ড. আশরাফ পিন্টু

কলেজ থেকে দু’দিনের সফরে বের হলাম আমরা ১১জন শিক্ষক। ২৮ সেপ্টেম্বর-২০২৫-এর সকাল ৫টায় পাবনার বেড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে আমাদের যাত্রা শুরু। জলে ও স্থলে হবে আমাদের সফর। প্রথম দিন সফর করব স্থলে অর্থাৎ পাহাড় এলাকায় আর দ্বিতীয় দিন সফর করব জলে অর্থাৎ হাওড়ে। স্থলের স্থান হিসেবে বেছে নিলাম টাঙ্গাইল জেলার ২০১ গম্বুজ মসজিদ, নেত্রকোণা জেলার পাঁচগাও সীমান্তবর্তী পাহাড়, সাদা মাটির পাহাড় ইত্যাদি। জলের স্থান হিসেবে বেছে নিলাম কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন হাওড়।

আমাদের রিজার্ভকৃত হাইসে প্রথমে নামলাম টাঙ্গাইল জেলার গোপালপুর উপজেলার নগদা শিমলা ইউনিয়নের দক্ষিণ পাথালিয়া গ্রামে। এখানে মনোমুগ্ধকর দৃশ্যে নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে ২০১ গম্বুজ মসজিদ। এটি পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি গম্বুজ এবং দ্বিতীয় উচ্চতম মিনার বিশিষ্ট মসজিদ হিসাবে স্বীকৃত। মসজিদটির নকশা করা হয়েছে ২০১টি গম্বুজ ও ৯টি মিনার দিয়ে সজ্জিত একটি পূর্ণাঙ্গ মসজিদ কমপ্লেক্স হিসেবে।

মসজিদটি দেখে সবার চোখ জুড়িয়ে গেল। বাংলাদেশে যে এমন সুন্দর মসজিদ রয়েছে যা কল্পনাতেও ছিল না। আমরা ঘুরে ঘুরে মসজিদটির বিভিন্ন সৌন্দর্য ও কারুকার্যতা দেখতে লাগলাম। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে কিছু ছবি তুললাম। মসজিদের প্রধান দরজা গম্বুজ ও পিলারে কারুকার্যময় করে পিতল ব্যবহার করা হয়েছে। ২০১৩ সালের জানুয়ারি এই মসজিদ নির্মাণ কাজ শুরু হয়। মসজিদটি বীর মুক্তিযোদ্ধা রফিকুল ইসলাম কল্যাণ ট্রাস্টের উদ্যোগে নির্মিত হয়েছে। নির্মাণ কাজের ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করেন কল্যাণ ট্রাস্টের প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যানের মা রিজিয়া খাতুন। মসজিদটির ছাদে ৮১ ফুট উচ্চতার একটি গম্বুজ রয়েছে। এই বড় গম্বুজের চারপাশে ছোট ছোট গম্বুজ আছে ২০০টি। প্রত্যেকের উচ্চতা ১৭ ফুট। মূল মসজিদের চার কোণায় রয়েছে ৪টি মিনার। প্রত্যেকের উচ্চতা ১০১ ফুট। পাশাপাশি ৮১ ফুট উচ্চতার আরও চারটি মিনার আছে। সবচেয়ে উঁচু মিনারটি মসজিদের পাশে অবস্থিত, যার উচ্চতা ৪৫১ ফুট। মসজিদটি দৈর্ঘ্যে ১৪৪ ফুট ও প্রস্থে ১৪৪ ফুট। মসজিদটিতে একসঙ্গে প্রায় ১৫ হাজার মানুষ নামাজ আদায় করতে পারবেন।

