গাজী গিয়াস উদ্দিন
১৯৯১ সালে শিল্পকলা একাডেমিতে কবি আল মাহমুদ গবেষণা ও প্রকাশনা পরিচালক। আমার উপন্যাস ‘বনস্পতি’র ভূমিকা লিখে দেওয়ার বায়না নিয়ে কবির সে অফিসে যাওয়া। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে চূড়ান্ত পরীক্ষা দেব। চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা আসি। কবি কিছু পরামর্শসহ পান্ডুলিপি ফেরত দিলেন। মনে পড়ে, লিখেছিলেন - ‘তোমার লেখার কিছু কথা বাদ দিতে হবে। কিছু কথা যোগ করতে হবে’।
পরে ১৯৯৩ সালে ১৮ মার্চ আমি কবি আল মাহমুদ, কবি আবিদ আজাদ, কবি নাসরীন নঈম ও নাট্যশিল্পী দিলারা জামান-কে দাওয়াত করে নিয়ে আসি লক্ষ্মীপুরে। তখন রমজান মাস। উপলক্ষ হচ্ছে আমার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস ‘শেষ নিবেদন’ এর উদ্বোধন। আল মাহমুদ সহ সবাই আমার ভাড়া বাসায় আসলেন। আমার স্ত্রী তখন অন্তঃসত্ত্বা। আল মাহমুদ আমার মিসেস কে দেখেই বল্লেন- তুমি নাকি মা এ পাগলের ঘর কর। যাক আরো কতো মিশ্র অভিজ্ঞতা কবির সে সফরকে কেন্দ্র করে।
এর কদিন পর ল্যান্ড ফোনে কবি নাসরীন নঈম এর সাথে কথা হলো। তিনি জানালেন, আমাকে নিয়ে নাকি তিনি একটা গল্পই লিখে ফেলেছেন। বিষয়টি খুব সম্ভব দিলারা জামানের মারফত জেনেছেন। এদ্দূর বলতে চাইছিলাম না। যাক বলি। তা হচ্ছে ঢাকায় আল মাহমুদ সহ তার সফরসঙ্গীরা সবাই হাতিরপুলে আবিদ আজাদের শিল্পতরু প্রকাশনী অফিসে আমার জন্যে অপেক্ষা করছেন। কথা ছিল ঢাকা থেকে কবিদল আমার সাথে একটা ভালো মানের বাসে লক্ষ্মীপুর যাবেন। হঠাৎ ফখরুজ্জামান চৌধুরী (বিটিভি পরিচালক প্রশাসন এবং অনুবাদক) যাবেন না বলে তিনি তার স্ত্রী দিলারা জামান এর জার্নির সুবিধার্থে শর্ত জুড়লেন মাইক্রো ভাড়া করতে হবে। আমি পাশে রেন্ট সার্ভিস থেকে একটি মাইক্রো নিয়ে আসি। পথে কুমিল্লা মিয়ামিতে গাড়ি থামানো হলো ইফতার কেনার জন্য। আমার পকেটে তেমন টাকা পয়সা নেই। তবু যদ্দুর সম্ভব কিনলাম। লাকসামে খুবই সুন্দর একটা সবুজ ঘাস আচ্ছাদিত বড় মাঠে সবাই গোল হয়ে বসে আমরা ইফতার উপভোগ করি। রাতে লক্ষ্মীপুর পৌঁছে কবিদের সার্কিট হাউসে থাকার ব্যবস্থা করি। আমার বড়ভাই সিরাজুল ইসলাম তখন স্বাস্থ্য উপমন্ত্রীর পি এস। আমি জনকণ্ঠে (সদ্য প্রকাশিত) নিউজ করি।
