গোলাম আশরাফ খান উজ্জ্বল

কবর কবিতা পল্লীকবি জসীম উদ্দীন রচিত একটি অসম্ভব সুন্দর ও প্রাঞ্জল সহজবোধ্য কবিতা। এ কবিতাটি যতবার পড়েছি ততবারই কেঁদেছি। কবিতাটির ভাষা হৃদয়ের গভীরে ছুঁয়ে যায়। পল্লীকবি জসীম উদ্দীন রচিত কবর কবিতাটি ১৯৭৯ সালের দিকে প্রথম আবৃত্তি শুনেছিলাম। মন্ত্রমুগ্ধের মতো তখন শুনেছি। এর পর ১৯৮৭ সালের দিকে আমি নিজে কবিতাটি আবৃত্তি করি। কবর কবিতার হৃদয় ছোঁয়া ভাষা পঠক মাত্রই আবেগ তাড়িত হবে।

পল্লীকবি জসীম উদ্দীনের ‘কবর’- এ কবিতাটি একটি কাহিনী ধরনের কবিতা। এ কবিতাটি ১৯২৫ সালে কল্লোল পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। কবিতাটি কল্লোল পত্রিকার তৃতীয় বর্ষের তৃতীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হওয়ার সাথে সাথে বাঙালি পাঠক মহলে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। জসীম উদ্দীনও কবি হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে যান। কবর কবিতাটি ষান্মামাত্রিক মাত্রাবৃত্তের ছন্দে লিখিত। এ ধরনের কবিতাকে ‘ড্রামাটিক মনোলগ’ কবিতা বলে। কবি গ্রামের এক বৃদ্ধ দাদুর মুখ দিয়ে তার প্রিয়জন হারানোর কথা প্রকাশ করছেন নাতির কাছে। কবর কবিতাকে আমরা ঊষবমু ধরনের শোকগাঁথা কবিতা। কবর মর্মস্পশী কবিতা।

কবি জসীম উদ্দীন ছিলেন বহুমাত্রিক ও সৃজনশীল। তার অমর সৃষ্টি হলো কবর কবিতা। অগুনতি পাঠকের হৃদয় ও মন জয় করা কবিতা হলো কবর। ১৯২৫ থেকে শুরু হয়ে আজ ২০২৫ সাল পর্যন্ত ‘কবর’ কবিতা পাঠ করে প্রতিজন পঠক আত্মতৃপ্তি পান। আমরা কেউ না কেউ আপন জন হারানো। কেউ বাবা হরিয়েছেন। কেউ মাকে। আবার কেউ বাবা-মা দুজনকেই হারিয়েছেন। কারো ভাই, কারো বোন হারানো বেদনা তো আছেই। শহর কিংবা গ্রামে আপনজন হারানোর ব্যথা একই। সেই দিক দিয়ে কবর সার্থক শোকগাঁথা কবিতা।

কবি জসীম উদ্দীনের কবর কবিতা প্রকাশের পর কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দীনেশচন্দ্র সেন ও অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কবিতাটির প্রসংশা করেছিলেন। কবি জসীম উদ্দীনের ছাত্র অবস্থায়ই কবর কবিতা পাঠ্যবইয়ে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায় কবি হিসেবে নিজের অবস্থান জানান দেন।

এখানে কবিতাটির কয়েকটি চরণ তুলে ধরা হলো-

‘এইখানে তোর দাদির কবর ডালিম গাছের তলে,

তিরিশ বছর ভিজায়ে রেখেছি দুই নয়নের জলে।

এতটুকু তারে ঘরে এনছিনু সোনার মতন মুখ,

পুতুলের বিয়ে ভেঙে গেল বলে কেঁদে ভাসাইত বুক।’

কবিতার প্রথম কয়েকটি চরণ পাঠ করলেই এর অন্তর্নিহিত ভাবধারা অনুধাবণ করা যায়। গ্রামের বৃদ্ধ দাদু তার শ্রোতা নাতিকে তার জীবনে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন শোক ও আনন্দের কথা শোনাচ্ছেন। নাতিও দাদুর শোক ও আনন্দের কথা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনে যাচ্ছে একাগ্র চিত্তে।

