বলা হয়ে থাকে প্রতিবাদের ভাষা হচ্ছে খরস্রোতা নদীর মতো। আটকানো যায় না। মুখের ভাষা যখন কেড়ে নেওয়া হয়; তখন তা বিকল্প এবং এর চেয়ে তেঁজালো হয়ে শিল্পের মাধ্যমেই প্রকাশ পাবে। সেই শিল্পটা বৈচিত্রের এবং ভিন্ন আঙ্গিকে হবে এটাই স্বাভাবিক। মানুষ যখন মুখে প্রতিবাদ করতে পারে না তখন বিকল্প পথ সৃষ্টি হয়। গ্রাফিতি বা দেওয়াল লিখন, তেমনি একটা বিকল্প। বহুকাল আগে থেকেই দেয়াল লিখন বা গ্রাফিতি সংস্কৃতির অংশ হয়েছে। তবে তা আলোচনায় আসেনি। ২৪’র ছাত্র-জনতার অভ্যূত্থানের আন্দোলনে আমাদের বাংলা সংস্কৃতির ও ইতিহাসের অংশ হয়ে ওঠে আলোচনায় আসে গ্রাফিতি।

বাংলাদেশের আঠার কোটি মানুষের কন্ঠরোধ করে স্বৈর সরকার যখন মানুষের মুখের ভাষার প্রতিবাদ বন্ধ করে দেয় তখন বিকল্প হিসেবে সামনে আসে গ্রাফিতি। প্রথমে অনলাইনে পরবর্তীতে দেওয়ালের ভাষায় রূপ নেয় গ্রাফিতি। গ্রাফিতির বিপ্লবী এবং দ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে। দাউ দাউ করা স্লোগানের লেলিহান শিখা এবং প্রতিবাদী শব্দ এবং বাক্যচয়ন আধুনিক মারণাস্ত্র¿কে ব্যর্থ করে দেয়।

‘বুকের ভেতর তুমুল ঝড়, বুক পেতেছি গুলি কর’ কিংবা” আমার বিচার তুমি কর, তোমার বিচার করবে কে? কবে তোমার দখল থেকে, মুক্তি আমায় দেবে? ‘শোন মহাজন, আমি নয়ত একজন’ শোন মহাজন, আমরা অনেকজন।

অভিজ্ঞজনেরা বলেন, কিছু ভাষা আছে মুখের। আবার কিছ ুভাষা আছে বুকের ভেতরের। কিছু ভাষা আছে চোখের আর মনের। আর কিছু ভাষা আছে মুখেরও না চোখেরও না, মনেরও না, দেওয়ালের। এই ভাষাগুলোর স্থান কাল সময় এবং পাত্র ভেদে অদল-বদল হয়। প্রয়োজনে পরিবর্তন এবং স্থান বদল করে। কখনো দেওয়ালের ভাষা মনের মধ্যে দাগ কাটে। এমন দাগ কাটে যে, বন্দুকের নল ব্যর্থ হয়ে যায়। আবার কখনো মনের ভাষা দেওয়ালে শোভিত হয় নিরব সাক্ষী হয়ে। ক্ষণে ক্ষণে মানুষের চোখকে মনে করিয়ে দেওয়া কি হচ্ছে, কি হবে. কি করা উচিত।

বিশেষ করে মনের ভাষা যখন বাধাগ্রস্ত হয়, মুখে ফুটে বলতে মানা! তখন তাই দেওয়ালে শোভা পায় এবং তখন তা হয়ে ওঠে গ্রাফিতি। গ্রাফিতি হয়ে দাঁড়ায় প্রতিবাদের ভাষা। এই গ্রাফিতি স্বৈরশাসক হাসিনার জন্য কতটা বিধ্বংসী ছিল তা সরকার-ই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মানুষ যখন কোনভাবেই অত্যাচারির মসনদ নড়বড়ে করতে পারছিল না, তখন নাকের কাছে সদ্য গোঁফ উঁকি দেওয়া বাচ্চাদের হাতের দেওয়াল গ্রাফিতির তাপ দম্ভভরা গদি জ¦ালিয়ে ছাই করে দেয়। মানুষকে আগ্নেয়গিরির লাভার মতো উজ্জীবিত করে তোলে এসব গ্রাফিতি। বন্দুকের গুলির মুখে বুক পেতে দেওয়ার হিম্মত জোগান দেয়।

অভ্যুত্থানের সময় রাজধানীসহ দেশের নানা শহরের দেয়ালে ফুটে উঠে ‘গ্রাফিতি’ নামের এক শৈল্পিক প্রতিবাদ অপ্রতিরোধ্য প্রতিবাদ। তরুণ প্রজন্মের শিক্ষার্থীদের কাঁচা হাতের আঁকা ও হৃদয়ের গভীর অভিব্যক্তিময় সেই দেয়ালচিত্রে উঠে আসে সংহতির আহ্বান। ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে মহা ধিক্কার।

