আবুল খায়ের নাঈমুদ্দীন

মালদ্বীপের নাম শুনলেই সবার ভিতরে একটা আকর্ষণ লক্ষ্য করা যায়। আহা কি অপূর্ব সৌন্দর্যের ভূমি। দ্বীপে দ্বীপে ভরা মালদ্বীপ। এশিয়ার সবচেয়ে ছোট দেশ মালদ্বীপ, কিন্তু বিশে^র সব দেশের লোকেরা মালদ্বীপে ভ্রমণের জন্য এক নিরাপদ ও সৌন্দর্যের দেশ মনে করে। ভারত সাগরের কুল ঘেঁষে শ্রীলংকা ও মালদ্বীপ অবস্থিত। মালদ্বীপের পুরাটাই দ্বীপরাষ্ট্র। কতগুলো দ্বীপ আছে এর সঠিক সংখ্যা নেই। সরকারি হিসেবে দ্বীপ সংখ্যা ১১৯২ এর অধিক, আবার কেউ বলছেন ১৪০০। তবে ছোট ছোট হাজারের অধিক দ্বীপ রাষ্ট্র মিলে মালদ্বীপ। মালদ্বীপ সম্পর্কে ইবনে বতুতা বলেছিলেন ‘রাজপ্রাসাদের দ্বীপ। বার শতকের শেষের দিকে মালদ্বীপে ইসলাম ধর্ম সম্প্রসারিত হতে থাকে ১৯৬৫ সালের ২৬ জুলাই দ্বীপসমূহ পূর্ণ রাজনৈতিক স্বাধীনতা লাভ করে। রাষ্ট্রীয় ভাষা দিভেহি, এটি ইন্দো-আর্য ভাষা। মালদ্বীপ স্থানীয়দের কাছে দিভেহি রাজ বা দ্বীপের রাজ্য নামে পরিচিত শত বছর ধরে। আগে দ্বীপের ঘরে ঘরে গল্পকথককে আনা হতো যারা সরাসরি দর্শকের সামনে লোকগল্পগুলো বলে শোনাতেন। কিন্তু বিশ শতকে মালদ্বীপকে ইসলামিক আধুনিক রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে জীবন ধারায় যে পরিবর্তন আনা হয় তার ফলে দেশটা নতুন যুগে প্রবেশ করেছে। এখন আর সে সব নিয়ম নেই।

পৃথিবীর স্বর্গরাজ্য হিসেবে ধরা হয় কাশ্মীরকে। রাজ্যটিকে প্রায়শই “পৃথিবীর স্বর্গ” উল্লেখ করা হয়। তবে ফিলিপাইন ও সুইডেনের সৌন্দর্য হয়তো তারচেয়েও বেশি। কিন্তু দ্বীপরাষ্ট্র হিসেবে মালদ্বীপ পৃথিবীর অন্যতম সৌন্দর্যের দ্বীপ এ কথা অস্বীকার করার সুযোগ নেই। একটি মুসলিম রাষ্ট্র হয়েও এরা যেভাবে নিজেদেরকে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেছে তার কাহিনী খুবই চমৎকার। এখানে রাষ্ট্রকর্তৃপক্ষ তেমন খুব বেশি সাজাতে হয়নি, প্রায় সবই প্রাকৃতিক আল্লাহর দেয়া নেয়ামতে সেজে আছে। আমাদের বাংলাদেশের সুন্দরবন, জাফলং, মাধবকু-, কুয়াকাটা, সেন্টমার্টিন, নিঝুম দ্বীপে যেমন একেকটির সৌন্দর্য একেক রকম তেমনি এখানেও হাজার দ্বীপের মধ্যে একেকটির আকর্ষণ একেক রকম। আমাদের দেশে একটি ইউনিয়নকে যেমনি ঘন্টা দুয়েক হেঁটে হেঁটে দেখলে শেষ সীমানায় পৌঁছে যাওয়া সম্ভব, তেমনি মালদ্বীপেও এক একটি দ্বীপকে আলাদা করে হেঁটে হেঁটে দেখে নেয়া সম্ভব এবং এতে বেশি সময় লাগে না।

