শাহানারা স্বপ্না

বাংলাদেশের একজন জনপ্রিয় সাহিত্যিক ও বিখ্যাত ছড়াকার। পুরস্কৃত হন বাংলা একাডেমি ও শিশু একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারে। তার লিখিত ‘সফদার ডাক্তার’ কবিতাটি চল্লিশের দশক থেকে এখনো ভীষণ জনপ্রিয়। এ ছড়াটি স্কুলের বইয়ে পাঠ্য ছিল। হোসনে আরা বাংলাদেশের একজন বিখ্যাত ছড়াকারই নন, একজন বিশিষ্ট সাহিত্যিক ও কবি। তাঁর লেখা অসম্ভব জনপ্রিয় ‘সফদার ডাক্তার ‘ কবিতাটি তাঁর অনন্য প্রতিভার নজির। ছোটবেলায় আমরা স্কুলের পাঠ্যবইয়ে এ ছড়াটি মুখস্থ করেছি। খুব মজা করে এটি পড়া হতো। স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় এ কবিতার নাটক, কমিক বানিয়ে পরিবেশন করা হতো।

কবি হোসনে আরা ১৯১৬ সালে পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরপিয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। বাবা মুন্সি এবাদুল্লাহ ছিলেন খুবই সংস্কৃতিবান মানুষ। ভালোবাসতেন বইপড়া ও সাহিত্য চর্চা করতে। পুঁথি ছিলো তাঁর প্রিয় বিষয় এবং নিজেই একজন নামকরা পুঁথি লেখক ছিলেন। সাহিত্যকে ভালোবেসে পুঁথি-কাব্য রচনায় বুঁদ হয়ে থাকতেন। মূলত একসময় আমাদের সমাজে কবিদের খুব কদর ছিলো, সমাজে ছিল উচ্চ মর্যাদা। সুলতানী ও মোগল আমল থেকে চলে আসা ধারাবাহিকতায় কাব্যের প্রতি ছিলো মানুষের দুর্বার আকর্ষণ। তখনকার কবিরা ফার্সী ভাষায় বয়েত লিখতেন এবং কবিতার ছিলো জয়জয়কার। বাদশাহ থেকে ভিস্তি পর্যন্ত সবাই শের আওড়াতো। সে সময়ের ইতিহাসে তাই দেখা যায় জীবনের প্রতিটি পদবিক্ষেপে তারা কবিতা আবৃত্তি করতেন। নারীরাও পিছিয়ে ছিলো না। নারীরাও কবিতা বলতে পছন্দ করতেন। রাজমহল থেকে সাধারণ গৃহ সবর্ত্র ছিল কাব্যিকতার রেশ। সময়ের স্রোতে সেই সমৃদ্ধ সময় হারিয়ে গেলেও পুঁথিকারগণ নিজেদের মধ্যেই অস্তিত্বের মতোই লালন করতেন পুঁথির চর্চা। হোসনে আরার পিতাও ছিলেন তেমনি একজন ঐতিহ্যবাহী পুঁথি-কলমধারী।

তিনি কন্যার পড়ার প্রতি ছিলেন অত্যন্ত উৎসাহী। তাকে শিক্ষার সবক দিতে চান। কিন্তু গ্রামে মেয়েদের লেখাপড়ার সুযোগ-সুবিধা ছিল না, এমনকি তখন স্কুলে যাওয়ার রেওয়াজও গড়ে ওঠেনি। প্রাচীন ভারতে ঘরেই গুরুমুখী শিক্ষার প্রচলন ছিল। মুসলিম আমলেও বিভিন্ন বিষয়ে শিক্ষক-ছাত্র ঘরে বসেই শিক্ষা সমাপ্ত করতো। ইংরেজ আমলেই চালু হয় শিক্ষার বাণিজ্যিক রূপ। টাকার বিনিময়ে বিদ্যায়তনে বসে শিক্ষা নেয়ার প্রচলন চালু হওয়ার পর মুসলমানরা সহজে এ পদ্ধতিকে গ্রহণ করতে পারেনি। কারণ মুসলিম আমলে শিক্ষা হতো প্রায় বিনামূল্যে। রাষ্ট্রপ্রধান জনগণের শিক্ষার ব্যয়ভার বহনের জন্য প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে বিশাল নিষ্কর ভূমি প্রদান করতেন।

