DailySangram-Logo-en-H90
ই-পেপার আজকের পত্রিকা

সাহিত্য ও সংস্কৃতি

বাংলা কবিতায় বসন্তের আবাহন

বাংলাদেশে ঋতু পরিক্রমায় বসন্ত যখন আসে তা দৃশ্যমান হয় প্রকৃুতে। আর দৃশ্যমান হয় আমাদের সাহিত্যে। বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে ঋতু ভিত্তিক যে সব কবিতা রচিত হয়েছে তার মধ্যে বসন্ত প্রধানতম। বসন্ত কবি মনে পৃথক কোন ব্যঞ্জনা সৃুষ্ট করে কি?

Printed Edition
Untitled-2

বাংলাদেশে ঋতু পরিক্রমায় বসন্ত যখন আসে তা দৃশ্যমান হয় প্রকৃুতে। আর দৃশ্যমান হয় আমাদের সাহিত্যে। বাংলা সাহিত্য অঙ্গনে ঋতু ভিত্তিক যে সব কবিতা রচিত হয়েছে তার মধ্যে বসন্ত প্রধানতম। বসন্ত কবি মনে পৃথক কোন ব্যঞ্জনা সৃুষ্ট করে কি? করে ধরে নিয়ে বলতে হয়, বসন্ত ঋতুতে হয়তো কবি মন আপ্লুত হয় আর প্রকাশ ঘটে, বাঙময় হয়ে ওঠে তার রচনায়। কবিতা কি? কবিরা কেন বসন্তে আপ্লুত হয়ে কবিতা রচনা করেন? এ প্রশ্নের হয়তো কোন সরল উত্তর নেই। তবে আমরা কবিতা নিয়ে কয়েক জনের ভাবনা জেনে নিতে পারি।

কবিতার সংজ্ঞা নিয়ে নানা জনে নানা কথা বলেছেন। কবি কোলরিজের কথাগুলো কালজয়ী হিসেবে চিহ্নিত। কবি কোলরিজ বলেছেন, Poetry is the best words in the best order অর্থাৎ, কবিতা হচ্ছে সর্বোৎকৃষ্ট শব্দ সর্বোৎকৃষ্টভাবে সাজানো।

কবি এডগার এলান পো বলেছেন, ও I would define, in brief, the poetry of words as the rhythmical creation of beauty অর্থাৎ, আমি সংক্ষেপে শব্দের কবিতাকে সৌন্দর্যের ছন্দময় সৃষ্টি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করব।

আমাদের একজন প্রধান কবি ও সমালোচক সৈয়দ আলী আহসান বলেছেন ‘সমস্ত শিল্পই বস্তুনির্ভর উপাদানের মাধ্যমে প্রকাশিত বোধের সামগ্রী মাত্র। কবিতার ক্ষেত্রে তার মাধ্যম যে শব্দ, তা বোধ বা ধারণার প্রতীক।’ সৈয়দ আলী আহসান তার কাব্যসমগ্র এবং কবিতার কথা ও অন্যান্য বিবেচনা গ্রন্থে কবিতা রচনার কৌশল প্রসঙ্গে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তার আলোচনায় কবিতার ভাব এবং ভাব প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে ভাষা এবং শব্দচয়ন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে।

শব্দ সর্বোতকৃষ্টভাবে সাজানোই হোক আর সৌন্দর্যের ছন্দময় সৃষ্টিই হোক কবিতা পাঠকমনকে আকৃষ্ট করে সেটাই বড় কথা। এভাবে তা বোধের সামগ্রী হয়ে ওঠে। বসন্তের আবাহনে এভাবে রাঙিয়ে ওঠে আমাদের কবিতার ভুবন।

২. ফালগুনের আগমনে বসন্ত ঋতুর আগমন ঘটেছে আমাদের ভূভাগে। শীতের রুক্খ দিনগুলো শেষ হয়ে গেলে বসন্ত তার আগমনী বার্তা নিয়ে প্রকৃতির দরজায় কড়া নাড়তে থাকে। পয়লা ফালগুন তা আসে পলাশের রঙে রাঙা হয়ে শিমুলের গাছে গাছে গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের পসরা নিয়ে।

বছর ঘুরে প্রকৃতি তার নিজস্ব নিয়মে নানা পরিবর্তন পেরিয়ে আবার সেজেছে নতুন রূপে। এই ঋতু পরিবর্তন মহান স্রষ্টার মানুষের জন্য পৃথিবীকে বিচিত্র রূপে হাজির করারই একটি প্রক্রিয়া। বসন্তের আগমনে শীতের রিক্ততা ভুলিয়ে ফাগুনের আগুনে মানুষের মন আর প্রকৃতিতে লেগেছে পরিবর্তনের ছোঁয়া। বসন্তের রঙ ও রূপে নিজেকে সাজাতে প্রকৃতি এখন মেতে উঠেছে। প্রকৃতি ধারণ করছে রূপলাবণ্যে ভরা মনোহর পরিবেশ। শীতের তীব্র রুক্ষতা কেটে পাতাঝরা বৃক্ষগুলো মাথায় দেখা দিয়েছে কচি কচি সবুজ পাতা। সেই দৃশ্য মনোহর। কবি তাই বলেছেন, ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত।