মসজিদ পরিদর্শন শেষে সকাালের নাস্তা সারলাম নেত্রকোণা শহরে এসে। নাস্তা সেরে রওনা দিলাম নেত্রকোনা জেলার সীমান্তবর্তী কলমাকান্দা উপজেলার পাঁচগাওয়ের উদ্দেশ্যে। পাহাড়ি সৌন্দর্যেঘেরা একটি এলাকা হলো পাঁচগাও। কলমাকান্দা উপজেলার ৮টি ইউনিয়নের ৩টি ইউনিয়নই পাহাড় সীমান্তবেষ্টিত এবং সেই সীমান্তগুলো যেন এক একটি নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আধার। তেমনি একটি সীমান্তলগ্ন এলাকার নাম পাঁচগাও যা রংছাতি ইউনিয়নে অবস্থিত। অনেকে বলে এখান থেকে গারো পাহাড়ের শুরু। অন্যদিকে স্থানীয়রা একে পাঁচগাওয়ের টিলা বা কলমাকান্দার পাহাড় বলে চিনে। যদিও পাহাড়ি এলাকার আসল নাম কথিত চাঁদ সওদাগরের ডুবে যাওয়া নৌকার নাম ধরে চন্দ্রডিঙা পাহাড়। স্থানীয়দের মতে, শত শত বছর পূর্বে চাঁদ সওদাগরের নৌকা ডুবেছিল এখানে। তাই পাহাড়টি কিছুটা নৌ আকৃতির দেখতে। আর এ কারণেই এর নাম চন্দ্রডিঙা বা চন্দ্রডিঙি। তবে আমার কাছে পাহাড়গুলোকে ‘‘ঢেউখেলানো পাহাড়’’ বলে মনে হয়েছে। দূর থেকে দেখলে মনে হয়Ñ সারি সারি সবুজের ঢেউ যেন বয়ে গেছে বাংলাদেশের দীর্ঘসীমান্ত ধরে। চারপাশে সমতল ভূমির মাঝদিয়ে বয়ে চলা এই পাহাড়ের পাদদেশেই বাস করে হাজং ও গারো উপজাতিরা। এখানে একসময় বন্য হাতির দেখা পাওয়া যেতো যদিও এখন আর দেখা যায় না। তবে স্থানীয়দের ভাষ্যমতে, এখনও মাঝে-মধ্যে মেঘালয় থেকে বন্য হাতির দল বাংলাদেশে ঢুকে তাণ্ডব চালায়।

পাঁচগাও সীমান্তবর্তী পাহাড়গুলো দেখতে দেখতে ৫টা বেজে গেল। আমরা রওনা দিলাম সাদা মাটির পাহাড় দেখার উদ্দেশ্যে। কিন্তু সময় বাম! দুর্গাপুর উপজেলায় পৌঁছিতেই সন্ধে হয়ে গেল। উপজেলা পরিষদ থেকে ৭ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে কুল্লাগড়া ইউনিয়নের আড়াপাড়া ও মাইজপাড়া মৌজায় বিজয়পুরের সাদা মাটির পাহাড় অবস্থিত। এ সময় ওখানে যাওয়া সম্ভব নয়। কারণ সামনে সোমেশ্বরী নদী পার হয়ে ওখানে যেতে হবে। আমরা প্রথমে পরিকল্পনা করলাম রাতটা দুর্গাপুরের কোনো রিসোর্টে কাটাব। কিন্তু পরে পরিকল্পনা পরিবর্তন করে সীদ্ধান্ত নিলাম সাদা পাহাড়ের কাছে বিজয়পুরের কোনো রিসোর্টে রাত্রি যাপন করব যাতে সকালে উঠেই পাহাড় দেখতে পারি। এতে সময় বেচে যাবে; কেননা পরের দিন আমাদের কিশোরগঞ্জের উদ্দেশ্যে যাত্রা করতে হবে; যেখানে রয়েছে মিঠাপনির মিঠামইন হাওড়।

২৯ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৬টায় রওনা দিলাম সাদা মাটির পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। পাহাড়ের কাছে এসে সবাই বিস্মিত হয়ে গেলাম। সত্যি সাদা মাটি রয়েছে এখানে। এ মাটি দিয়েই নাকি চিনা মাটির বাসন-কোসন তৈরি করা হয়। পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে আমরা কিছু ছবি তুললাম। এরপর ধীরে ধীরে সবাই পাহাড়ের চূড়ায় চড়লাম। পাহাড়টি বেশি উঁচু নয়। ১২০ ফুটের মতো হবে এর উচ্চতা। উপরে উঠে আবার দেখা গেল মেঘালয়ের সেই ঢেউখেলানো পাহাড়মালা। সাদামাটির পাশাপশি এখানে কালো, লালচে, খয়েরি, বেগুনি ও নীলসহ বিভিন্ন রঙের মাটির স্তর রয়েছে। এছাড়াও ছোট-বড় টিলা, পাহাড় এবং নীল পানির লেকের সৌন্দর্য পর্যটকদের আকর্ষণ করে।

