সেদিন ছিল ১৯ জুলাই, শুক্রবার, দু’হাজার চব্বিশ। ঢাকার পথঘাট সব বন্ধ। ছাত্রদের আন্দোলন চলছে। অযৌক্তিক কোটা প্রথার বিরুদ্ধে যৌক্তিক আন্দোলন। ছাত্রদের এই দাবির পক্ষে দেশের জনসাধারণও একাট্টা হয়ে যায়। সবাইকে দমনের জন্য ফ্যাসিবাদ সরকার দেশে ১৪৪ ধারা জারি করে পথরুদ্ধের সাথে সবার কণ্ঠও রোধ করতে চেয়েছিল। এমন পরিস্থিতিতে আমি বিকল্প পথে বাবুবাজার হয়ে বেড়িবাঁধ দিয়ে মোহাম্মদপুর-এর দিকে এগুতে লাগলাম। ড্রাইভারকে বললাম,‘ সাবধানে যেও, ধীরে ধীরে যাও, সামনে কোনো সমস্যা দেখলে এগুবে না।’ সিএনজিওয়ালা পরিস্থিতি বুঝে এগুচ্ছে। কিন্তু রায়েরবাজার বধ্যভূমি পর্যন্ত এসে সিএনজি থেমে গেল। বধ্যভূমির পরই বুদ্ধিজীবী কবরস্থান। কবরস্থানের সামনে প্রায় শ’দুয়েক লোকের জটলা। কয়েকজন একটি লাশ কাঁধে করে দাফন করার জন্য কবরস্থানে ঢুকছে। ভিড়ের ভেতর থেকে একজন বললো, ‘সামনে আর আগাইয়েন না, বসিলার ঐ মোড়ে গোলাগুলি চলছে, কিছুক্ষণ আগে দু’জন ছাত্রের গুলিবিদ্ধ লাশ পড়ে আছে। ভয়ে কেউ লাশগুলাও আনতে যাচ্ছে না।’ আমি সিএনজিওয়ালার ভাড়া মিটিয়ে দ্্রুত নেমে ছোট্ট একটা গলি দিয়ে পাশেই কাদেরিয়া হাউজিং-এ ঢুকে গেলাম। দূর থেকে গুলির আওয়াজ শুনতে পেলাম, সেই সঙ্গে পুলিশের সাথে ছাত্রদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া। অবস্থা বেগতিক দেখে আমি একটি বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। সন্ধ্যার দিকে পুলিশ-এর গুলির আওয়াজ আরো বাড়তে লাগলো। অবস্থা বেগতিক দেখে আমি একটা বাড়ির ভিতর আশ্রয় নিলাম। আমার আদাবর যাওয়ার কথা, কিন্তু মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ড-এর প্রধান সড়ক পার না হয়ে সেটা কোনোক্রমেই সম্ভব না। কিন্তু প্রধান সড়কেতো রীতিমতো যুদ্ধাবস্থা। থামারও কোনো লক্ষণ দেখছি না।

আবার হেলিকপ্টারের আওয়াজও শুনলাম, হেলিকপ্টার দিয়েও কিছু একটা করছে বলে মনে হলো। পরে শুনলাম হেলিকপ্টার থেকে নাকি কাঁদানে গ্যাস, গরম পানি নিক্ষেপ করছে, মাঝেমধ্যে গুলিও করছে। আমি একাত্তর দেখিনি দু’হাজার চব্বিশ দেখলাম।

আমি অবাক হলাম। ছাত্রদের উপর গুলি করতে হবে কেন? এ প্রশ্নতো সবার। মানুষের জীবনের মূল্য কী এতই কম। বাইরের এসব তাণ্ডবে সেদিন রাতে আমি আর বাসায় ফিরতে পারিনি। একটু দূরে একটি বাড়ি থেকে কিছু লোকের কান্নার আওয়াজ ভেসে আসছে। কান্না বললে ভুল হবে, বিলাপই বলা যায়। আমি ভয়ে ভয়ে সে বাড়িটিতে ঢুকলাম। অপরিচিত লোক দেখে ভয়ার্ত কণ্ঠে বাড়ির একজন বললো, ‘কে আপনি?’ আমার পরিচয় পেয়ে তাঁরা ভয়মুক্ত হলো। বুঝলো শত্রুপক্ষের কেউ না। বাড়ির ভিতরে এক মহিলা নানারকম কথা বলে বিলাপ করছে। বাড়ির ছেলেটি বললো, ‘ওনার একমাত্র ছেলেটি আজ সকালে পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়েছে। নবম শ্রেণীতে পড়তো। খুব ট্যালেন্ট ছাত্র ছিল। ওনিই তাঁর মা। মায়ের কান্না কিছুতেই থামছে না।’ মা তো মা-ই। আমার চোখের পানিও আর ধরে রাখতে পারলাম না। সারা দেশে এরকম আরো কতো মা-বাবার বুক খালি করে আদরের সন্তানরা লাশ হয়ে ঘরে ফিরছে। বাবার কাঁধে সন্তানের লাশ। এ যে কতো ভারী তা যে বাবা সন্তান হারিয়েছে শুধুমাত্র সেই বুঝতে পেরেছে। কী অপরাধ ছিল এ সন্তানদের ? অনেকেতো আন্দোলনেও যায় নি। নিরপরাধ ছাত্র-ছাত্রী, শিশু, সাধারণ পথচারিরাও মৃত্যুর হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না। হঠাৎ বিদ্যুৎ চলে গেল। ঘুটঘুটে অন্ধকার। ভয়ার্ত কালো রাত। রাত এগারোটা বাজে। মোহাম্মদপুর বাসস্ট্যান্ডে আবারও গুলির শব্দ শুনতে পেলাম। অজানা আশংকায় বুকটা কেঁপে উঠলো। আবারও কী লাশ পড়লো ? সেই মা আবার বিলাপ করে বলতে লাগলো, ‘আমার বাবা কইরে, বাবা কইরে!’ কতক্ষণ অন্ধকারে ছিলাম জানি না। কখন যেন বিদ্যুৎ এসে চারদিক আবার আলোকিত হলো। কালকেও ভোরে সূর্য উঠবে, বাংলার চারদিক আলোকিত হবে। কিন্তু সত্যিকারের আলো, স্বাধীনতার আলো বাংলার আকাশে-বাতাসে, প্রতিটি ঘরে পৌঁছবেতো? আহাজারি করা মায়ের বুকটা শান্ত হবে তো? অন্য সবার মতো আমার মনেও এ প্রশ্ন ঘুরপাক খেতে লাগল।