স্বাধীনতা লাভ করে ঃ ১৯৬৫ সালে বৃটিশদের হাত থেকে।

মালদ্বীপের আয়তন ঃ ২৯৮ বর্গকিলোমিটার, (১১৫ বর্গ মাইল)

রাজধানীর নাম ঃ মালে সিটি।

দ্বীপ সংখ্যা ঃ ১১৯২- ১৪০০

জনসংখ্যা ঃ ২০২৪ সালের হিসাব মতে ২ লাখ ২০ হাজারের বেশি।

প্রধান ভাষা ঃ দিভেহী ইন্দো- ইউরোপীয় ভাষা ছাড়াও আরবী, হিন্দি,

মুদ্রার নাম ঃ রূপাইয়া ডলার বা রূপী। স্থানীয়ভাবে লরীও বলে থাকে।

গড় আয়ু ঃ ৭১.৮ বছর

প্রধান ধর্ম ঃ ১০০% মুসলিম বলে থাকে। কিন্তু হিন্দু বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান রয়েছে।

আমার এ ভ্রমণে সাথে ছিলেন কাবার পথে ট্রাভেল এজেন্সীর কর্ণধার নুরুজ্জামান ভাই, এখলাসপুরের বাবু ও সাখাওয়াত ভাই। নুরুজ্জামান ভাই আমার ভিসা ও টিকেট ব্যবস্থা করেছিলেন। কিন্তু ভ্রমণে যাওয়ার পূর্ব মুহূর্তে জানতে পারলাম তিনিও হজ¦ ওমরা ব্যতীত বহির্বিশ্বে ভ্রমণে নতুন। ফলে নতুনদের যে সব সমস্যা হয় তাঁর উপর ভরসা করে আমাদেরও তা হয়েছে। যেমন ভ্রমণের পূর্ব প্রস্তুতি তেমন নেই তাঁর, ভিসা অনলাইন কিন্তু সেটি প্রিন্টও করেননি, আমি তাৎক্ষণিক বসিয়ে রেখে করিয়েছি। একদিন আগে জেনেছি তাঁর সাথে আরো দুইজন আছেন। ডলার ইনডোজমেন্টও আগের দিনই করেছি, তিনি ইমোগা, ই-ভিসা অনুমতি স্বরূপ, তাও প্রিন্ট করেননি। যাই হোক নির্দিষ্ট তারিখে আমরা যাত্রা করলাম। ইমিগ্রেশনে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতে হয়েছে। পরে তাৎক্ষণিক অফিসে ফোন করে ওয়াটসাপে পাঠানোর পর আমাদের কাজ সহজ হয়েছে। ঠিক একই সমস্যা হয়েছে আসার সময়। যখন এয়ারপোর্টের ভিতরে প্রবেশ করে লাগেজ স্কেন করালাম তখন কাস্টম অফিসার বললো ‘সি ইমোগা’ আহারে কি সমস্যা! আমরা হলাম ভ্রমণের জন্য নতুন মানুষ। আগে শুনেছি ফেরার সময় ইমোগা লাগে না, এখন বলছে লাগবে। অফিসারের দিক নির্দেশনা অনুযায়ী তাৎক্ষণিক ইমোগা করে নিলাম।

