চলার পথে যা দেখলাাম কিছু কিছু হোটেল দেখেছি নারী চালিত। যেগুলো মালদ্বীপের নাগরিকরা পরিচালনা করে। ইন্ডিয়ান সুন্দরী মেয়েরাও এসব পরিচালনার দায়িত্বে আছে। সেখানে আমাদের দেশের মতো গ্রীল, চাপ নানরুটি এগুলো পাওয়া যায়। পানের বাহার একবারে শ্বশুরবাড়ির মতো, একটি পান খেয়েছি যা আমাদের দেশের পঞ্চাশ টাকার সমান দামের। যেমন বড় তেমনি কড়কড়ে মচমচে পান। সেখানে যে সুপারী দিয়েছে তা আমাদের দেশের অন্তত দশ খিলি পান খাওয়া যাবে। দস্তুর মতো একটি নাস্তার প্লেট পুরা। কালো জিরা, চুন, সুপারী, খয়ের। পানের নামে দোকানের বাইরে নারিকেল গাছতলায় প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিলে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয়। সুন্দরী সেলসম্যান টেবিলে খাওয়া নিয়ে আসে, সেখানে আলো আঁধারী খেলা করে। দূরের সোডিয়াম লাইটের আলো গাছের পাতা ভেদ করে যতটুকু আসতে পারে ততটুকুই আলো। স্লীম চুল খোলা সুন্দরীরা সেখানকার বয় এর কাজ করে। অনেক দোকানে দেখেছি এসব মেয়েরা লাল থ্রিপিস পরা, বা লাল স্কীন টাইস ও লাল জ্যাকেট পরে থাকে। আবার ছাই রঙের স্কার্ফ পরা মেয়েরাও আছে, যাদের দেখলে বুঝা যায় ওরা কত ধার্মিক।
হুলহোমালে দ্বীপে একটি পার্ক রয়েছে, নাম সেন্ট্রাল পার্ক। এটি দ্বীপের মাঝখানে অবস্থিত। সবুজ ঘাসে ঘেরা এই পার্কের পাশে একটি কৃত্রিম লেক তৈরি করা হয়েছে। পুরা দ্বীপের চারপাশে নারিকেল গাছ এবং বিভিন্ন রকমের বড় বড় গাছ দিয়ে সৌন্দর্যবৃদ্ধি ও দ্বীপের মজবুতির কাজ করা হয়েছে। এছাড়া দ্বীপের কূল থেকে প্রায় একশো গজ দূরে পাথর দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে যেন দ্বীপে সরাসরি কোন ঢেউ আঘাত করতে না পারে এবং দ্বীপের চারপাশে কূলে কূলে পর্যটকরা যেন গোসল করতে পারে। সাগরের আঘাতে যেন কেউ হারিয়ে না যায় সে জন্য বড় বড় পাথর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাথরে কেউ কেউ বসে বা শুয়ে শুয়ে পানির ঢেউয়ের মজা পায়। তবে বড় মজার বিষয় হলো মালদ্বীপে কিছুক্ষণ পরপর হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি আসে। কতবার যে এক মিনিটের বৃষ্টিতে ভিজেছি জানা নেই। দ্বীপের পূর্ব পাশে সাজানো আছে স্টিমার সেখান থেকে ভাড়া নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাওয়া যায়। ডলফিনের দ্বীপে একবার যতজনই যাক না কেন বাংলাদেশি ৭০০ টাকা পরিমাণ মালে ডলার দিয়ে টিকেট কাটতে হয়।
আমাদের দ্বিতীয় দিন ছিলো শুক্রবার। তারা আজানের কিছুক্ষণ পরেই নামাযের খুতবা নিয়ে দাঁড়ায়। এবার বলি সেখানকার ইসলামের কথা। আন্তর্জাতিক তথ্যমতে, মালদ্বীপ শতভাগ সুন্নী মুসলিমের দেশ, দ্বীপের প্রতিটি ঘরেই পাওয়া যায় ধর্মভিত্তিক বই। ইসলাম তাদের আদি সংস্কৃতির অংশ নয় কিন্তু এই ধর্মকে বিষয়বস্তু করে গড়ে ওঠেছে এখানকার প্রায় সকল লিখিত সাহিত্য। ধর্মীয় রচনার মধ্যে মোহাম্মদ জামিলের রসুলের জীবনী নিয়ে লেখা ‘সিরাত’ সবচেয়ে জনপ্রিয় বইয়ের একটি। হোসেইন সালাউদ্দিন আরেকজন প্রভাবশালী লেখক। কবি, গদ্য সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবী,যার লেখা ‘বদু টাকুরুফানো স্টোরি’ মহাকাব্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। অন্য দেশের লোককাহিনিগুলোকে মালদ্বীপীয় আবহে অনুবাদ করে তিনি তাঁর কাজে নিজস্বতা তৈরি করেছেন।