বসন্ত কে ঋতুর রাজা বলা হয়। ফাল্গুন এবং চৈত্র মাস মিলে হয় বসন্ত ঋতু। বসন্ত ঋতুর আগমন ঘটে শীত চলে যাবার পর এবং গ্রীষ্ম আসার আগে। গ্রীষ্মমণ্ডলীয় এলাকায় তাপমাত্রা বাড়তে থাকে কারণ পৃথিবী সূর্যের দিকে হেলে থাকে। পৃথিবীর অনেক প্রান্তে এই ঋতুতে ফুল ফুটে, গাছে নতুন পাতা গজায়, নতুন গাছের জন্ম হয়। এর ফলে গাছপালা বেড়ে উঠে, ফুল ও ফলের পরবর্তী বেড়ে ওঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।বসন্ত ঋতুতে বিভিন্ন ধরনের ফুল পাওয়া যায়। যেমন: মহুয়া , কুসুম, গাব, পলাশ আরও অনেক ফুল ফোটে।

শীতের রুক্ষতা কাটিয়ে প্রকৃতি ফিরে পেতে চলছে ফুল, ফল ও সবুজের এক অপরূপ সমারোহ যা এনে দিয়েছে বসন্ত। পলাশ ও শিমুলের প্রস্ফুটিত হাসিতে শিমুল বনে যেন লেগেছে লেলিহান লাল রঙ্গের আগুনের ছোয়া। বসন্তের কোকিলও তার মিষ্টি কুহুতানে মাতাল করতে এসেছে ঋতুরাজ বসন্তের সবুজ-শ্যামল বাংলাদেশে।

৩. বসন্ত আমদের সাহিত্যে নানা রঙের ফুল ফুটিয়েছে। কবিরা লিখেছেন অজস্র কবিতা।

কবি রবীন্দ্রনাথ তার “আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে” কবিতায় লিখেছেন-

আজি বসন্ত জাগ্রত দ্বারে।

তব অবগুন্ঠিত কুন্ঠিত জীবনে

কোরো না বিড়ম্বিত তারে।

আজি খুলিয়ো হৃদয়দল খুলিয়ো,

আজি ভুলিয়ো আপনপর ভুলিয়ো,

এই সংগীতমুখরিত গগনে

তব গন্ধ করঙ্গিয়া তুলিয়ো।”

রবীন্দ্রনাথ তার গানে বসন্তের ফুল ও পাখির বর্ণনাও দিয়েছেন-

“আজি এ বসন্তে কত ফুল ফোটে, কত পাখি গায়”

আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুলও বসন্তকে তুলে এনেছেন কবিতা ও গানে ।

“এলো বনান্তে পাগল বসন্ত।

বনে বনে মনে মনে রং সে ছড়ায় রে,

চঞ্চল তরুণ দুরন্ত।

বাঁশীতে বাজায় সে বিধুর পরজ বসন্তের সুর,

পান্ডু-কপোলে জাগে রং নব অনুরাগে

রাঙা হল ধূসর দিগন্ত।।”

নজরুল ১৪০০ সাল কবিতায় লিখেছিলেন-

‘আজি নব বসন্তের প্রভাত বেলায়

গান হয়ে মাতিয়াছ আমাদের যৌবন মেলায়’

‘শতবর্ষ আগেকার

তোমারি বাসন্তিকা দ্যুতি

আজি নব নবীনেরে জানায় আকুতি’ (১৪০০ সাল)

আমাদের আরেকজন মৌলিক ও প্রধান কবি ফররুখ আহমদ বসন্তের আগমনীকে দেখেছেন এভাবে-

ফাল্গুনে শুরু হয় গুনগুনানী,

ভোমরাটা গায় গান ঘুম ভাঙানি,

এক ঝাঁক পাখি এসে ঐকতানে

গান গায় এক সাথে ভোর বিহানে,

আযানের সুর মেশে নীল আকাশে

শির শির করে ঘাস হিম বাতাসে,

আচানক দুনিয়াটা আজব লাগে

আড়মোড়া দিয়ে সব গাছেরা জাগে,

লাল নয়, কালো নয়, সবুজ ছাতা

জেগে ওঠে একরাশ সবুজ পাতা,

হাই তুলে জাগে সব ফুলের কুঁড়ি

প্রজাপতি ওড়ে যেন রঙিন ঘুড়ি।

সহজ সরল বক্তব্যে এ আমাদের ভূভাগেরই মানুষের মনের কথা।

কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের ভাষায়-

ফুল ফুটুক না ফুটুক

আজ বসন্ত

শান - বাঁধানো ফুটপাথে

পাথরে পা ডুবিয়ে এক কাঠখোট্টা গাছ

কচি কচি পাতায় পাঁজর ফাটিয়ে

হাসছে।

ফুল ফুটুক না ফুটুক

আজ বসন্ত।

তার এই পক্তিটির দ্যোতনা অনেক। রূপ লাবণ্যে জেগে উঠেছে প্রকৃতি, রঙিন চারপাশ। বৃক্ষের নবীন পাতায় আলোর নাচন! ফুল না ফুটলেও কি আসে যায!

বসন্ত যে কোন কবিকে টানে। কবি মনে জেগে ওঠে নতুন নতুন সব পঙক্তি। বসন্ত বাতাস দোলা দেয় তার মনে। তার কবিতা দোলা দেয় সবার মনে।