আমাদের ফ্লাইট ছিলো বেলা ২টায় কিন্তু কোন সমস্যায় সেটাকে করা হয়েছে সন্ধ্যা ৬টায়। তাই শ্রীলঙ্কান এয়ারলাইনস কর্তৃপক্ষ দুপুরের যে খাওয়া দিয়েছেন তা ছিলো অনেক রুচিশীল ও সুস্বাদু। বিমান লেটের কারণে যে কষ্ট এসেছিলো মনে, সেই কষ্টটা খাওয়ার ফলে ভুলে গেছি। কিন্তু ৬টায়ও ছাড়তে পারেনি, ছেড়েছে ৭টায়। সন্ধ্যা সাতটায় ছেড়ে যাওয়ার পর বিমানে যে খাওয়া দেয়া হয়েছে তাও ছিলো যথেষ্ট। সেখানেও মিনি প্যাকেটে মোরগ পোলাও ছিলো। মালদ্বীপের জন্য শ্রীলংকায় ট্রানজিট রয়েছে, এক দু‘ঘন্টার কিন্তু শ্রীলংকা পৌঁছতে রাত প্রায় এগারোটা হওয়াতে আমাদের ট্রানজিটের স্থান শ্রীলঙ্কার রাজধানী কলম্বোতে এক রাত থাকতে হয়েছে। ফলে আমাদের পাসপোর্টে প্রবেশ ও বাহির নামে আরো দুটো সীল যুক্ত হলো। যা অনাকাক্সিক্ষত পুরস্কারের মতো।

পরদিন ভোর সকালে আমাদেরকে শ্রীলংকা সরকারি হোটেল থেকে মিনি বাসে করে নিয়ে আসা হলো এয়ারপোর্টে। সকাল ছটায় ফ্লাইট হওয়ার কথা থাকলেও নটায় রওয়ানা হয়ে বেলা ১১ টায় মালদ্বীপ পৌঁছে দিলো। আমি জেদ্দা, শারজাহ, দুবাই, বাংলাদেশ, শ্রীলংকায়, ঢাকাসহ যত এয়ারপোর্ট দেখেছি কোথাও এত সুন্দর ও মুগ্ধকর পরিবেশ দেখিনি। কেন জানি মালদ্বীপের এই ছোট এয়ারপোর্টটাই আমার কাছে সেরা মনে হয়েছে। একদম সাধারণ কিন্তু পানিতে ভাসমান মনে হওয়ায় অসাধারণ মনে হয়েছে। বিমান থেকে সাগরকে একটি নীল বিলের মতো দেখায়। এখানে ভ্রমণকারীরা সহজেই সাগরের ছোঁয়ায় ভিজতে পারেন, মনকে ভাসাতে পারেন, ঢেউয়ের তালে তালে দোল খেতে খেতে নিজেও ভাসতে পারেন। কখন কি করে সাগরের ঢেউ, হঠাৎ জানে না তো কেউ।

মালদ্বীপ এয়ারপোর্টটি দেখতে যেমন শ্রেষ্ঠ শিল্পী দ্বারা আঁকা ডিজাইন করা তেমনি তার ভেতরের দৃশ্য। থরে থরে সাজানো ডেস্কগুলো। ইমিগ্রেশন থেকে তাদের সৌজন্যতা, সুন্দর ব্যবহার ও আতিথেয়তা শুরু। অল্প কয়টি প্রশ্ন, কেন এসেছেন, হোটেল বুকিং করেছেন? কতদিন থাকবেন? ডলার এনেছেন? তারপরই সীল মেরে দিবে। এখান থেকে বের হলেই অতিথি আপ্যায়নের মতো মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকাতে হয় স্বচ্ছ পানির দিকে। কখনো হালকা ঢেউ খেলে কখনো নীরব নিথর প্রকৃতির মতো, কখনো যৌবনা তরুণীর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে ঢেউয়ের উপর ঢেউ, পর্বতসম পানি আর পানি। কখনো মনে হয় সবুজ জমিন। আপনি এয়ারপোর্টের বেলকনিতে দাঁড়িয়েই সাগরের টলটলে অথৈ পানি ছুঁয়ে দেখতে পারবেন। দ্বীপ রাষ্ট্রের কারণে দেখতে মনে হবে এয়ারপোর্ট ভাসমান। কিন্তু না, একটু পানির পরেই বিশাল সুদৃশ্য খয়েরী রংয়ের দেয়াল। হাতের কাছে পায়ের কাছে পানিরা খেলা করে। ছলছল করা পানির ঢেউয়েরা অভ্যর্থনা জানায় পর্যটদেরকে। বিশাল সমুদ্রের পানিতে উদার হৃদয়ে তাকিয়ে থাকতে মন চায়। জায়গাটা খুব বেশি লম্বা নয় তবু দৃষ্টিনন্দন পরিবেশ।