‘পানি লাগবে পানি’, ‘গর্জে উঠেছিলাম বলেই বাংলাদেশে’, ‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাইকে ফেরত দে’, ‘বিকল্প কে? আমি, তুমি আমরা’, ‘ছিনিয়ে এনেছি বিজয় শিখিনি পরাজয়’, ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা ৩৬শে জুলাই’, ‘শোন ধর্ম আর দেশকে মিলাইতে যেও না, ফুলের নাম কি দিবা ফাতেমা চূড়া’, ‘রক্তাক্ত জুলাই’, ‘আপনি প্লিজ উত্তেজিত হবেন না’, ‘আমরা গড়ব আমাদের দেশ’, ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো জুলাই’, ‘নাটক কম করো পিও’ ইত্যাদি স্লোগানের গ্রাফিতিতে ছেয়ে যায় বাংলাদেশ।

কেবল বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও ভবনের দেয়াল নয়, সীমানাপ্রাচীর, সড়কদ্বীপ, মেট্রোরেল ও ফ্লাইওভারের পিলারসহ সবখানে গ্রাফিতি। এসব গ্রাফিতিতে ছিল দুই হাত প্রসারিত করে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা সাহসিকতার প্রতীক আবু সাঈদের প্রতিকৃতি। আবু সাঈদের যে কত প্রতিকৃতি আঁকা হয়েছে এর যেন শেষ নেই। আছে মুগ্ধের প্রতিকৃতি। মুগ্ধের পানির বোতলের গ্রাফিতিও আছে। বাংলাদেশের দেয়াল যেন আজ রক্তাক্ত জুলাই। আরো আছে দারুণ সব গান ও কবিতার পঙ্ক্তিমালার গ্রাফিতি। ‘বল বীর বল উন্নত মম শির! শির নেহারি আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির...’!

‘...আঁধারে ভয় পেয়ো না আলো আছে আড়ালে/ আঁধার কেটে যাবে তুমি উঠে দাঁড়ালে...’। ‘...সব মানুষের স্বপ্ন তোমার, চোখের তারায় সত্যি হোক/ আমার কাছে দেশ মানে, এক লোকের পাশে অন্য লোক...’। এমন আরো অনেক কালজয়ী গান-পঙ্ক্তি। ছাত্রদের বীরত্বগাথা এই প্রথম নয়, ১৯৫২/ ’৬৯/ ’৭১ এমনকি ১৯৯০ সালেও তারা প্রমাণ করেছে কীভাবে অত্যাচারীর বিরুদ্ধে জয়ী হতে হয়।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সিনিয়র শিক্ষার্থীরা যা বোঝাতে চেয়েছেন তা হলো জুলাই আন্দোলনে দেওয়ালে দেওয়ালে যা আঁকা হয়েছে; তাকে ঠিক গ্রাফিতি বলে ডাকছি আমরা। তবে এসব ঠিক গ্রাফিতি হয়ে ওঠেনি। তবে তাতো মানুষের মনে আঘাত করতে সক্ষম হয়েছে। মানুষকে প্রতিবাদী করে তুলেছে। জনমত গঠনে সহায়তা করেছে। মানুষকে রাস্তায় নামাতে ভূমিকা পালন করেছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউটের ১৫-১৬ বর্ষের শিক্ষার্থী তানভীর আহমেদ। তার সাথে আলাপ করে যা বোঝা গেল তা হলো জুলাই আন্দোলনে আমাদের শুরুটা দেওয়ালে দেওয়ালে। দেওয়ালে স্প্রে মেরে। তারও আগে অনলাইনে। তখন আসলে গ্রাফিতি করার মতো লম্বা সময়ও ছিল না। দেওয়ালে লেখন দিয়ে শুরু হয়; যাকে লোকাল ভাষায় বলা হয় চিকা মারা। আমরা লিখছি এসব কি হচ্ছে ? এক দফা এক দাবি। আমাদের স্টুডেন্ট ছিল। চারুকলার কিছু আর্স্টিস্ট ছিল। এর বাইরে বন্ধু ও সিনিয়র ছিল। এর বাইরে স্থানীয় কিছু ইয়ুথ, যারা এইট নাইনে বা নাইন টেনে পড়ে। একদম তরুণ ১৬-১৭ বছর, দেখলেই বোঝা যায় নতুন গোফ গজাচ্ছে। এরা যেন কোথা থেকে আমাদের সাথে আসছে। তখন স্প্রে করার জন্য নিজের কাছে আর কয়টা থাকে। যার কাছে যা ছিল, সবাই সব নিয়ে নামলো। একজন এলো, তিনি রিকশাওয়ালা ছিল। তিনি বললেন আপনাদের রংতো শেষ হয়ে যাচ্ছে আপনারা আলকাতরা দিয়ে লিখেন। দেওয়ালে লিখলে সহজে উঠবে না। প্রশাসন আমাদের লিখনগুলো মুছে দেওয়ার চেষ্টা করছিল। তখন আমরা আলকাতরা দিয়ে লেখা শুরু করলাম। হাসিনার পদত্যাগ চাই। একদফা এক দাবি ইত্যাদি। এমনও সময় দেখা গেছে আমরা লিখছি আর অনেক দূর থেকে এপিসি দেখা যাচ্ছে। তিন চারটা বাচ্চা সব সময় পাহারা দিতো। যে কোন দিক থেকে এপিসি আসে। কাছাকাছি এলেই ভেতরের গলিতে চলে যাচ্ছিলাম। আবার যখনই এপিসি চলে গেলো আমরা মেইন রোডে এসে লেখা শুরু করতাম। আর কখনো টিয়ার সেল খাচ্ছি ধোঁয়া চোখ জ¦লছে এরকম সিচ্যুয়েশনও গেছে।

