মতিন মাহমুদ
২০২৫ সালে বুকার পুরস্কার লাভ করেছেন হাঙ্গেরীয় বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ লেখক ডেভিড সাজালে। লন্ডনের ওল্ড বিলিংসগেটে পুরস্কারের ট্রফি গ্রহণকালে সাজাল বলেন, ‘আমি চাইতাম, এমন একটি ঝুঁকিপূর্ণ উপন্যাস লিখতে। বিচারকম-লী তার স্বীকৃতি দিয়েছেন। একজন প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি কি কল্পনা করতে পারেন যে ফ্লেশ নামে একটি উপন্যাস বুকার পুরস্কার জিততে পারে?’ সাজাল বলেন, ‘আপনাদের উত্তর আপনাদের হাতেই।’ বিজয়ীকে ৫০ হাজার পাউন্ডের পাশাপাশি চূড়ান্ত প্রার্থীদের ও অনুবাদকদের প্রত্যেককে ২ হাজার ৫০০ পাউন্ড দেওয়া হয়। এ ছাড়া এ পুরস্কার লেখকদের খ্যাতি বাড়ায় এবং বইয়ের বিক্রিও বাড়ে। তার নামে সালাই উচ্চারণও লিখছেন কেউ কেউ। পুরস্কার জয়ী তার উপন্যাসের নাম ফ্লেশ’। লন্ডনে বুকার পুরস্কারের আয়োজকেরা এক বিবৃতিতে বলেন, ‘ফ্লেশ’ শ্রেণি, ক্ষমতা, অন্তরঙ্গতা, অভিবাসন ও পুরুষত্ব নিয়ে এক গভীর চিন্তাশীল রচনা। এটি একজন ব্যক্তির জীবন ও সেসব গুরুত্বপূর্ণ অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছে; যা তাঁর সমগ্র জীবনে প্রভাব ফেলে।
আয়ারল্যান্ডের লেখক ও বিচারকম-লীর সদস্য রডি ডয়েল বলেন, আমার মনে হয় না, আমি আগে এমন কোনো উপন্যাস পড়েছি; যেখানে পৃষ্ঠার সাদা জায়গা এত ভালোভাবে ব্যবহার করা হয়েছে। লেখক যেন পাঠককে সে জায়গা পূর্ণ করতে ও চরিত্রকে দেখার সুযোগ দিচ্ছেন এমনকি নিজের সঙ্গে মিলিয়ে চরিত্রটিই তৈরি করতে সাহায্য করছেন।
১৫৩টি উপন্যাসের মধ্য থেকে নির্বাচিত হয়েছে সাজালের উপন্যাসটি। বিচারকম-লীতে ছিলেন আয়ারল্যান্ডের লেখক রডি ডয়েল এবং ‘সেক্স অ্যান্ড দ্য সিটি’ অভিনেত্রী সারাহ জেসিকা পার্কার। ডয়েল বলেন, ‘ফ্লেশ এমন একটি বই; যা জীবনযাপন এবং জীবনের অদ্ভুত সব দিকের গল্প বলে। পাঁচ ঘণ্টার আলোচনা শেষে এটি বিচারকদের ঐকমত্যে নির্বাচিত উপন্যাস হয়ে ওঠে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা আগে কখনো এ রকম বই পড়িনি। অনেক ক্ষেত্রে এটি দুঃখজনক বা মলিনভাবাপূর্ণ হলেও পড়তে আনন্দদায়ক’।
এবার নোবেল পেয়েছেন সাজালের দেশের লাসলো ক্রাসনাহোরকাই। ডেভিড সাজালের বুকার পুরস্কার জয়ে হাঙ্গেরি বিশ্বসভার মাঝখানে এখন। একই বছরে নোবেল ও বুকার পাওয়ার রেকর্ড গড়লো দেশটি।
বৃটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ানের বুক রিভিউয়ার লিসা এলারডাইস লিখছেন-
