ওমর বিশ্বাস

গত কয়েকদিন ধরে বৃষ্টি হচ্ছে। বর্ষাকালের বৃষ্টি। রোদ ঠিকমতো ওঠে, ওঠে না। থেমে থেমে বৃষ্টি হয়। আজ রাতের আকাশ বেশ অন্ধকার।

প্রথম যখন আকাশের দিকে চোখ যায় একটা লাল আলো চোখে পড়ে আসিফের। অন্ধকারে লালটা জ্বলজ্বল করছে। তার তখন পড়ায় মন ছিল। তাই তেমন কিছু মনে হয়নি। চোখ ফিরিয়ে নেবে যখন এমন সময় মনে হলো অনেক উঁচুতে কি যেন একটা নড়াচড়া করছে। লাল হলেও সেটা একজায়গায় স্থির ছিল না। তার খটকা লাগলো। সে নড়েচড়ে বসল। মনোযোগ দিলো ওই দিকে। দেখলো, অনেক দূর থেকে একটা কিছু নিচের দিকে নেমে আসছে। খুব ধীরে ধীরে।

সে অনেকক্ষণ ধরে ওই দিকে তাকিয়েছিল। দেখতে দেখতে তার চোখ ধরে যায়। চোখ কচলে নিয়ে আবার ওই দিকে তাকায়। চোখ ঝাপসা হয়ে আসে। অন্ধকারে ওভাবে এতক্ষণ তাকানোর ফলে তার চোখে পানি আসে। স্বাভাবিক হতে তার কিছু সময় লাগে।

এভাবে কতক্ষণ হয়েছে তার জানা নাই। এর মধ্যে সেটা অনেক নিচে নেমে এসেছে। এখন তা একটা ভাতের পাতিলের মতো দেখা যাচ্ছে। আসলেই কোনো একটা কিছু নিচের দিকে নেমে আসছে। তার গতিপথ আসিফের দিকেই।

আসিফ এবার গা ঝাড়া দিয়ে বসে। ভালো করে দেখার চেষ্টা করে, কি ওটা? কি হতে পারে ওটা? এরকম পাতিল মার্কা কোনোকিছুর কথা আগে কখনো শোনেনি। দেখেওনি। আরো বেশ নিচে নেমে এসেছে ওটা। এখন আকারে আরো বড় দেখাচ্ছে। আফিসের কাছে এখন মনে হচ্ছে ওটা একটা উপগ্রহের মতো কিছু।

হ্যাঁ, ওটা উপগ্রহই হবে হয়তো। সে নিজেকে বোঝায়।

সেট একটা নির্দিষ্ট কোণ ধরে নেমে আসছিল, জ্যামিতিক রেখার মতো ৭০ থেকে ৭৫ ডিগ্রি কোণে নিচের দিকে। তার চারপাশ জুড়ে একটা ঘোলাটে অবয়বের প্রলেপ তৈরি হয়েছে। আসলে ওটা কিছু না। বাতাসের ভিতর দিয়ে উপগ্রহটা আসছে। তার গতিবেগ ঠিক রাখতে বাতাস কেটে কেটে আসতে হয় বলে ওটা হচ্ছে বাতাসের ঘূর্ণন। দীর্ঘ সময় ধরে দেখতে দেখতে ওসব ভাবছিল আসিফ।

অনেকক্ষণ লাগলো তার ব্যাপারটা বুঝতে। এখনো লালবাতির মতো কিছু জ্বলছে উপগ্রহের নিচের দিকে। ওটা উপগ্রহের সংকেত। এখন অনেক নিচে নেমে এসেছে। আরো বড় দেখাচ্ছে ওটাকে। আসিফের মনে হলো, কোনো শক্তিশালী দেশ কোনোকিছু মহাকাশে পাঠাতে পারে।