হোসনে আরাকে মাত্র সাত বছর বয়সেই তার পিতা তাঁকে ঢাকায় চাচা, ডক্টর মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ সাহেবের বাসায় পাঠিয়ে দেন। চাচার বাসায় পড়ালেখার ব্যবস্থা হয়, তবে পর্দার আড়ালে। পর্দার একপাশে মৌলভি সাহেব আর অন্য পাশে হোসনে আরা এবং তার চাচাত বোনেরা। তখন এভাবেই চলত মেয়েদের লেখাপড়া। পড়ার সুযোগ পেয়ে হোসনে আরা তো ভীষণ খুশী। পড়ার প্রতি অখন্ড মনোযোগ, অনেক বড়ো হতে চায় সে।

বছরখানেক পার হলো উৎসাহ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে। হঠাৎ একদিন খবর এলো, হোসনে আরার বাবা অসুস্থ। প্রিয় পিতার অসুস্থতার কথা শুনে চঞ্চল হয়ে উঠলেন। চলে গেলেন বাবার কাছে। সেখানেই রয়ে গেলেন, ঢাকায় আর ফেরা হলো না। প্রথাগত শিক্ষা বন্ধ হলেও হোসনে আরা হাল ছেড়ে দেননি। নিজের চেষ্টায় পড়াশোনা চালিয়ে যেতে লাগলেন। অনেক কষ্টে গ্রামে বসেই বই ও পত্র-পত্রিকা সংগ্রহ করে পড়তে লাগলেন। একান্ত নিজের চেষ্টায় স্বশিক্ষিত হোসনে আরা সমৃদ্ধ মননের অধিকারী হয়ে ওঠেন। শিক্ষার আলোয় তিনি সত্যিকার অর্থেই অবগাহন করেন।

মাত্র চৌদ্দ বছর বয়সে হোসনে আরার বিয়ে হয়ে যায় প্রখ্যাত সাহিত্যিক, সাংবাদিক মোহাম্মদ মোদাব্বের-এর সাথে, যিনি পরে লেখক, ইতিহাসবিদ, বিপ্লবী ও রাজনিতিক হিসেবে বিখ্যাত হন। লেখার জন্য বাংলা একাডেমি ও একুশে পদক পুরস্কারে ভূষিত হন। তিনি দৈনিক মিল্লাত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ছিলেন।

হোসনে আরা ছিলেন কৃষ্ণকায়া কিন্তু চোখেমুখে বুদ্ধিদীপ্ততার ঝলক। এ বিয়ে প্রসঙ্গে মোহাম্মদ মোদাব্বের চমৎকার করে লিখেছেন-

“পুলিশ আমার পিছু নিয়েছে, একথা জানাজানি হয়ে গেল। অভিভাবকদের ভাবনার অন্ত নেই, বিধবা মা কেঁদে কেঁদে বুক ভাসাতে লাগলেন। এবং তাঁরা অনেক শলা-পরামর্শ করে ঠিক করলেন যে, তাঁদের ছেলেকে বাঁচাবার একমাত্র দাওয়াই, একটা বিয়ে দেওয়া। আমি বিয়ে করতে রাজী কি না, তা জানবার দরকারও তাঁরা মনে করলেন না। পাত্রীর সন্ধান চলতে লাগলো এগাঁয় ওগাঁয়। আমি ঘাড় বেঁকিয়ে বসলে মায়ের কান্নার মাত্রা চতুরগুন বেডে যায়। মা এবং অভিভাবকগণ সুন্দরী পাত্রী খোঁজেন, কারণ তাঁদের মতে সুন্দরী বউ না হলে নাকি আমাকে ঘরে আটকে রাখা যাবে না।

ৃ.. ১৯৩০ সালের শীতকালের দিকে আমার চাচাতো বোনের আকদ্ উপলক্ষে কলকাতা থেকে ঢাকায় আসি। সেখানে আর এক চাচাত বোনকে দেখলাম। সে কৃষ্ণকায়া এবং অবিবাহিতা। তবে চোখে-মুখে কিছুটা বৈচিত্র্য লক্ষ্য করি। মনে হল, এই মেয়েটা হলে মন্দ হয় না। ১৯৩০ সালের ২৫শে মে বিয়ে করে ফেললাম। বাচ্চা গৃহিণী ঘরে এলো। পাড়াপড়শীরা বউ দেখে নাক সিঁটকায়। ঘর আলো করা বউ না এনে আনলো কি না ঘর আঁধার করা কালো বউ ! আমি অনেককে ঝাঁঝালো কন্ঠে বলি : রাতে ঘুমাবার সময় তো ঘর আঁধার করেই শুতে হয়”!

