হাসান আলীম
কবি মুকুল চৌধুরী জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে বিএসএস অনার্স শেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এমএসএস এ ভর্তি হলেন। কবি ও গীতিকার মতিউর রহমান মল্লিক এবং কবি আসাদ বিন হাফিজের নিকট শুনলাম আরও একজন কবি মহসিন হলে এটাস্টড হয়েছে। তার সাথে আমার পরিচয় হওয়া দরকার। আমি তখন মতিউর রহমান মল্লিক এবং আসাদের খুব ঘনিষ্ঠ। ঢাবির বিপরীত উচ্চারণ এর সর্বশেষ পরিচালক। প্রবাহ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। রসায়নের ক্লাস শেষ হলে কবিতার জন্য টিএসসি, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান এবং ঢাবির বিভিন্ন হলে সাহিত্য সভা করি। কবিতা পাঠ করি, কোথাও কোথাও সাহিত্য আলোচনা করি। আস্তে আস্তে মুকুলের সাথে কবিতার কারণে বন্ধুত্ব হয়ে যায়, তদুপরি তার চমৎকার হাতের লেখা এবং সাহিত্য সমালোচনা আমাকে আকর্ষণ করে। মুকুল কবিতার চেয়ে প্রথম দিকে প্রবন্ধ লিখতো বেশি। সে ছিলো ষাটের দশকের প্রখ্যাত কবি অধ্যাপক আফজাল চৌধুরীর ভাবশিষ্য। সিলেটি কবিদের অনেকেই তার শিষ্য ছিলেন। এই দলে আরও ছিলেন কবি সোলায়মান আহসান, কবি তমিজ উদ্দিন লোদী, কবি নিজামুদ্দিন সালেহসহ আরও অনেকে। মুকুলের সাথে আমার সখ্য বেড়ে যায় তার কর্মজীবনে। সে ছিলো ইসলামি ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তা। অগ্রপথিক পত্রিকাসহ আরও কয়েকটি সাহিত্য ও গবেষণা পত্রিকার সাথে তার নিবিড় সংযুক্তি ছিলো। মুকুল চৌধুরী খুব বেশি না লিখলেও তার কবিতা, ও প্রবন্ধ ছিলো খুবই স্মার্ট এবং ম্যাচিউরড। এ পর্যন্ত তার ২৯ টি গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। এর মধ্যে ৯ টি কাব্য গ্রন্থ, ৬ টি গবেষণা গ্রন্থ, ৫ টি শিশুসাহিত্য, বাকি গুলো সম্পাদনা গ্রন্থ। তার উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ১. অস্পষ্ট বন্দর (১৯৯১), ২. ফেলে আসা সুগন্ধি রুমাল (১৯৯৪), ৩. চা বারান্দার মুখ (১৯৯৭), ৪. সোয়াশ’ কোটি কবর (২০০৩), ৪. নির্বাচিত প্রেমের কবিতা (২০১০), ৫. অপার্থিব সফরনামা (২০১১), ৫. মাটির ময়না (২০১৫)
প্রবন্ধ ও গবেষণা গ্রন্থের মধ্যে -১. কবি ও কবিতার প্রতি রসূল (সা.) এর অনুরাগ ও উৎসাহ (২০০৩), ২. পথিকৃৎ দশ মনীষী (২০০৪), ৩. বাংলাদেশের স্বতন্ত্র সাহিত্য ও অন্যান্য প্রবন্ধ (২০০৬), ৪. আফজাল চৌধুরী : কবি ও কবিতা (২০০৮), ৫. শাহেদ আলী : জীবন ও সাহিত্য (২০১৬), সম্পাদিত গ্রন্থের মধ্যে ১. রাসূলের শানে কবিতা (যৌথ) প্রকাশ ১৯৯৬, ২. অগ্রপথিক : ভাষা আন্দোলন (১৯৯৩), ৩. সাহিত্য সংস্কৃতি ও মহানবী (২০০৫), ৪. মহানবী(সা.) কে নিবেদিত কবিতা, ৫. আমাদের মিলিত সংগ্রাম মওলানা ভাসানীর নাম (যৌথ), (১৯৮৬) এ ছাড়াও তার একাধিক শিশু সাহিত্য রয়েছে। ২. মুকুল চৌধুরী একজন আদর্শবাদী এবং ঐতিহ্যবাদী মৌলিক কবি। তিনি বেশ ছন্দ সচেতন কবি কিন্তু গদ্য ফর্মের কবিতা লিখতে তিনি বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন। তার গদ্য কবিতার পঙক্তিগুলো রেলগাড়ির বগির মতো বেশ লম্বা কিন্তু গতিশীল এবং চিত্রল ছিলো সে সব কাব্যিক অভিব্যক্তি। তিনি রসূল প্রেমিক কবি, আপাদমস্তক নবীপ্রেমিক শায়েরে-নবী। এ মুহূর্তে তার চমকপ্রদ কিছু পঙক্তি মনে পড়ছে - ‘আশা ও নিরাশার মধ্যে মুহূর্তের জন্য শোনা গেল কোমল -কাতর এক/ কন্ঠের ধ্বনি ‘খাদিজা তোমাকে নিয়ে যাওয়ার জন্য ফেরেশতা এসেছেন!’ সাহাবিদের শিরায় শিরায় নিঃশব্দে লাফিয়ে পড়লো বিষন্নতার ঢেউ/অন্ধকারের মধ্যেও তাঁরা একে অন্যকে দেখলেন, শিহরিত হলেন এবং /বিনম্র কোরাস তুললেন —- ‘এই কণ্ঠস্বর আল্লাহর নবীর!’ চোখে মুখে ঐশী কিরণে বিকীর্ণ হয়ে তালহা কোরাসের ধ্বনিকে / প্রলম্বিত করলেন— ‘খাদিজাতুল কুবরা কত সৌভাগ্যবতী!’ (শোকের কাসিদা/সোয়া শ’ কোটি কবর) কিংবা, কে যেন ডেকে ওঠে। ডেকে ওঠে ভোরের রোদের মতো, /ঘুম ভাঙানিয়া স্বরে। বার বার ডেকে ওঠে কখনও বা পাতা পতনের শব্দে। ডুবন্ত মানুষের কাতর ধ্বনির সাথে অবিকল মিল এমন স্বরেও ডাকে। মেয়েরা কলতলায় গেলে যেমন শব্দ হয়- - কলকল ঝনঝন/একি তেমন কোন স্বর? নাকি শব্দটি মানুষের/জিহ্বায় নড়ে ওঠে, নাকি পতঙ্গের ডানায়, নাকি কোন রাতজাগা পাখির বিষন্ন ঠোঁটের? (ঘুম ডাক/চা বারান্দার মুখ) এমন অনেক হৃদয় স্পর্শ করা চিত্র কল্পময় পঙক্তি রয়েছে মুকুলের প্রায় কবিতার স্তবকে। মুকুল চৌধুরী কেবল আশির দশকের নয় বরং তার সময়কে অতিক্রম করে আকাশ স্পর্শী এক মৌলিক শক্তিমন্ত কবি।