মোহাম্মদ জাফর ইকবাল, সুনামগঞ্জ (হাওড়) থেকে ফিরে : পর্যটন সম্ভাবনার অন্যতম জনপদ সুনামগঞ্জ। সীমান্তবর্তী এ জেলায় অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। হাওড়, নদী, পাহাড়ের সৌন্দর্যের এক অনন্য মেলবন্ধন এখানে। হাওড়ের পাশাপাশি ভ্রমণ পিপাসুদের জন্য জেলাজুড়ে রয়েছে বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান। যেগুলো ঘুরে মুগ্ধতায় মনভরে, নয়ন জুড়ায় পর্যটকদের। এর বাইরে মরমি সাধক হাসন রাজা, বৈষ্ণব কবি রাধারমণ দত্ত, বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমসহ অসংখ্য বাউল-কবিদের আবাসভূমি এই জেলায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি এসব মনিষীদের সহজিয়া জীবন, মনমজানো গানও মানুষকে টানে সুনামগঞ্জে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি সহায়তা পেলে এই সুনামগঞ্জ দেশের অন্যতম পর্যটন স্পটে পরিণত হতে পারে।

সূত্র মতে, ভৌগোলিক দিক থেকে হাওড় দেশের অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে আলাদা। মানুষের জীবনযাত্রা ও আর্থসামাজিক পরিস্থিতিও এখানে ভিন্ন। বছরের বেশির ভাগ সময় হাওড় থাকে পানিমগ্ন। থই থই জলের ওপর তখন ছোট ছোট গ্রামগুলো ভাসে দ্বীপের মতো। আবার শুকনা মৌসুমে মাইলের পর মাইল হাঁটাপথ। মানুষের যোগাযোগ-যাতায়াত এখানে কঠিন। এই কঠিন যোগাযোগচিত্র বোঝাতে বলা হয়ে থাকে ‘বর্ষায় নাও আর হেমন্তে পাও’। তবে এখন পরিস্থিতি অনেকটা বদলেছে। মানুষের জন্য যোগাযোগ সহজ করার চেষ্টা হচ্ছে। পাশাপাশি নানা উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে হাওড়কেন্দ্রিক পর্যটন সম্ভাবনা বিকাশের।

সুনামগঞ্জে প্রতিবছর যেসব পর্যটক ঘুরতে আসেন, তার বেশির ভাগই তাহিরপুর উপজেলায়। এই উপজেলায় পাশাপাশি বেশ কয়েকটি দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যেগুলো পর্যটকদের কাছে খুবই প্রিয়। পর্যটকেরা সহজেই এসব ঘুরে দেখতে পারেন। এই উপজেলায় একসঙ্গে টাঙ্গুয়ার হাওড়, এই হাওড়ের উত্তর পাড়ের শহীদ সিরাজ লেক, নিলাদ্রী ডিসি পার্ক, স্বাধীনতা উপত্যকা, লাকমা ছড়া, টেকেরঘাটের নয়নাভিরাম ছোট ছোট টিলা, স্মৃতিসৌধ, মহেষখলার মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ, বারিক টিলা, শাহ আরেফিনের (র.) আস্তানা, শ্রী অদ্বৈত মহাপ্রভুর মন্দির, শিমুল বাগান এবং যাদুকাটা নদের অপরূপ সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। পাশেই হাতছানি দেয় ভারতের মেঘালয় পাহাড়। সুনামগঞ্জে প্রত্নতাত্ত্বিক দর্শনীয় স্থানের মধ্যে রয়েছে সদর উপজেলার গৌরারং জমিদারবাড়ি, দোয়ারাবাজার উপজেলার দোহালিয়া জমিদারবাড়ি, ধরমপাশা উপজেলায় সুখাইড় জমিদারবাড়ি, তাহিরপুর উপজেলায় হলহলিয়া রাজবাড়ি, দিরাই উপজেলা ভাটিপাড়া জমিদারবাড়ি। লোকজ ট্যুরিজম স্থান হিসেবে ঘুরে দেখা যায়, জেলা শহরে থাকা মরমি সাধক হাসন রাজার সমাধি ও হাসন রাজা মিউজিয়াম, দিরাই উপজেলায় বাউলসম্রাট শাহ আবদুল করিমের সমাধি ও জাদুঘর, জগন্নাথপুর উপজেলায় লোককবি রাধারমণ দত্তের সমাধি।