হোসনে আরার জীবনে তার স্বামী ছিলেন আশীর্বাদ স্বরূপ। স্বামীর ভালোবাসা ও স্নেহের ছত্রছায়ায় প্রতিভা পূর্ণ বিকাশের সুযোগ পান। তার পড়াশোনার দিকে বিপুল আগ্রহ দেখে এই উদার মানুষটি হোসনে আরাকে সহযোগিতা কবতে লাগলেন। উৎসাহ দিলেন বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখতে। মোহাম্মদ মেদাব্বের বৃটিশ-বিরোধী আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তাঁর জীবনের অনেকটা সময় কেটেছে জেল-জুলুমের ভেতর। স্ত্রী হোসনে আরা যখন দেশের স্বাধীনতার আন্দোলনে যোগ দিলেন, তিনি বাঁধা না দিয়ে পাশে দাঁড়ান। সে যুগের নিরিখে তা ছিল অসীম সাহসিকতা ও বিরল মানসিকতার কাজ। সেজন্য ঘরে-বাইরে উভয়কে ভয়ানক নিগ্রহের শিকার হতে হয়েছিল। তাঁদের উভয়ের মিলিত সংগ্রামী জীবন যে কোন রোমঞ্চকর উপন্যাসকেও হার মানায়। দুজনে মিলিতভাবে বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় ছিলেন। সাহিত্যে ইতিহাসে এমন বিপ্লবী জুটি কমই দেখা যায়। দেশপ্রেমিক ও স্বাধীনচেতা এই জুটি জীবনের যে কোন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করেছেন একসাথে। গ্রামের বধু হয়ে শহরে চলাফেরা, বিপ্লবে যোগ দেয়া, মিছিলে অংশগ্রহন করা এসেব তখন মানুষের চিন্তার বাইরে ছিল। হোসনে আরা সমস্ত প্রতিকূলতাকে হাসিমুখে জয় করে স্বামীর সাথে তার বিশ্বাস ও প্লিবে সঙ্গ দিয়েছেন। নিজেও বিপ্লবী র্কী হিসেবে দুঃসাহসিক কাজ করেছেন। সেই সাথে গ্রামে গড়ে তুলেছেন তাঁবোনা প্রকল্প, হাতের কাজে মেয়েদেরকে চেষ্টা করেছেন নিজের আয়ে উদ্বুদ্ধ করতে। হোসনে আরাই প্রথম বাঙালি মুসলিম নারী যিনি ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়ে জেল খেটেছিলেন। সমাজের সমস্ত দণ্ড মাথায় নিয়েও নিজ সংকল্পে অবিচল ছিলেন। তাঁর এই অনমনীয় ব্যক্তিত্বই তাঁকে অনন্য উচ্চতায় স্থাপিত করেছিল।

মোহাম্মদ মোদাব্বের হোসনে আরার বিপ্লবী হয়ে ওঠা সম্পর্ক লিখেছেন—

“মা আমার স্বপ্ন দেখেছিলেন, পুত্রবধু নিয়ে তিনি সুখের সংসার গড়বেন। পুত্র তাঁর ঘরমুখো হবে। কিন্তু অচিরে তাঁর সে স্বপ্ন ভেঙে গেল। আমার স্ত্রী একদিন আমাকে সোজাসুজি জিজ্ঞাসা করলো :

-‘দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে শরীক হওয়া উচিত বলে তুমি মনে কর?’

-‘হ্যাঁ, মনে করি। আমাদের সঙ্গী অনেক মেয়ে আছে। তারাও জীবনপাত করতে প্রস্তুত।’ আমি জওয়াব দিলাম।

-‘তাহলে তোমার স্ত্রী যদি স্বাধীনতা যুদ্ধে যোগ দেয়, তুমি কি আপত্তি করবে?’