(চলবে)

এয়ারপোর্টের বাইরে হোটেলের জন্য গ্রুপ ট্যুর প্যাকেজের ভাড়া করা টেক্সি ড্রাইভাররা তাদের হোটেলের নাম লিখে একটি কাগজ উঁচু করে ধরে রাখে। অনেকটা গলায় লাগিয়ে রাখার মতো। সেই কাগজে প্যাসেঞ্জারের নামও লেখা আছে। তাতে পর্যটকগণ হোটেলের নাম খুঁজে পেতে এবং নিজ নিজ গাইডকে খুঁজে পেতে অসুবিধা হয় না। আমাদেরকে গাড়ি দেখিয়ে দিয়ে ড্রাইভার কিছু সময়ের জন্য ভেতরে গেলো। ফিরে এসেই তার গাড়িতে করে আমাদের নেয়া হলো হুলহোমালে দ্বীপে। যা এয়ারপোর্ট থেকে দেখা যায়। এয়ারপোর্ট এবং হুলহোমালে দ্বীপটি পুরাই সমুদ্রের ঢেউয়ের মাঝে। এই দ্বীপ আর এয়ারপোর্টের মাঝখানে সাগরের উপর একটি সেতুর ব্যবধান রয়েছে মাত্র। সেতুর পিলারে বিশাল বিশাল ঢেউয়ের আঁচড় পড়ে। দূর থেকে দেখতে খুবই সুন্দর দেখায়। বিশ মিনিটের মতো গাড়ি চালিয়ে পৌছালো আমাদের হোটেলে। হোটেলের নাম বিল্লাহ রিসোর্ট। আস্ত ছয় তলা একটা বাড়ি। সামনে ফুল দিয়ে সাজানো, রং বেরংয়ের লেখা।

হোটেলটির দৃশ্য দেখেই আমি অভিভূত। কাঠের সাইনবোর্ড। ঘরের নিচতলা গ্লাস দিয়ে বাঁধাই করা চারপাশ। নিচতলা রেস্তোরাঁ, উপরে আবাসিক হোটেল। রেস্তোরাঁতে দুটি অংশ একটি এসিবিহীন খোলামেলা, ভেতরের অংশটি এসিযুক্ত। ভেতরে ম্যানেজার বসেন, সামনে কম্পিউটার নিয়ে। দেখলাম একজন হিজাবপরা নারী কম্পিউটারের সামনে বসা। সে তখনকার দায়িত্বরত ম্যানেজার। আমি সালাম দিলাম। হালকা মুচকি হেসে তাকালেন কিন্তু সালামের জবাব শুনিনি। নিশ্চয়ই মনে মনে নিয়েছেন। কত শত লোক আসা যাওয়া করে। বাংলাদেশিদের জন্য বাংলাভাষার লোক আছে তাতে বেশ ভালো লাগলো। এগিয়ে এলো বাংলাদেশি সালাউদ্দিন, সে পরিচিত হলো, তার গ্রামের বাড়ি ব্রাক্ষ্মণবাড়িয়ায়। খুব মিশুক হাসিখুশি ছেলে। তিন দিনের শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথে ছিলো। দীর্ঘদিন সে এখানে থাকে। এই হোটেলে চাকরি করে। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম পরে তার সাথে কথা বলে মালদ্বীপের মুসলিমদের বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে জানা যাবে। সালাউদ্দিন আমাদের ব্যাগসহ তিন তলায় নিয়ে রুম খুলে দিলো।

রুমটা চমৎকার। এক রুমে দুটি সিট। খাটের নমুনাই মুগ্ধ করে। কপি চিনি হালকা বিস্কুট এবং পানির বোতল রয়েছে। চা বানানোর জন্য আছে মগ হিটার। খাদ্য গরম করার জন্য মাইক্রো ওভেন। কাঠের আলমিরা ও জামা রাখার হ্যাংগার। বিশাল ড্রেসিং টেবিল দেখে নিজেকে নিয়ে নিজে গবেষণা করতে পারবেন। দক্ষিণ পাশে খোলা জানালা ও ছোট একটি বারান্দা রয়েছে। বারান্দাতে দাঁড়ালে সামনের বিশাল খোলা জায়গা দেখা যায়।