কবর কবিতার এক জায়গায় রোমান্স রয়েছে। রয়েছে গ্রামীণ আনন্দ। যেমন

‘যাইবারকালে ফিরে ফিরে তারে দেখে লইতাম কত,

একথা লইয়া ভাবি- সাব মোরে তামাশা করিত শত।’

সুন্দরী দাদিকে মাঠে কাজ করতে যাবার সময় দাদা বারবার দেখতেন তা নিয়ে দাদা ভাইয়ের সাথে তার ভাবি সাবরা অনেক দুষ্টুমী করতো। এখানে কবি জসীম উদ্দীন পল্লী গাঁয়ের পারিবারিক বন্ধন চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন।

কবর কবিতায় আরো কয়েক চরণে দাদু ও দাদির Romantic দৃশ্য পাই। যা গ্রামের ভাষায় মসকরা বা তামাশা বলে। যেমন-

‘বাপের বাড়িতে যাইবার কালে কহিত ধরিয়া পা

আমারে দেখিতে যাইও কিন্তু উজান - তলীর গাঁ।

শাপলার হাটে তরমুজ বেচি দু’পয়সা করি দেড়ি

পুঁতির মালা একছড়া নিতে কখনও হত না দেরি।

দেড় পয়সার তামাক এবং মাজন লইয়া গাঁটে

সন্ধ্যাবেলা ছুটে যাইতাম শ্বশুরবাড়ির বাটে।

হেস না হেস না শোন দাদু, সেই তামাক মাজন পেয়ে

দাদি যে তোমার কত খুশি হত দেখিতিস যদি চেয়ে।

নথ নেড়ে নেড়ে কহিত হাসিয়া, এত দিন পরে এলে

পথপানে চেয়ে আমি যে হেথায় কেঁদে মরি আঁখি জলে।’

কবর কবিতার এই ১০টি চরণে কবি জসীম উদ্দীন গ্রামীণ জীবনে স্বামী স্ত্রীর ভালোবাসা, প্রেম, আদর, সোহাগ, আনন্দ, আবেগ সুনিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। এ বর্ণনা দাদুর কাছে শুনে নাতিতো হেসে কুটিকুটি।

কবর কবিতায় কবি জসীম উদ্দীন পাঁচটি চরিত্র উপস্থাপন করেছেন। চরিত্র গুলো হলো- দাদু, নাতি, দাদুর ছেলে বা নাতির বাপ,নাতির মা দাদু মেয়ে বা নাতির ফুপু। এছাড়াও আছে হালের বলদ, লাঙল, জোয়াল মাথাল, ঘুঘু, রামধনু, বৃক্ষরাজি, পথিক আরো কত কি!

জীবনাবসান হলে সব সব ধর্মেই দোয়া ও প্রার্থনা করা হয়। কবি জসীম উদ্দীনও এর ব্যতিক্রম নন। তাই কবিতার শেষ দিকে লিখলেন-

‘ওই দূর বনে সন্ধ্যা নামিছে ঘন আবিরের রাগে

অমনি করিয়া লুটায়ে পড়িতে বড় সাধ আজ জাগে।

মসজিদ হইতে আযান হাঁকিছে বড় সকরুণ সুর

মোর জীবনের রোজ কেয়ামত ভাবিতেছি কত দূর।

জোড় হাত দাদু মোনাজাত কর, আয় খোদা রহমান

ভেস্ত নসিব করিও সকল মৃত্যু- ব্যথিত প্রাণ।’

কবর কবিতায় শোক, দুঃখ বেদনা, নারী নির্যাতনের চিত্রও ফুটিয়ে তুলেছেন পল্লীকবি জসীম উদ্দীন। ১১৮ চরণ বা লাইনের কবর কবিতটি ‘রাখালী’ কব্যগ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত। কবিতাটি কবি জসীম উদ্দীনের অনন্য সৃষ্টি। ‘কবর’ কবিতাটি বাংলার পাঠকেরা শত বছর নয়, সহস্র বছর অন্তরে লালন করবে বলে দৃঢ় বিশ্বাস।