আমি বললাম : ‘আপত্তি করবো কেন? তবে তোমার বয়স তো খুব কম !’

ও আর কিছু বল্ল না। আমিও বিপদ কেটে গেল মনে করে নিশ্চিত হলাম।

১৯৩২ সাল। অহিংস-অসহযোগ আন্দোলন আবার জোরে শোরে শুরু হয়েছে। দলে দলে গান্ধীবাদীরা আইন অমান্য করে জেলে যাচ্ছে। ২৬ জানুয়ারি ভারতের স্বাধীনতা দিবস পালন করা হবে। এজন্য উদ্যোগ আয়োজন চলছে। এ সময় আমার স্ত্রী হঠাৎ গ্রাম থেকে কলকাতায় এলো। ২৫ জানুয়ারি সকালে সে আমাকে বলল যে,’ ২৬ জানুয়ারি মনুমেন্টের তলায় এক বিরাট সভা হবে। অধ্যাপিকা জ্যোতির্ময়ী গাঙ্গুলি এই সভায় সভাপতিত্ব করবেন কথা ছিল, কিন্তু তিনি গ্রেফতার হয়েছেন। আমি এ সভায় জাতীয় পতাকা তুলবো ও সভানেত্রীত্ব করবো। তুমি বাধা দিতে পারবে না ।

আমি গৃহিণীর কথা শুনে হতভম্ব হয়ে গেলাম। কিন্তু বারণ করতে পারলাম না।’

মোহাম্মদ মোদাব্বের স্ত্রীকে যেমন বাধা দেননি, তেমনি সবসময় তাকে ছায়ার মতো অনুসরণ করে আগলে রেখেছিলেন।

সেসময় থেকেই হোসনে আরা সমাজ সচেতন হয়ে ওঠেন। মোহাম্মদ মোদাব্বেরের সহায়তায় নিজ গ্রামে তাঁত বসান এবং গাঁয়ের লোকদেরকে কাপড় উৎপাদনে মেয়েদের উৎসাহ দেন। দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য দিনের পর দিন কাজের সাথে সম্পৃক্ত থেকে অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। সম্মিলিতভাবে বিভিন্ন সামাজিক কাজে সক্রিয় হয়ে নেতৃত্ব দেন। তখন দেশে ইংরেজ বিরোধী অসন্তোষ নতুন করে শুরু হয়েছে। এর আগে মুসলমান সমাজ আন্দোলন সংগ্রাম করে দেড় শতাব্দী ধরে রক্ত ঝরিয়ে নি”স্ব হয়ে পড়েছিল। তারা নিষ্ক্রিয় হওয়ায় আন্দোলন সংগ্রাম থেমে গিয়েছিল। উনিশ শতকে নতুন করে হিন্দু সমাজ স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু করে এবং স্বাধীনতার ডাক দেয়। দেশ জুড়ে তারই ডামাডোল বেজে উঠেছে। হোসনে আরা বিপ্লবীদের সাথে পুরোপুরি একাত্ম হয়ে যান।

হোসনে আরা যখন কংগ্রেসের পতাকা উড়িয়ে জনতার সামনে বক্তৃতা করছিলেন, তখন কয়েকশত পুলিশ তাদের ঘেরাও করে ফেলে। জোর করে পুলিশভ্যানে তুলে লালবাজার পুলিশ সদর দপ্তরে নিয়ে যায়। ১৪৪ ধারা ভংগ করার অপরাধে হোসনে আরারসহ কয়েকজনের ছয় মাসের জেল হয়। তখন তার মাত্র বয়স ছিল ষোল বছর। কলকাতার প্রেসিডেন্সী জেলে হোসনে আরাসহ প্রায় সত্তর জন আন্দোলনকারিনি রাজবন্দীকে একসাথে রাখা হয়। প্রতি ১৫ দিন পর পর স্বামী মোহাম্মদ মোদাব্বের তার সাথে দেখা করতে আসেন। সেখানে তিনি সঙ্গীনীদের মাঝে তিনিই ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। এ কারণে অন্যরা তাঁকে আদর-স্নেহ করতেন বলে উল্লেখ করেছেন।