রাস্তার দিকে তাকালে দেখা যায় হোটেলের সামনে লাইন ধরে দাঁড়ানো শতাধিক স্কুটি। শহরের প্রায় প্রতিটি পরিবারে রয়েছে স্কুটি। ছেলে মেয়ে বুড়ো সবার জন্য স্কুটি রয়েছে। দ্বীপের কারণে এখানে অন্যান্য যানবাহন কমই দেখা গেলো। সবার নিজস্ব ¯কুটি ব্যবহার সহজ। বাসা বাড়ি, স্কুল কলেজ মসজিদ মন্দির সংস্কৃতি কেন্দ্র সবগুলোর সামনে সারি সারি স্কুটি দাঁড়ানো দেখা যায়। যে এলাকায় স্কুল আছে সেখানের আশেপাশে কোনো বাসা বাড়ি নেই। কোন স্কুলের সামনে অপেক্ষায় কোনো অভিভাবক নেই, সবাই স্ব স্ব কর্মতে ব্যস্ত থাকে। তবে একটা বিরাট বৈষম্য সেখানে, কোন ভিনদেশি বাচ্চাদের পড়াশোনার সুযোগ নেই। সব স্কুলে শুধু মালদ্বীপের স্থায়ী নাগরিকদের সন্তানরা পড়াশোনা করে। আর কেউ করতে পারে না। অবশ্য ভিনদেশী যারা সেখানে শ্রমিক, তাদের খুব কম লোকেরই ফ্যামেলি থাকে। ফলে বিদেশীদের বাচ্চারাও সেখানে নেই বললেই চলে।

এয়ারপোর্টের কাছেই হোলহুমালে দ্বীপ। সাধারণত যারা কম মূল্যের প্যাকেজ ট্যুরে ঘুরতে আসেন তাদেরকে এই দ্বীপেই হোটেল দেয়া হয়। তাই এয়ারপোর্টেও কাছাকাছি এই দ্বীপে মানুষের সমাগম বেশি। এখানে কেউ ইচ্ছা করলে এয়ারপোর্ট থেকে হেঁটেও চলে আসতে পারবেন। একটি মাত্র সেতুর এপিঠ ওপিঠ। তবে মজার বিষয় হলো সেখানে সাগরের ঢেউ আর গর্জন ভেঙ্গে চলে সারাক্ষণ, রাত দিন সব সময় জেগে আছে এসব দ্বীপ। ক্লান্তিহীন ঢেউয়ের পরে ঢেউ ছলাৎ ছলাৎ করে কূলে এসে বালির সাথে মিশে যাচ্ছে। সুরম্য সৌন্দর্যে ঘেরা এই দ্বীপগুলো মানুষকে আকর্ষণ করে, বিমোহিত করে। ঘুরে ফিরে দেখতে গেলে মনে পড়ে আল্লাহ কুরআনে বলেছেন - কুল সিরু ফিল আরদে ওয়াবতাগু মিন ফাদলিল্লাহ। তোমরা দেখো এবং আল্লাহর নেয়ামত তালাশ করো। সত্যি সব আল্লাহর অপূর্ব নেয়ামত। সাধারণত জ্ঞান বৃদ্ধির জন্যও ভ্রমণের গুরুত্ব অপরিসীম। কবি নজরুল বলেছেন, ‘হয়তো দেখো নয়তো লেখো’। অর্থাৎ হয়তো অনেক লেখাপড়া করে বিশ^ সম্পর্কে জানো, নয়তো দেশ বিদেশ ঘুরে পৃথিবীর জ্ঞান অর্জন করো।