এখন রাত দুইটা সতের মিনিট। ঘড়ি দেখে আসিফের মনে হলো অনেক রাত হয়েছে। এতক্ষণ কিছুই টের পায়নি। কত সময় হয়ে গেছে। আর দেরি করা যাবে না এক্ষুনি শুতে হবে। তাড়াতাড়ি বইখাতা গুছিয়ে রাখতে রাখতে ভাবলো, তাহলে কি আমি দুই ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে উপর ওই দিকে তাকিয়েছিলাম। যখন শেষবার ঘুমাতে যাবে বলে ঘড়ি দেখেছিল তখন সময় ছিল বারোটা সাত। আর জেগে থাকা যাবে না। সকালে স্কুলে যেতে হবে। সবকিছু গুছিয়ে নিতে নিতে দুই হাতের তালুর নিচ দিয়ে দুই চোখ কচলে নেয়।

আসিফের চোখ ঢুলুঢুলু করছে। সে সোজা হয়ে দাঁড়ানোর চেষ্টা করে। সে ঘুমাবে না। তবু একসময় আসিফ ঘুমিয়ে পড়ে। এরপর কি হয়েছিল তা আর ওর মনে নেই।

উপগ্রহটা ভূ-পৃষ্ঠের কাছাকাছি আসতে একটা সবুজবাতি জ্বলে ওঠে। সিগন্যাল ঠিকমতো পেয়েছে। এখন লালবাতি আর নাই। তারা সঠিক জায়গার কাছাকাছি এসে গেছে। সবকিছু ঠিকঠাক মতো হলে একটা নির্দিষ্ট বলয়ের মধ্যে প্রবেশ করার সাথে সাথে সবুজ সিগন্যাল জ্বলে ওঠার কথা।

এ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকমতো হয়েছে।

আসিফের ধারণাই ঠিক ছিল। এটা একটা কৃত্রিম উপগ্রহ। কোথাও থেকে পাঠানো হয়েছে। পৃথিবীর যে কোনো জায়গায় যে কোনো সময় এটা অবতরণ করতে পারে। সেভাবেই বানানো হয়েছে এটাকে।

এই সময়টার জন্য অপেক্ষা করছিল সবাই। সবুজবাতি জ্বলে ওঠার সাথে সাথে সিগন্যাল বাজতে শুরু করেছে মূল কেন্দ্রে।

ভিতর থেকে প্রায় শ’ দুয়েক লোক চিৎকার দিয়ে উঠল। পৃথিবীতে এটাই তাদের প্রথম অভিযান। আজ প্রথমবারের মতো তারা পৃথিবীতে অবতরণ করতে যাচ্ছে। তাদের ধারণা তারা সফল হতে যাচ্ছে। ভিতরে সবাই খুব উৎফুল্ল। তাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার ব্যাপারে তারা খুবই আশাবাদী। ধরে নিয়েছে তারা সফল হবে। এই সফল অবতরণের মধ্যে দিয়ে সেটা একটা পর্যায় অতিক্রম করল। সব মিলে এই মুহূর্তটাকে স্মরণীয় করে রাখতে চায়। খুশিতে সবাই একে অন্যের সাথে চিয়ার্স করে নিল। তারা আনন্দ করল। খাওয়াদাওয়া করল। কেক কাটলো।

এই সবুজবাতি জ্বলে ওঠা ছিল তাদের একটা টার্নিং পয়েন্ট। যতক্ষণ না সবুজবাতি অটোমেটিক জ্বলে উঠবে ততক্ষণ তারা চেষ্টা করবে এই ছিল তাদের পরিকল্পনা। তবে তারও একটা নির্দিষ্ট সময় বলা আছে। কিন্তু সে পর্যন্ত আর তাদের অপেক্ষা করার প্রয়োজন হয়নি। সবকিছু ছকের মধ্যেই পটাপট হয়ে গেছে।

অনেকক্ষণ ধরে তারা এই ল্যান্ডিং মার্কে সফলতার সাথে প্রবেশ করতে পারাটা উদযাপন করল।

পৃথিবীর মানুষ কেউ জানে না।

এটাই তাদের ভূ-পৃষ্ঠে প্রথম মিশন। (চলবে)