বাংলাদেশের মধ্যে প্রকৃতির স¤পদ হিসেবে সাদা মাটির পাহাড়ি এলাকা অন্যতম বৃহৎখনিজ অঞ্চল এটি। ছোট বড় টিলা-পাহাড় ও সমতল ভূমি জুড়ে প্রায় ১৫.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ ও ৬০০ মিটার প্রস্থ এই খনিজ অঞ্চল। ১৯৫৭ সালে ভূতাত্ত্বিক জরিপে এই অঞ্চলে সাদামাটির উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। ২০২১ সালে বিজয়পুরের সাদামাটি ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি অর্জন করে। বিজয়পুরের সাদামাটির পাহাড় মূলত টারশিয়ারি যুগের। ১৯৫৭ সালে ভূতাত্ত্বিক জরিপে এই সাদামাটির উপস্থিতি শনাক্ত করা হয়। কোহিনূর অ্যালুমিনিয়াম ওয়ার্কস ১৯৬০ সালে বাণিজ্যিকভাবে প্রথম চিনামাটি উত্তোলন শুরু করে। এরপর ১৯৬৪-৬৫ সালে পরীক্ষামূলক ১৩টি কূপ খনন করা হয় এবং ১৯৬৮ সালে বাণিজ্যিকভাবে মাটি উত্তোলন শুরু হয়। প্রাথমিক জরিপ অনুযায়ী, এই অঞ্চলে প্রায় ২৪.৭ মিলিয়ন মেট্রিক টন সাদামাটি মজুদ রয়েছে, যা বাংলাদেশের ৩০০ বছরের চাহিদা পূরণে সক্ষম।

সাদা মাটির পাহাড় পরিদর্শন শেষে আমরা রওনা দিলাম কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন হাওড়ের উদ্দেশ্যে। হাওড়ের ঘাটে পৌঁছানোর আর মাত্র ২/৩ কিলোমিটার পথ বাকি এমন সময় আমাদের হাইসের পিছনের ডান চাকা ব্রাস্ট হয়ে গেল। অল্পের জন্য আল্লাহ বাঁচলেন। কোনো দুর্ঘটনার সম্মুখীন হলাম না। আমরা ড্রাইভারকে চাকা পাল্টানোর কথা বলে অটো রিক্সা ধরে রওনা দিলাম ঘাটের উদ্দেশ্যে। ঘাটের পৌঁছে একটা ছোট ট্রলার রিজার্ভ করলাম; তখন দুপুর আড়াইটার মতো বাজে। ট্রলার ছুটে চলল হাওড়ের বুকের ওপর দিয়ে।

হাওর মানেই চারদিকে থইথই পানি, ছোট নৌকায় মানুষের কর্মচাঞ্চল্যতা, হাওরের পানিতে দ্বীপের মতো ভেসে থাকা গ্রাম। ভ্রমণপ্রেমীদের কাছে হাওর আলাদা বিশেষত্ব বহন করে। বর্ষায় হাওর মানেই এক ভিন্ন রকম প্রকৃতি, ভিন্ন রকমের জীবনধারা। মিঠামইন কিশোরগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা। এর চারপাশে রয়েছে কিশোরগঞ্জের অন্য তিনটি হাওর-উপজেলা ইটনা, অষ্টগ্রাম ও নিকলী। সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের বাড়ি এই উপজেলার কমলাপুর গ্রামে।

একসময় এখানকার যোগাযোগ ব্যবস্থা একমাত্র নৌকার উপর নির্ভরশীল ছিলো। হাওরের প্রবাদও আছে “বর্ষাকালে নাও আর শুকনায় পাও”; অর্থাৎ বর্ষায় নৌকা আর শুকনো মৌসুমে পায়ে হাঁটাই যাতায়তের একমাত্র মাধ্যম। এখন দিন বদলেছে। বর্তমানে হাওরে যোগাযোগের জন্য নির্মিত হয়েছে অষ্টগ্রাম মিঠামইন ইটনা সাবমারসিবল সড়ক। ৪৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই সড়কটি অল ওয়েদার সড়ক নামে পরিচিত। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কল্যাণে এটি এখন পর্যটকদের কাছে জনপ্রিয়তার তুঙ্গে।