দেয়ালগুলোর অসংখ্য গ্রাফিতিতে মোড়ানো হয়ে যায় একসময়। সেগুলোর ভাষা ছিল মানুষের অন্তরে আঘাত করার মতো কবিতার পঙক্তিমালা। যেমন: ‘সোনার বাংলা আজ মৃত্যুপুরী কেন ? ‘আমার ভাইদের মারলি কেন?’, ‘সেভ দ্য কান্ট্রি জয়েন দ্য ফাইট’, ‘পুলিশি হত্যার বিচার চাই’, ‘একদিকে নাটক করে অন্যদিকে গুম করে’, ‘৫২ দেখিনি ২৪ দেখেছি’, ‘সম্পদের হিসাব পরে লাশের হিসাব আগে’, ‘হামার বেটাক মারলু ক্যান’ ইত্যাদি লেখা হয়। গ্রাফিতিতে স্থান পেয়েছে ছাদে গিয়ে গুলিতে নিহত ছোট্ট রিয়ার কথাও। শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) শিক্ষার্থীরা আবু সাঈদের হাত উঁচিয়ে গুলির সামনে বুক পেতে দেওয়ার গ্রাফিতি আঁকেন।

ছাত্র-জনতার বিক্ষোভে স্বৈরশাসকের পতনের পর ঢাকার ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, অফিস, ভবনের দেয়ালে দেয়ালে, মেট্রোরেলের স্তম্ভে আঁকা হয়েছিল এমন অসংখ্য গ্রাফিতি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার দেয়ালে লেখা ছিল, ‘ঘুষ চাইলে ঘুষি’। আবার কোথাও লেখা, ‘রাষ্ট্র সংস্কারের কাজ চলছে’, গাছের পাতায় পাতায় বিভিন্ন ধর্ম সম্প্রদায়ের নাম, নিচে লেখা ‘পাতা ছেঁড়া নিষেধ’। এসব গ্রাফিতিতে আবু সাঈদ, মুগ্ধ, প্রিয়, ফায়াজ, তামিমদের মুখ পরিণত হয়েছিল নতুন বাংলাদেশের প্রতীক।

কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা ও গান গণ-অভ্যুত্থানের অগ্নিঝরা দিনগুলোতে ছিল প্রেরণার অন্যতম উৎস। তাঁর ‘কারার ঐ লৌহকপাট’ ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোড দিয়ে যাতায়াতের সময় এখনো নাগরিকদের চোখে পড়বে দেয়ালের লিখন ‘দেশের কোনো ধর্ম নেই/ দেশের কোনো বর্ণ নেই/দেশ আমার, দেশ তোমার।’ গত বছর লাল রঙে লেখা এই বার্তা হয়ে উঠেছিল গণঅভ্যুত্থানের মর্মবাণী। মোহাম্মদপুরে কেউ লিখেছিলেন ‘আমার দেশের ছাত্রছাত্রী পারমাণবিক বোমার চেয়ে শক্তিশালী’, এমন এক সাহসী সত্য।

তানভীরের বক্তব্য হলো জুলাই গ্রাফিতির শুরু অনলাইনে দেওয়ালে না। অনেকের গ্রাফিতি ভাইরাল হয়েছে। এসব গ্রাফিতি আন্দোলনে সহায়তা করেছে। যখন ছাত্রদের ওপর অ্যাটাক হয়। তখন থেকেই অনলাইনে কার্টুনগুলো ভাইরাল হওয়া শুরু করে। যার অবস্থান থেকে শত শত হাজার হাজার কার্টুন অনলাইনে আসা শুরু করে। ইন্টারনেট অফ করার আগ পর্যন্ত তারা ফাইট করেছে। যখন লাশের ভিডিও সামনে এলো তখন কার্টুন তৈরি করে যে যার মতো পোস্ট করেছে। এরপর আর কোনজনের কাছে সীমাবদ্ধ থাকলো না। যে যার জায়গা থেকে কাটুর্ন তৈরি করলো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার শুরু করলো। যখন নয় দফা ঘোষণা করা হয় তখন আমরা বুঝতে পারছিলাম যে কর্মসূচি এক দফায় যাবে। কারণ শেখ হাসিনার মতো দানব যে হত্যাকান্ডের জন্য ক্ষমা চাইবে না। এবং তার পতন হবেই হবে।