আমাদের হোটেলটি দ্বীপের দক্ষিণ পাশে অবস্থিত, ফলে বাসা থেকে বের হলেই সমুদ্র দেখা যায়। আমরা একটু রেস্ট নিয়ে খাওয়ার জন্য বের হলাম। আগেই শুনেছি সবখানে বাঙালী হোটেল থাকে। বাসা থেকে বের হলেই দুই গলি পর রাজ্জাকের হোটেল। সেখানে সবাই ভাত খেলাম, আমাদের কর্তাবাবুরা বিল চুকিয়ে দিলো। আমি মালদ্বীপের মুদ্রাটা ধরেও দেখতে পেলাম না। ওরা ঠান্ডা খায়, আন্ডা খায়, আরো কত কিছু খায়, আমি ওসব খাই না। ফলে তারা যত বিল বলে ততই সই। সেখানে বাংলাদেশি টাকায় তিনশো সাড়ে তিনশো টাকায় গরু বা মাছ দিয়ে বেশ খাওয়া যায়। সব পুরুষ চালিত হোটেল। খাওয়ার পর বের হলাম দ্বীপটি দেখতে। চলার পথে যা দেখলাাম কিছু কিছু হোটেল দেখেছি নারী চালিত। যেগুলো মালদ্বীপের নাগরিকরা পরিচালনা করে। ইন্ডিয়ান সুন্দরী মেয়েরাও এসব পরিচালনার দায়িত্বে আছে। সেখানে আমাদের দেশের মতো গ্রীল, চাপ নানরুটি এগুলো পাওয়া যায়। পানের বাহার একবারে শ^শুরবাড়ির মতো, একটি পান খেয়েছি যা আমাদের দেশের পঞ্চাশ টাকার সমান দামের। যেমন বড় তেমনি কড়কড়ে মচমচে পান। সেখানে যে সুপারী দিয়েছে তা আমাদের দেশের অন্তত দশ খিলি পান খাওয়া যাবে। দস্তুর মতো একটি নাস্তার প্লেট পুরা। কালো জিরা, চুন, সুপারী, খয়ের। পানের নামে দোকানের বাইরে নারিকেল গাছতলায় প্লাস্টিকের চেয়ার টেবিলে বসে ঘন্টার পর ঘন্টা কাটিয়ে দেয়। সুন্দরী সেলসম্যান টেবিলে খাওয়া নিয়ে আসে, সেখানে আলো আঁধারী খেলা করে। দূরের সোডিয়াম লাইটের আলো গাছের পাতা ভেদ করে যতটুকু আসতে পারে ততটুকুই আলো। স্লীম চুল খোলা সুন্দরীরা সেখানকার বয় এর কাজ করে। অনেক দোকানে দেখেছি এসব মেয়েরা লাল থ্রিপিস পরা, বা লাল স্কীন টাইস ও লাল জ্যাকেট পরে থাকে। আবার ছাই রঙের স্কার্ফ পরা মেয়েরাও আছে, যাদের দেখলে বুঝা যায় ওরা কত ধার্মিক।

হুলহোমালে দ্বীপে একটি পার্ক রয়েছে, নাম সেন্ট্রাল পার্ক। এটি দ্বীপের মাঝখানে অবস্থিত। সবুজ ঘাসে ঘেরা এই পার্কের পাশে একটি কৃত্রিম লেক তৈরি করা হয়েছে। পুরা দ্বীপের চারপাশে নারিকেল গাছ এবং বিভিন্ন রকমের বড় বড় গাছ দিয়ে সৌন্দর্যবৃদ্ধি ও দ্বীপের মজবুতির কাজ করা হয়েছে। এছাড়া দ্বীপের কূল থেকে প্রায় একশো গজ দূরে পাথর দিয়ে বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে যেন দ্বীপে সরাসরি কোন ঢেউ আঘাত করতে না পারে এবং দ্বীপের চারপাশে কূলে কূলে পর্যটকরা যেন গোসল করতে পারে। সাগরের আঘাতে যেন কেউ হারিয়ে না যায় সে জন্য বড় বড় পাথর বসিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাথরে কেউ কেউ বসে বা শুয়ে শুয়ে পানির ঢেউয়ের মজা পায়। তবে বড় মজার বিষয় হলো মালদ্বীপে কিছুক্ষণ পরপর হঠাৎ হঠাৎ বৃষ্টি আসে। কতবার যে এক মিনিটের বৃষ্টিতে ভিজেছি জানা নেই। দ্বীপের পূর্ব পাশে সাজানো আছে স্টিমার সেখান থেকে ভাড়া নিয়ে সাগর পাড়ি দিয়ে এক দ্বীপ থেকে অন্য দ্বীপে যাওয়া যায়। ডলফিনের দ্বীপে একবার যতজনই যাক না কেন বাংলাদেশি ৭০০ টাকা পরিমাণ মালে ডলার দিয়ে টিকেট কাটতে হয়।