জেলে বসেই শুরু করেন লেখালেখি। চাহিদা মতো বই-খাতা-কলাম সবই সরবরাহ করতেন মোহাম্মেদ মোদাব্বের। তিনি স্ত্রীকে সাহস যোগাতেন। হোসনে আরা সঙ্গী-সাথীরা তার স্বামীর ভূয়সী প্রশংসা করতেন। মার্চ মাসে হোসনে আরাদের পুরো দলকে কলকাতা থেকে মেদেনীপুরের হিজলী মহিলা স্পেশাল জেলে বদলী করা হয়। ভ্রাতুষ্পুত্রীকে জেল থেকে ছাড়িয়ে নিতে ড. শহীদুল্লাহ্ সাহেবের পরিবার থেকে অনেকে তৎপরতা দেখানো হয় কিন্তু হোসনে আরা কোন প্রকার মুচলেখা দিয়ে মুক্তি পেতে রাজী নয়। কোন ধরনের চাপের মুখে নতি স্বীকার করেননি। পরে হিজলী থেকে বহরমপুর জেলে পাঠানো হয়।

এসময়ে ১৯৩২ সালের ৭ এপ্রিল মোহাম্মদ মোদাব্বের সাহেবকে সংগঠনের নির্দেশে গোপনে অস্ত্র সরবরাহের কাজে যেতে হয় পাঠান মুলুক পেশোয়ারে। সেখানের মিশন শেষ করে ফেরার পথে দিল্লীর শাহাদারা স্টেশনের পুলিশের হাতে ধরা পড়েন। দুই মাস পরে ৩০ জুন মুক্তি পেয়েই প্রথমে ছোটেন বহরমপুরের জেলে হোসনে আরা খোঁজে। হোসনে আরা মুক্তি পান ২৭ আগস্ট। শিয়ালদহ স্টেশনে শতশত কংগ্রেস কর্মী এসে জড়ো হলেন এবং হোসনে আরাকে অজস্র ফুলের মালায় বরণ করে সন্বর্ধনা জানান।

কয়েক মাস কলকাতা থাকার পর বসির হাটের গ্রামের বাড়ি আসেন হোসনে আরা। এ প্রসঙ্গে মোহাম্মদ মোদাব্বের লিখেছেন” গ্রামে আমাদের উপর শুরু হল কুসংস্কারে অন্ধ লোকদের অত্যাচার। পড়শীরা সকলেই প্রায় আমাদের বয়কট করে বসলো। আমার এক দূর সম্পর্কের বড় ভাই প্রকাশ্যে বলে বেড়াতে লাগলো যে, এই বউকে বাড়িতে থাকতে দেবো না। মুসলমানের মেয়ে বেপর্দা হয়ে মিটিং করবে, জেল খাটবে, এ অনাচার আমরা সইবো না..।” তারা রক্তচক্ষুর ভয় দেখিয়ে হোসনে আরাকে সংস্কারমূলক কাজ থেকে নিবৃত্ত করতে চায়। কিন্তু এলাকার শিক্ষিত তরুন ও যুব সমাজ এদেরকে প্রতিহত করতে এগিয়ে আসে। তাদের সশ্রদ্ধ সমর্থন ও ভালোবাসা পেয়ে হোসনে আরার পরিবার নিরাপত্তা পায়। দলাদলির একটা অদৃশ্য রোঁয়াব চলতে থাকে। বেশীরভাগ বয়স্করা হোসনে আরাদের বিরুদ্ধে উষ্মা ও কুৎসা রটনা করতে থাকে। অন্যদিকে গ্রামের তরুণ সমাজ হোসনে আরাদের সকল কাজে সহায়ক হয়ে ওঠে।