এছাড়া ঐতিহাসিক স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে দোয়ারাবাজার উপজেলায় বাঁশতলা (হকনগর) শহীদ স্মৃতিসৌধ, সদর উপজেলায় ডলুরা স্মৃতিসৌধ, শিল্পবিষয়ক পর্যটন স্থানের মধ্যে দেশের প্রথম স্থাপিত রাষ্ট্রায়ত্ত ছাতক সিমেন্ট কারখানা, লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানা, বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার মিছাখলী রাবার ড্যাম, ধর্মীয় পর্যটন স্থান হিসেবে পাগলা বড় মসজিদ, পণতীর্থ ধাম, আছিম শাহের মাজার, সদর উপজেলার সীমান্তবর্তী নারায়ণতলা মিশন এলাকা। সদর উপজেলা সীমান্তবর্তী ডলুরা এলাকার পাশেই রয়েছে সীমান্ত হাট।

সুনামগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. মোহাম্মদ ইলিয়াস মিয়া জানান, জেলায় ঘুরতে আসা পর্যটকদের জন্য সরকার নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় নৌকা তৈরি, হাওড়ের প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় সচেতনতামূলক নানা প্রচারণা ও নির্দেশনা প্রদান, টেকেরঘাট এলাকায় কটেজ তৈরি, বারিক টিলা, শহীদ সিরাজ লেকে পর্যটকদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করা, জেলায় থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান, ঐতিহাসিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলো সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া , দোয়ারাবাজার উপজেলার বাঁশতলা স্মৃতিসৌধ এলাকায় পর্যটকদের থাকার জন্য অতিথিশালা অন্যতম। তিনি বলেন, পর্যটকদের অন্যতম সমস্যঅ হচ্ছে যাতায়াত ব্যবস্থা। এটিতে সরকার নজর দিয়েছে। তিনি বলেন, এ জেলায় পর্যটন খাত উন্নত হলে এখানে দেশি-বিদেশি পর্যটকের সংখ্যা বাড়বে। এতে স্থানীয় মানুষের কর্মসংস্থান হবে, আয় বৃদ্ধি পাবে। স্থানীয় উদ্যোক্তা তৈরি হবে। পাশাপাশি পর্যটকেরাও সুনামগঞ্জের দর্শনীয় স্থান ঘুরে দেখার সঙ্গে সঙ্গে হাওড় জনপদের মানুষের জীবন প্রকৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ধারণা পাবেন।

তাহিরপুর উপজেলার বাসিন্দা পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার নেতা কাসমির রেজা বলেন, সুনামগঞ্জে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ পর্যটক আসেন। বিশেষ করে টাঙ্গুয়ার হাওড়ে। টাঙ্গুয়ার হাওড় এবং সীমান্ত এলাকায় কাছাকাছি থাকা দর্শনীয় স্থানগুলোতে যাতায়াতের জন্য সংযোগ সড়ক তৈরি করতে হবে। টাঙ্গুয়ার হাওড়ে ইঞ্জিনচালিত নৌযান প্রবেশ বন্ধ করতে হবে। আমরা চাই, হাওড়ে পরিবেশবান্ধব পর্যটনের বিকাশ। পর্যটনশিল্পের বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি গুরুত্ব দিতে হবে।

ঘুরতে আসা পর্যটকরা বলেন, সুনামগঞ্জ পর্যটনের অপার সম্ভাবনার জায়গা। এই সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে সরকারের উদ্যোগের কোনো বিকল্প নেই। এখানে যোগাযোগ, অবকাঠামো, পর্যটকদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা, প্রয়োজীয় নিরাপত্তার বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করা দরকার।