জানা যায় মালদ্বীপে অধিকাংশই আহলে হাদীসের অনুসারী। এদের আর সুন্নীদের আমলে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। সেখানে মসজিদের ইমাম সাহেব হাফ শার্ট পরে নামায পড়ান এতে কারো কোনো মন্তব্য নেই। তারা হয়তো শুরু থেকে এ রকমই দেখে আসছে তারা আর কি মন্তব্য করবে? সেখানে হুজুর আর সাধারণ লোকের প্রার্থক্য বুঝা মুশকিল। আমি রাজধানীতে আসরের নামায পড়েছি জামাতের সাথে। সেন্ট্রাল কমিউনিটি মসজিদের ইমামের গায়ে পান্জাবী ছিলো। মোয়াজ্জিন একামত দিলেন তাকবীরগুলো একবার একবার পড়ে। ইমাম সাহেব হাদীসের সাব্বু সুফুফাকুম ফাইন্না তাসবিয়াতাস সালাহ, পড়ে আল্লাহু আকবার বলে সালাত শুরু করলেন। তৃতীয় রাকায়াত শুরুতে দাঁড়িয়ে কেরাত শেষ করে রুকুর আগে হাত তুলে মোনাজাত শুরু করেছেন। লম্বা মোনাজাত, আরবীতে। আমাদের জুমার মোনাজাতের মতো লম্বা। সেই মোনাজাতে ফিলিস্তিনের জন্যও দোয়া করা হলো। তারপর শহরের ভেতরের এক ঐতিহ্যবাহী মসজিদে মাগরিবের নামায পড়েছি হাফ শার্ট পরা এক মাওলানার পেছনে। তিনি সেখানকার নির্ধারিত ইমাম। সামনের মুসল্লাতে দাঁড়ানোর আগ পর্যন্ত আমি বুঝতেই পারিনি তিনি ইমাম। দেখতে আমাদের গ্রামাঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষের চেহারা। মুসুল্লি আমরা তিনজনসহ হয়তো দশজন হবেন। মসজিদটি ১২ ফিট বাই ১৮ ফিট হতে পারে। তাছাড়া সরকারের ভালো বাজেট না থাকায় তাদের বেতনও কম। তারা শুধু দ্বীনের খেদমতে এসব দায়িত্ব পালন করে আাসছেন বলে জানালেন। এই মসজিদটি শহরের একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। প্রায় তিনশো বছর পুরানো, অনেকগুলো কবর রয়েছে মসজিদের পাশে। অনেকে শুধু দেখতে আসেন। ইমাম সাহেবের সাথে আরবীতে টুকটাক কথা বললাম। হাফ শার্ট পরে নামায পড়ানোর বিষয়ে ‘মা হাযাততাকওয়া’? এটা কেমন তাকওয়া জিজ্ঞাসা করলে তিনি চুপসে গেলেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন তাকওয়ার কথা বলছি। পরের দিন আসরের নামায পড়েছি হুলহোমালে দ্বীপে সেখানেও হাফশার্ট পরা লোকই ইমামতি করছেন দেখে তাকেও একই প্রশ্ন করেছিলাম কিন্তু তিনিও চুপ থাকলেন। আমাদের দেশে হলে মুসুল্লিরা হাজার প্রশ্নে জর্জরিত করতো, তার পেছনে নামায পড়াতো দূরের কথা ফতোয়া দিয়ে তার গোষ্ঠী উদ্ধার করে দিতো।
মালে সিটিতে ইসলামিক সেন্টারে নিয়মিত মহিলারাও জামাতে নামায পড়ে। মহিলাদের মাথায় স্কার্ফ আছে। এই পোশাকে তারা স্কুটি চালিয়ে শহরে চলাচল করে, নামায পড়তে চলে আসে। সেখানে একজন লোকের সাথে পরিচয় হলো তার নাম ফারুক। তিনি নিজেকে ক্বারী ফারুক বলে পরিচয় দিলেন। তিনি জানালেন তিনি পাকিস্তানী নাগরিক। তার গায়েও হাফ শার্ট, পরনে প্যান্ট। ইউরোপেও নাকি একই অবস্থা। অনেক ইমাম শার্টপ্যান্ট টাই পরে ইমামতি করেন।
আমদের ভ্রমণের তৃতীয় দিন আমাদের চলে আসার দিন। সকালে হালকা বৃষ্টির মাঝে আমাদের গাড়ি চলে এলো। সকালের ফ্রি নাস্তা সেন্ডুইচ আর একটি কলা খেয়ে আমাদের নির্ধারিত মাইক্রোতে উঠলাম। সেই ব্রীজ মাড়িয়ে সাগরের দৃশ্য দেখতে দেখতে এয়ারপোর্ট চলে এলাম। খুব অল্প সময়ে আমাদের ইমিগ্রেশান করে বিমানে উঠে বসলাম। বিমান নির্দিষ্ট সময়ে আকাশে উড়াল দিলো। নিচে তাকিয়ে স্মৃতির এ্যালবাম হুলহোমালে দ¦ীপকে আরেকবার হাজার মাইল উপর থেকে দেখলাম। হাত নেড়ে বললাম গুডবাই মালদ্বীপ। আলহামদুল্লিাহ খুব ভালো সময় কেটেছে তিন দিন। আল্লাহর অনেক নেয়ামত দেখেছি। মালদ্বীপ দেশ ও তাদের সংস্কৃতি খুব ভালো লেগেছে। একবার মনে হয়েছে এত খোলামেলা জায়গার মতো যদি আমাদের দেশকেও সাজানো যায় তাহলে তাদের মতো বাংলাদেশও পর্যটন খাত দিয়ে দেশ চালাতে পারবে, আর কোন দিক তাকাতে হবে না।