এই বছরের বুকার পুরষ্কার ঘোষণার পর সকালে যখন আমরা তার সাথে দেখা করি, তখন বিজয়ী ডেভিড সাজালেকে একজন অত্যন্ত উদার এবং ভদ্র লেখক বলে মনে হয় যিনি সাম্প্রতিক সমসাময়িক কথাসাহিত্যের সবচেয়ে নৈতিকভাবে অস্পষ্ট চরিত্রগুলির মধ্যে একটি তৈরি করেছেন। যুক্তরাজ্যে একজন হাঙ্গেরিয়ান অভিবাসীর উত্থান ও পতন সম্পর্কে তার ষষ্ঠ উপন্যাস ফ্লেশ, আপনি আগে যা পড়েছেন তার থেকে আলাদা।
এই আলাদা হয়ে ওঠা উপন্যাস হিসেবে ফ্লেশ জিতে নিয়েছে এই পুরস্কার তা বলাই বাহুল্য। ভারতীয় বংশোদ্দভুত কিরণ দেশাই ও বৃটিশ লেখক অ্যান্ডু মিলারের নামও জোরে শোরে শোনা যাচ্ছিল, তারা প্রতিযোগিতায়ও ছিলেন হচ্ছে বলে খবর দিচ্ছিল গার্ডিয়ান। শেষে বিজয়ের হাসি হাসলেন সাজালে। ফ্লেশ উপন্যাসে একজন নির্যাতিত হাঙ্গেরিয়ানের জীবনের গল্প বলা হয়েছে; যিনি অর্থ উপার্জন করেন এবং তা হারিয়েও ফেলেন। বইটি লেখা হয়েছে সহজ ও সংক্ষিপ্ত ভাষায়। এর প্রধান চরিত্র ইস্তভান। এক মৌন স্বভাবের ইস্তভানের জীবনকাহিনি বর্ণনা করা হয়েছে এতে। কাহিনি শুরু হয়েছে ইস্তভানের কিশোর বয়সে তাঁর চেয়ে বেশি বয়সী এক নারীর সঙ্গে সম্পর্ক দিয়ে, এরপর যুক্তরাজ্যে একজন সংগ্রামী অভিবাসী হিসেবে তাঁর পথচলা এবং শেষ হয় লন্ডনের উচ্চবিত্ত সমাজের একজন সদস্য হিসেবে। ব্রেক্সিটের ফলে হাঙ্গেরীতে দেখা দেয় কাজের সংকট। তার কিছুটা আভাস আছে এই উপন্যাসে। ব্রেক্সিটের ফলে ইইউ দেশভুক্ত হাঙেগরীর নাগরিকদের বৃটেনে কাজের সন্ধানে যাওয়া কমে যায়।
এই বইয়ের শুরুতেই প্রধান চরিত্র ইস্তভান একজন লাজুক এবং ব্যতিক্রমী কিশোর হিসেবে হাঙ্গেরির একটি আবাসন প্রকল্পে বসবাস করেন। গল্পটি ইউরোপীয় শীর্ষ এক শতাংশ আয়ের লোকদের মধ্যে দারিদ্র্য থেকে বিবাহিত জীবনে তার উত্থান এবং পরবর্তীতে তার অর্থনৈতিক পতনকে তুলে ধরেছে। এর মাঝে তার জীবন অনেক মোড় নেয়।
ইস্তভান পনের বছর বয়সী একজন তরুণ। ৪২ বছর বয়সী বিবাহিত মহিলার সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। উপন্যাসের বিভিউগুলোতে এটিকে মহিলার পক্ষ থেকে সাজসজ্জার কাজ হিসাবে বর্ণনা করা হয়েছে, অথবা একটি গোপন সম্পর্ক হিসাবে। মহিলার তার স্বামীর সাথে ঝগড়া হয় এবং তার মৃত্যুর জন্য তাকে দায়ী করা হয়।
পরবর্তীতে ইস্তভান ব্যক্তিগত নিরাপত্তায় কাজ করে এবং তারপর লন্ডনের একটি সচ্ছল পরিবারের একজন হয়ে ওঠে। সময়ের সাথে সাথে সে তাদের জীবনের অংশ হয়ে ওঠে, যার মধ্যে রয়েছে তাদের অর্থবহুল জীবনধারা, পোশাক, ব্যক্তিগত বিমান এবং একচেটিয়া রেস্তোরাঁ।
সাজালের অন্য উপন্যাসগুলো হচ্ছে লন্ডন এন্ড দ্য সাইথ-ইস্ট, দ্য ইনোসেন্ট, স্পিং, অল দ্যাট ম্যানইজ ও ট্রার্বুলেন্স।