কলেজ পড়ুয়া স্থানীয় নুরুন নবী বলেন, আমাদের সুনামগঞ্জে দেখার মত অনেক কিছু এখন লুকিয়ে আছে। যেমন আমাদের গ্রামের লাকমাছড়া জায়গাটা এতো দারুণ, যা বলে বুঝানো যাবে না। লাকমাছড়া নতুন পর্যটন স্পট। হাও[ে অনেকেই আসেন কিন্তু খুব কাছে এতো সুন্দর একটা জায়গা অনেকেই মিস করেন। আর যারা জানেন তারা এসে ভ্রমণ করে অনেক আনন্দিত হন। এর আশপাশে আরও কয়েকটি দর্মনীয় স্থান রয়েছে। এসব জায়গার পরিচিতি বাড়ানো গেলে হয়তো সব সময় এখানে পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকবে।

গ্রামের প্রাক্তন শিক্ষক মিজানুর রহমান বলেন, এখানকার পরিবেশ, পানি, পাহাড়, সব কিছুই অসাধারণ। দেশের দূর থেকে যে পর্যটকরা সুনামগঞ্জ ঘুরতে এসে পাহাড় থেকে নেমে আসা স্বচ্ছ পানিতে একটা ঝাঁপ দেন, আমি আশাবাদী সারাদিনের ক্লান্তি দূর করে দিবে প্রকৃতির ছোঁয়া। বর্ষায় সিলেটের বিছানাকান্দির চেয়ে সুন্দর। কিন্তু এখানে ভালো মানের খাবার ও কাপড় পরিবর্তন করার ব্যবস্থা, রাস্তাঘাটের উন্নয়ন করা হলে আশা করি দেশ বিদেশের প্রকৃতিপ্রেমীরা নিয়মিত ঘুরতে আসবেন।

সুনামগঞ্জের সৌন্দর্য দিনদিন জনপ্রিয় হয়ে উঠছে দেশ-বিদেশের ভ্রমণপিপাসুদের কাছে। ছুটির দিন ছাড়াও প্রায় প্রতিদিনই পর্যটকেরা সুনামগঞ্জের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে ছুটে আসেন। অনেকেই বলছেন, যাতায়াত, স্যানিটেশন ও আবাসন ব্যবস্থাপনার উন্নতি ঘটানো গেলে এটি এশিয়ার সেরা পর্যটন স্পট হতে পারে। তারা বলছেন, এখানকার নৈসর্গিক সৌন্দর্য সবকিছু ছাড়িয়ে যায়। সরকারের এ জেলার প্রতি আরও নজর দেওয়া উচিত বলে তারা মনে করেন।

সূত্র মতে, হাওড়, বাওর, ও অপেক্ষাকৃত নিচু অঞ্চল নিয়ে গঠিত এ জেলার বেশিরভাগ এলাকা ৭-৮ মাস পানিমগ্ন থাকে। বর্ষায় সমুদ্রের মতো ঢেউ খেলে এবং গ্রামগুলোকে মনে হয় এক একটি ছোট-ছোট দ্বীপ। বিরল প্রজাতির মাছ ও পাখির স্বর্গরাজ্য টাঙ্গুয়ার হাওড়। এখানে প্রায় ২০০ প্রজাতির মাছ, ১৫০ প্রজাতির উদ্ভিদ, ২০৮ প্রজাতির পাখি পাওয়া যায়। সম্প্রতি হাওর পর্যটন উন্নয়নে সমীক্ষার ফল প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ ট্যুরিজম বোর্ড এবং বাংলাদেশ ইনবাউন্ড ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন (বিডি ইনবাউন্ড)। তারা এখানকার পর্যটন বিকাশে ২০ দফা সুপারিশ দিয়েছে। তারা বলেছে, অঞ্চলটিকে কয়েকটি জোনে ভাগ করে উন্নয়ন ব্যবস্থাপনায় নিয়ে এসে সব স্টেক হোল্ডারদের সম্পৃক্তকরণ এবং বেসরকারি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্টকরণ করা গেলে এটি আরও দর্শনীয় স্থানে পরিণত হবে।