মিঠামইন হাওড়ের ট্রলারে লেখক ও তার সহকর্মীবৃন্দ।

বিকেল ৩টা তবু সূর্যের তেজ কমেনি। ঘাটে পৌছাতে আরো ১৫/২০ মিনিট বাকি। চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। এমন পানিতে গোসল না দিলে কি চলে? আমি সবাইকে গোসলের আহ্বান জানালাম। ৩ জন ছাড়া বাবি ৭ জন এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল। একটি সাবমারসিবল সড়কের কাছে ট্রলার ভিড়িয়ে আমরা গোসলে নেমে গেলাম। অনেকেরই হাওড়ে প্রথম গোসল। সকলেরর কি যে আনন্দ! গোসল শেষ হতে না হতেই আমরা ঘাটে পৌঁছে গেলাম।

বিকেল ৪টায় খেলাম দুপুরের খাবার। এরপর দেখতে গেলাম মিঠামইন-ইটনা-অষ্ট্গ্রাম সড়কের জিরো পয়েন্ট। ৩ উপজেলার ৩টি সড়কের মিলনস্থল এ জিরো পয়েন্ট। এক কথা হাওড়ের বুক চিঁড়ে নির্মিত হয়েছে এ সড়ক। এর চারপাশের দৃশ্যও বেশ মনোরম।

ফেরার পথে পরিদর্শনে গেলাম সাবেক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ সাহেবের পৈত্রিক বাড়ি। সাদামাটা ধরনের একতলা বাড়ি। সাধারণ মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাড়ি যেমন হয়। এরপাশেই রয়েছে সুরম্য অট্টলিকা ‘‘প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ কমপ্লেক্স’’; যেটি প্রেসিডেন্ট আব্দুল হামিদ নিজে তৈরি করেছেন। এরপর বাড়ি ফেরার পালা। আবার হাওড় পাড়ি দিয়ে ঘাটে পৌঁছিলাম। তখন রাত ৮টা বাজে। হাইসে চড়ে উঠলাম সবাই।

হাইস চলছে। কিশোরগঞ্জ শহর পার হয়ে পাকুন্দিয়া উপজেলায় পৌঁছেছি। এমন সময় আবার ওই পিছনের চাকাটি ব্রাস্ট হলো। ড্রাইভার চাকাটি নতুন না লাগিয়ে পুরানটিই সেরে লাগিয়ে ছিল। নতুন চাকার জন্য ড্রাইভারকে পাঠানো হলো কিশোরগঞ্জ শহরে। আমরা পাকুন্দিয়ায় অপেক্ষা করতে লাগলাম। অপেক্ষার প্রহর বড় কঠিন! তার ওপর দুপুর রাত্রি। নির্জন উপজেলা শহর। প্রায় সব দোকান-পাট বন্ধ। একটি চায়ের দোকান বন্ধ করে চলে যাচ্ছিল দোকানদার। আমাদের কথায় তিনি দোকান আবার খুললেন। ওখানে বসে সবাই চা-বিস্কুট খেলাম। এমন সময় একজন আগন্তুক এলো। বলল, আপনাদের বাসা কোথায়? আমরা তো প্রথমে ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। হয়তো কোনো গুণ্ডা-মাস্তান হবে। আমি বললাম, পাবনা। সে আমাদের ভয় ভাঙিয়ে দিয়ে বলল, সকলে দোকান থেকে চা-বিস্কুট খান। আমি বিল দিয়ে দেবো। পরে পরিচয় দিয়ে বলল, আমার বাড়ি এখানেই। আমি উপজেলা জাসাসের আহ্বায়ক। শশুর বাড়ি আপনাদের পাবনার পাশেই-বগুড়া।

আমরা যখন বাড়ি কাছাকাছি পৌঁছিলাম তখন মুয়াজ্জিন মাইকে ফজরের আজান দিচ্ছে।