ডেভিড সাজালের জন্ম ১৯৭৪ সালে কানাডার মন্ট্রিলে। তার মা একজন কানাডিয়ান এবং বাবা হাঙ্গেরিয়ান। এরপর তার পরিবার বৈরুতে চলে আসে। লেবাননের গৃহযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তারা লেবানন ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এরপর তারা লন্ডনে চলে যান, যেখানে তিনি সাসেক্স হাউস স্কুলে পড়াশোনা করেন। সাজালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। স্নাতক হওয়ার পর, তিনি লন্ডনে বিক্রয় বিভাগে বিভিন্ন চাকরি করেন। লেখক হওয়ার উচ্চাকাঙক্ষা পূরণের জন্য তিনি ব্রাসেলসে, তারপর হাঙ্গেরির পেকসে চলে যান।
কানাডায় জন্ম, যুক্তরাজ্যে বড় হওয়া এবং বর্তমানে ভিয়েনায় বসবাসরত সাজালে ২০১৬ সালে তাঁর ‘অল দ্যাট ম্যান ইজ’ উপন্যাসের জন্য বুকার ফাইনালিস্ট ছিলেন। পৃথক ৯টি পুরুষ চরিত্রের ওপর লেখা গল্পের সংকলন এটি। ফ্লেশ তাঁর ষষ্ঠ উপন্যাস। বিবিসি রেডিওকে সাজাল বলেন, ‘যদিও আমার বাবা হাঙ্গেরীয়, আমি কখনো পুরোপুরি হাঙ্গেরিতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করিনি। আমি সব সময় নিজেকে একটু বাইরের মানুষ হিসেবে অনুভব করেছি। দীর্ঘ সময় যুক্তরাজ্য ও লন্ডনের বাইরে থাকার কারণে, লন্ডন সম্পর্কেও ছিল একই অনুভূতি।
বুকার পুরস্কারের প্রচলন হয় ১৯৬৯ সালে। এই পুরস্কার লেখকদের পেশাজীবনে গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনার জন্য বিশেষ ভূমিকা রাখে। পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখকদের মধ্যে রয়েছেন সালমান রুশদি, ইয়ান ম্যাকইওয়ান, অরুন্ধতি রায়, মার্গারেট অ্যাটউড ও সামান্থা হার্ভে। হার্ভে ২০২৪ সালে মহাকাশ স্টেশন নিয়ে গল্প ‘অরবিটাল’ এর জন্য পুরস্কার পান। এবারের পুরস্কার লাভ ডেভিড সাজালের জন্য নতুন নতুন সাফল্য নিয়ে আসবে বলে মনে করেন সমালোচকেরা।
সাজালে চূড়ান্ত তালিকায় থাকা অপর পাঁচ প্রার্থীকে পেছনে ফেলে ৫০ হাজার ব্রিটিশ পাউন্ড (৬৫ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলার) মূল্যের এ পুরস্কার জেতেন। নোবেলের পর সাহিত্যের সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ পুরস্কারগুলোর মধ্যে একটি।
পুরস্কারের জন্য করা সংক্ষিপ্ত তালিকাভুক্ত বাকি ৫টি বইয়ের কথাও বলা দরকার। এগুলো হলো: আমেরিকার সুসান চোইয়ের ‘ফ্ল্যাশলাইট’, ভারতের কিরণ দেশাইয়ের ‘দ্য লোনলিনেস অব সোনিয়া অ্যান্ড সানি’, জাপানি বংশোদ্ভূত আমেরিকান কেটি কিতামুরার ‘অডিশন’, আমেরিকার বেঞ্জামিন মার্কোভিটসের ‘দ্য রেস্ট অব আওয়ার লাইভস’, ব্রিটেনের অ্যান্ড্রু মিলারের ‘দ্য ল্যান্ড ইন উইন্টার’। কিরণ দেশাইয়ের উপন্যাসটি ৭০০ পৃষ্ঠার। তিনি আগেও একবার বুকার জিতেছিলেন। কিন্তু এবার কাছাকাছি পৌছে ছিটকে গেলেন। কিতামুরার উপন্যাসও ছিল আলোচনায়। তিনিও ছিটকে গেছেন। তবে তারা শর্ট লিস্টে থাকার সুবাদে কিছু অর্থ পাবেন, পাবেন প্রচারণা।