আমাদের দ্বিতীয় দিন ছিলো শুক্রবার। তারা আজানের কিছুক্ষণ পরেই নামাযের খুতবা নিয়ে দাঁড়ায়। এবার বলি সেখানকার ইসলামের কথা। আন্তর্জাতিক তথ্যমতে, মালদ্বীপ শতভাগ সুন্নী মুসলিমের দেশ, দ্বীপের প্রতিটি ঘরেই পাওয়া যায় ধর্মভিত্তিক বই। ইসলাম তাদের আদি সংস্কৃতির অংশ নয় কিন্তু এই ধর্মকে বিষয়বস্তু করে গড়ে ওঠেছে এখানকার প্রায় সকল লিখিত সাহিত্য। ধর্মীয় রচনার মধ্যে মোহাম্মদ জামিলের রসুলের জীবনী নিয়ে লেখা ‘সিরাত’ সবচেয়ে জনপ্রিয় বইয়ের একটি। হোসেইন সালাউদ্দিন আরেকজন প্রভাবশালী লেখক। কবি, গদ্য সাহিত্যিক এবং বুদ্ধিজীবী,যার লেখা ‘বদু টাকুরুফানো স্টোরি’ মহাকাব্যিক মর্যাদা লাভ করেছে। অন্য দেশের লোককাহিনিগুলোকে মালদ্বীপীয় আবহে অনুবাদ করে তিনি তাঁর কাজে নিজস্বতা তৈরি করেছেন।

জানা যায় মালদ্বীপে অধিকাংশই আহলে হাদীসের অনুসারী। এদের আর সুন্নীদের আমলে ব্যাপক পার্থক্য রয়েছে। সেখানে মসজিদের ইমাম সাহেব হাফ শার্ট পরে নামায পড়ান এতে কারো কোনো মন্তব্য নেই। তারা হয়তো শুরু থেকে এ রকমই দেখে আসছে তারা আর কি মন্তব্য করবে? সেখানে হুজুর আর সাধারণ লোকের প্রার্থক্য বুঝা মুশকিল। আমি রাজধানীতে আসরের নামায পড়েছি জামাতের সাথে। সেন্ট্রাল কমিউনিটি মসজিদের ইমামের গায়ে পান্জাবী ছিলো। মোয়াজ্জিন একামত দিলেন তাকবীরগুলো একবার একবার পড়ে। ইমাম সাহেব হাদীসের সাব্বু সুফুফাকুম ফাইন্না তাসবিয়াতাস সালাহ, পড়ে আল্লাহু আকবার বলে সালাত শুরু করলেন। তৃতীয় রাকায়াত শুরুতে দাঁড়িয়ে কেরাত শেষ করে রুকুর আগে হাত তুলে মোনাজাত শুরু করেছেন। লম্বা মোনাজাত, আরবীতে। আমাদের জুমার মোনাজাতের মতো লম্বা। সেই মোনাজাতে ফিলিস্তিনের জন্যও দোয়া করা হলো। তারপর শহরের ভেতরের এক ঐতিহ্যবাহী মসজিদে মাগরিবের নামায পড়েছি হাফ শার্ট পরা এক মাওলানার পেছনে। তিনি সেখানকার নির্ধারিত ইমাম। সামনের মুসল্লাতে দাঁড়ানোর আগ পর্যন্ত আমি বুঝতেই পারিনি তিনি ইমাম। দেখতে আমাদের গ্রামাঞ্চলের খেটে খাওয়া মানুষের চেহারা। মুসুল্লি আমরা তিনজনসহ হয়তো দশজন হবেন। মসজিদটি ১২ ফিট বাই ১৮ ফিট হতে পারে। তাছাড়া সরকারের ভালো বাজেট না থাকায় তাদের বেতনও কম। তারা শুধু দ্বীনের খেদমতে এসব দায়িত্ব পালন করে আাসছেন বলে জানালেন। এই মসজিদটি শহরের একটি ঐতিহাসিক মসজিদ। প্রায় তিনশো বছর পুরানো, অনেকগুলো কবর রয়েছে মসজিদের পাশে। অনেকে শুধু দেখতে আসেন। ইমাম সাহেবের সাথে আরবীতে টুকটাক কথা বললাম। হাফ শার্ট পরে নামায পড়ানোর বিষয়ে ‘মা হাযাততাকওয়া’? এটা কেমন তাকওয়া জিজ্ঞাসা করলে তিনি চুপসে গেলেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন তাকওয়ার কথা বলছি। পরের দিন আসরের নামায পড়েছি হুলহোমালে দ্বীপে সেখানেও হাফশার্ট পরা লোকই ইমামতি করছেন দেখে তাকেও একই প্রশ্ন করেছিলাম কিন্তু তিনিও চুপ থাকলেন। আমাদের দেশে হলে মুসুল্লিরা হাজার প্রশ্নে জর্জরিত করতো, তার পেছনে নামায পড়াতো দূরের কথা ফতোয়া দিয়ে তার গোষ্ঠী উদ্ধার করে দিতো।