পরদিন মাইকিং হলো আল মাহমুদ লক্ষ্মীপুর এসেছেন। সরকারি সামাদ হাই স্কুল হলরুমে মিটিং। হেডমাস্টার শাহ আলম সাহেব হন্তদন্ত। পৌরসভা চেয়ারম্যান মিন্টু ভাই, চৌধুরী খুরশিদ আলম, খলিল স্যার সহ গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ ছুটে আসলেন। তাতে আমার কিছুটা মান বাঁচলো। ডিসি সি আর বড়ুয়া সভাপতিত্ব করলেন। মনে পড়ে,কবি আল মাহমুদ সে সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে বলেছিলেন, কবির কাজ হচ্ছে একটি জাতির মনে স্বপ্ন ধরিয়ে দেওয়া...।
শিল্পতরু প্রকাশনী বই স্টল দিয়ে ভালোই পুশিং সেল করলেন। আমার মাথায় হাত। কেউ জানেন না আমার বিপদ। আমি মাইক্রো ভাড়া ১৯৯৩ সালে ১২০০ টাকা কিভাবে শোধ করবো। শেষ পর্যন্ত আমার স্ত্রীর অলংকার কুন্ডদের কাছে বন্ধক রেখে ভাড়ার টাকা দিয়ে সম্মানিত অতিথি কবিদের বিদায় করি। দিলারা জামান তার খালাতো ভাই অ্যাডভোকেট সিরাজুল হকের মাধ্যমে এসব ঘটনা শোনেন। তাই নাসরীন নঈমের আমাকে নিয়ে গল্প লেখা।
এর কিছুদিন পর ঢাকা গেলাম। দৈনিক সংগ্রামে তখন আল মাহমুদ সম্পাদকীয় বিভাগে। রাতে কবি লেখা শেষ করে আমাকে নিয়ে হেঁটে মগবাজার রুটি হাউজে গেলেন। দুজনে খেলাম। কবিকে আমার সদ্য লেখা একটা কবিতা দেখালাম। তিনি একটি শব্দ নিজ হাতে লিখে ঠিক করে দিলেন।
তারও আগে দৈনিক রূপালীতে ‘ঘৃণার পালঙ্ক’ নামে একটি কবিতা পড়ে কবিকে নিয়ে একটি কবিতা লিখলাম। আমার প্রথম প্রকাশিত কাব্য ‘হরিৎ পান্ডুলিপি’ তে কবিতাটি স্থান পেয়েছে। কবিতাটি পড়ে কবি বল্লেন- ‘ তুমি এটা ছাপতে পার।
আমার এ কাব্যের ভূমিকা কবির লিখে দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু বাউন্ডুলে মার্কা ছিলাম তখন। আত্মউদাসীন। কবির কাছে যাওয়া হয়নি। প্রকাশিত হবার পর সংগ্রামে গিয়ে কাব্যগ্রন্থটি কবিকে দিলাম। তিনি আমাকে বল্লেন, তোমার কবিতার বই বেরিয়েছে,তুমিতো কবি হয়েই গেছ।
কবি আল মাহমুদের মতো মহান কবি বাংলা সাহিত্যে হাতে গোনা। মানুষ হিসেবে তাঁর সততা এবং কবি নাম পদবাচ্য যে কাউকে সহজে গ্রহণ করতে পারা এবং সাধ্যমত সময় দেওয়া এরকম বহু দুর্লভ গুণ ছিল তাঁর সহজাত। সমালোচনা সহ্য করার অপরিসীম ধৈর্য তাঁর ভূষণ যেন। কবিকে আমন্ত্রণ জানাতে গেলে তিনি তখন তাঁর মধুবাগের বাসায় রাতের বেলা আমাকে নিয়ে গেলেন। তাঁর বাসার প্রবেশ মুখে দেয়ালে সাঁটানো কবির কিছু কবিতার হাইলাইটস পড়ে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। মনে হয়েছিল রবীন্দ্রনাথের জনপ্রিয় কোন পঙক্তি পড়ছি। তিনি এশার নামাজ পড়ে আমাকে নিয়ে ফ্লোরে চাটাই বিছিয়ে রাতের খাবার খেলেন। ভাত, চিংড়ি, গরুর গোশত এবং ডাল। এক পর্যায়ে আমি উনাকে বল্লাম - আমার জীবনটাতো বাউন্ডেলে। তিনি বল্লেন, কেন তুমি বিয়ে করনি? আমি অন্য একটা কষ্টের কথা বল্লাম।