জেলে থাকতেই হোসনে আরা লিখতে শুরু করেন। প্রথম লেখা প্রকাশিত হয় দৈনিক আজাদের ‘মুকুলের মাহফিলে।’ এরপর বিভিন্ন পত্রিকায় প্রচুর ছড়া লেখেন। ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয় প্রথম ছড়ার বই ‘ ফুলঝুরি’। তিনি মূলত: ছড়াকার হিসেবে বিখ্যাত হন। শিশু-কিশোরদের মধ্যে অর্জন করেন প্রচুর জনপ্রিয়তা। তাঁর লেখা ‘সফদার ডাক্তার’ ছড়াটি সে সময়ে প্রচুর সাড়া জাগিয়েছিল। তিনি ছিলেন শিশু-কিশোর মনের কাছাকিাছি। শিশুদের জন্য প্রচুর লিখেছিলেন। ‘খেয়াল খুশি’, হল্লা’, টুংটাং, হট্টোগোল’ ইত্যাদি বই শিশু-কিশোররা অনাবিল আনন্দে গ্রহণ করেছিল। ‘মিছিল’ নামে প্রকাশ পেয়েছিল একটি কবিতার বই। তাঁর কবিতায় ফুটে উঠেছে সামাজিক বাস্তবতা। লেখায় রয়েছে গভীর জীবনবোধ, কাব্যিক সৌন্দর্য এবং সমাজের প্রতি প্রতিবাদী চেতনা। নিজের বিপ্লবী জীবনকে স্মরণ করে লিখেছেন সমৃদ্ধ আত্মজীবনী ‘আমার কারাবরণ’। যদিও সে সময়ের অসচেতন সমাজে তা মূল্যায়ন পায়নি।

সাহিত্যের ছড়া-কবিতা শাখায় বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ অর্জন করেছেন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য-পুরস্কারে ভূষিত হন। এই গুনী সাহিত্যিক শিশু একাডেমি পুরস্কার পান ১৯৯২ সালে। বাংলাদেশের নারী সাহিত্য জগতে বিরল এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন তিনি। অথচ হোসনে আরার এই অসামান্য কীতির্র কথা কোথাও তেমন আলোচিত হয় না।

সুখী দম্পতি হিসেবে কবি হোসনে আরা ও মোহাম্মদ মোদব্বের হোসেন শান্তিপূর্ণ জীবন যাপন করেন। তাঁদের চার পুত্র ও এক কন্যা সন্তানসহ মোহাম্মদপুরের গজনবী রোডে বসবাস করতেন। তাঁরা সারা জীবন দেশমাতৃকার সেবা করে গেছেন। তাঁরা বৃটিশবিরোধী আন্দোলনে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিলেন, তেমনি বাহান্নর ভাষা আন্দোলন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও ছিলেন সক্রিয়। একাত্তরে মুক্তযোদ্ধাদের জন্য তিনি গ্রামের মেয়েদের নিয়ে কাপড় বুনে দিতেন এবং রেডক্রসের মাধ্যমে তা পৌঁছে দিতেন। মুক্তিযোদ্ধাদের নানা রকমভাবে সাহায্য সহযোগিতা করেছেন। তাঁরা দুজনে মুক্তিবাহিনীর সাথে নিরাপদ যোগাযোগের জন্য এক অভিনব পন্থা বের করেন। বেশ কংয়েকটি পেন্সিল ভেঙে দুটুকরো করে একভাগ নিজেদের কাছে অন্যভাগ মুক্তিবাহিনীর ছেলেদের কাছে থকেতো। এভাবে সাংকেতিক চিহ্নের মাধ্যমে নিশ্চিন্ত সংযোগ রাখতেন। তাঁরা ছিলেন দুই অতন্দ্র প্রহরীর মতো, শত্রুর গতিবিধির পের। গ্রামের মেয়েদের অর্থনৈতিক মুক্তি ও স্বাধীনতার জন্য তিনি অজস্র কাজ করেছিলেন। গাঁয়ে গাঁয়ে ঘুরে তিনি তাঁতের কাজ শেখাতেন। অবসরে মেয়েদের নিজের কাজ করতে উৎসাহ যোগাতেন, যাতে তারা স্বাবলম্বী হতে পারে।

১৯৯৯ সালের ৩০শে মার্চ এই মহীয়সী নারী ঢাকায় ইন্তিকাল করেন। বাংলাদেশের নারী সাহিত্যের অঙ্গনে তিনি এক উজ্জল জ্যোতিষ্ক। ১৯৬১ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত এই লেখকের সকল বই বাংলা একাডেমি কতৃর্ক প্রকাশিত হলেই তাঁর প্রতি যথাযত সম্মান প্রদশর্ন করা হবে।