মালে সিটিতে ইসলামিক সেন্টারে নিয়মিত মহিলারাও জামাতে নামায পড়ে। মহিলাদের মাথায় স্কার্ফ আছে। এই পোশাকে তারা স্কুটি চালিয়ে শহরে চলাচল করে, নামায পড়তে চলে আসে। সেখানে একজন লোকের সাথে পরিচয় হলো তার নাম ফারুক। তিনি নিজেকে ক্বারী ফারুক বলে পরিচয় দিলেন। তিনি জানালেন তিনি পাকিস্তানী নাগরিক। তার গায়েও হাফ শার্ট, পরনে প্যান্ট। ইউরোপেও নাকি একই অবস্থা। অনেক ইমাম শার্টপ্যান্ট টাই পরে ইমামতি করেন।

আমদের ভ্রমণের তৃতীয় দিন আমাদের চলে আসার দিন। সকালে হালকা বৃষ্টির মাঝে আমাদের গাড়ি চলে এলো। সকালের ফ্রি নাস্তা সেন্ডুইচ আর একটি কলা খেয়ে আমাদের নির্ধারিত মাইক্রোতে উঠলাম। সেই ব্রীজ মাড়িয়ে সাগরের দৃশ্য দেখতে দেখতে এয়ারপোর্ট চলে এলাম। খুব অল্প সময়ে আমাদের ইমিগ্রেশান করে বিমানে উঠে বসলাম। বিমান নির্দিষ্ট সময়ে আকাশে উড়াল দিলো। নিচে তাকিয়ে স্মৃতির এ্যালবাম হুলহোমালে দ¦ীপকে আরেকবার হাজার মাইল উপর থেকে দেখলাম। হাত নেড়ে বললাম গুডবাই মালদ্বীপ। আলহামদুল্লিাহ খুব ভালো সময় কেটেছে তিন দিন। আল্লাহর অনেক নেয়ামত দেখেছি। মালদ্বীপ দেশ ও তাদের সংস্কৃতি খুব ভালো লেগেছে। একবার মনে হয়েছে এত খোলামেলা জায়গার মতো যদি আমাদের দেশকেও সাজানো যায় তাহলে তাদের মতো বাংলাদেশও পর্যটন খাত দিয়ে দেশ চালাতে পারবে, আর কোন দিক তাকাতে হবে না।