তিনি আমাকে সান্ত¡না দিয়ে বল্লেন, ওসব তো মানুষের জীবনে থাকে।
মনে পড়ে, এসবের অনেক বছর পর সাল মনে করতে পারছি না। কবি শাহীন রেজার সাথে কবির গুলশানের বাসায় গেলাম। তিনি দীর্ঘ সময় ধরে গুরুত্বপূর্ণ অনেক বিষয়ে আলাপচারিতায় মগ্ন হয়ে পড়েছেন। মনে আছে, কবি নিজের সম্পর্কে বল্লেন, দেখ- আমার জীবনে শৈশবের যে ধর্মীয় শিক্ষা, সেটা ছিল বলে আমি স্বধর্মে ফিরে আসতে পেরেছি। বল্লেন কবিকে জাতির অতীত ইতিহাস ঐতিহ্য জানতে হবে। জসীমউদ্দিন আমাদের মৌলিক কবি। তাঁর সাহিত্য জানার এবং অনুসরণের গুরুত্বের কথা বল্লেন।
কবিকে নিয়ে আমার লেখা কবিতাটি ছিল-
আল মাহমুদকে
(কবির ঘৃণার পালঙ্কে কবিতার প্রেক্ষিতে)
গাজী গিয়াস উদ্দিন
এ কোন ভাগ্যলক্ষ্মী কবি
ঘৃণার পালঙ্কে সওয়ার
বোরাকে ধুলি খেলে মুক্ত সাহারার,
তবু নিতে গেলে নিজগুণে ঘৃণার উপহার।
আল মাহমুদ যখন সৌর ভ্রমণে
তখনো ভাগ্যহতরা ভ্রমের আঁচলে,
ঈর্ষায় মাতম তোলে
তবু যায় ধ্বজার জিগির বিফলে।
হে কবি সাধক
আত্মবিশ্বাসী - বখতিয়ারের ঘোড়া,
আগাছা ক্ষেতে সোনার ফসলে
শিল্প দিগন্ত জোড়া।
গ্লানির পরশ পাথর হবে কালের ঐতিহ্যে
গৌরব গাথা।
২৮/ ৭/৯১
আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতার ভ্রমর। যাঁর ভেতরে কবিতাভ্রমর বাস করতো। যিনি বলার স্পর্ধা রাখেন, আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়কে ভালো কবি মনে করি না। তিরিশের কবিদের অবজ্ঞা করার দুঃসাহস রাখেন। যাকে একসময় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকরা পাত্তা দিতে চায়নি। যাদের তিনি পরবর্তীতে পাত্তা দেননি। কোলকাতা থেকে কবি জয় গোস্বামী যে কবির বাসায় গিয়ে পা ছুঁয়ে সালাম করেছিলেন।
আমি অকুন্ঠ প্রশংসা মথিত ধন্যবাদ জানাবো আমার প্রিয় শিক্ষক কবি ময়ূখ চৌধুরীকে। তার প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে কবি আল মাহমুদকে প্রথম পাঠ্যভুক্ত করা হয়। শ্রদ্ধেয় ময়ূখ চৌধুরী এ বিষয়ে ক্লাসে আমাদের বলতেন।
আল মাহমুদ বাংলা কবিতার যথার্থ আধুনিক অসাধারণ কবি। যার সাহিত্য চিরায়ত চির দেদীপ্যমান। মহৎ সাহিত্যের উঁচু স্তরে উন্নীত ও সমাদৃত। তিনি বিশ্ববরেণ্য কবি আল মাহমুদ। তার কবিতা ও সাহিত্যের যথাযথ গবেষণা ও অনুবাদ হলে তিনি বিশ্বের অন্যতম কবির আসনে চলে যেতে পারেন।
কবি রূমী যেভাবে পাশ্চাত্যে গৃহীত হয়েছেন। যেসব কাব্য প্রসাদ গুণে, আল মাহমুদের কবিতায়ও তা নিহিত। মানব চিত্ত হরণকারী রহস্য বাণীগুলো তিনি গেঁথে দিয়েছেন কবিতার ভেতর।