ড. এম এ সবুর

ঈদ মুসলমানদের সাম্যের প্রতীক, ভাতৃত্বের মাইলফলক; ধনী-গরিবের মেলবন্ধন ও মুসলিম জাতির মহাসম্মিলন। শ্রেণি-পেশার কোন বৈষম্য-ভেদাভেদ নাই এ মহাসম্মিলনে। রাজা-প্রজা, মালিক-শ্রমিক, ধনী-গরিব সকল মুসলমান সমবেত হন ঈদের ময়দানে। এক কাতারে সারিবদ্ধ হয়ে মহান আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন অবনত মস্তকে। সমবেতভাবে আল্লাহ তায়ালার নিকট আত্মসমর্পণ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ পায় ঈদের আনন্দ উৎসবে। হাতে হাত, বুকে বুক রেখে পরস্পর কোলাকুলি করেন পরম মমতা নিয়ে। পুরনো দিনের হিংসা-বিদ্বেষ ভুলে তারা পরস্পরে আবদ্ধ হন ভালোবাসার বন্ধনে। সাম্য, সৌহার্দ ও ভ্রাতৃত্ববোধ সুসংহত হয় ঈদের পবিত্র উৎসবে। সমাজ, দেশ, জাতি পেরিয়ে সমগ্র মুসলিম বিশ্ব এক সাথে ঈদের আনন্দ উপভোগ করে। তবে ফিলিস্তিনের গাজায় ইসরাইলী বাহিনীর বর্বরোচিত হত্যাকান্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ মুসলিম বিশ্বের ঈদ আনন্দকে বেদনাবিধুর করেছে। আর আমাদের দেশে জুলাই বিপ্লবের শহীদ ও আহতদের পরিবারগুলোতে ঈদের উৎসবেও শোক বিরাজমান আছে।

ঈদ উৎসবের সূচনা হয় হিজরি দ্বিতীয় সন অর্থাৎ মহানবি হজরত মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর মক্কা থেকে মদিনায় হিজরতের দ্বিতীয় বছর থেকে। জাহেলিয়া যুগে আরবের মক্কায় ‘উকাজ মেলা’ এবং মদিনায় ‘নীরোজ’ ও ‘মিহিরগান’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হতো। আর সে সব অনুষ্ঠানে অশ্লীল আনন্দ-উল্লাস করা হতো। মদিনায় আগমনের পর মহানবী সা. মুসলমানদের জন্য অশ্লীলতামুক্ত বিনোদন-আনন্দ-উৎসবের প্রয়োজন মনে করলেন। এজন্য তিনি মুসলমানদের নির্মল আনন্দ উৎসব করতে মহান আল্লাহর নির্দেশে বছরে দু‘টি ঈদ উৎসবের প্রর্বতন করেন। একটি ‘ঈদুল ফিতর’ বা রোজার ঈদ অন্যটি ‘ঈদুল আজহা’ বা কুরবানির ঈদ। রমযান মাসের দীর্ঘ এক মাস সিয়াম সাধনার পর সাওয়াল মাসের পয়লা তারিখে উদযাপন করা হয় ‘ঈদুল ফিতর’ এবং জিলহাজ্ব মাসের দশ তারিখে পালন করা হয় ‘ঈদুল আজহা’। দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে মুসলমানদের ধৈর্য-ত্যাগ ও নৈতিক-আধ্যাত্মিক উন্নতি সাধিত হয়। এতে তাদের মনে এক স্বর্গীয় সুখ-আনন্দ বিরাজ করে। এ মহান সুখানুভূতি উৎসবে রূপ লাভ করে পবিত্র ঈদুল ফিতরে। অনুরূপভাবে মহান ্আল্লাহর সন্তুষ্টির লক্ষ্যে মানুষের পরিবর্তে পশু কুরবানি করার বিধান করায় মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশিত হয় পবিত্র ঈদুল আজহার উৎসবে।

ঈদগাহে বা ঈদের ময়দানে জামাতে নামাজ আদায় ঈদ উৎসবের প্রধান অনুষঙ্গ। অর্থনৈতিক বৈষম্য, রাজনৈতিক অনৈক্য, সামাজিক অবস্থানের ভিন্নতা সত্ত্বেও ঈদের দিনে সব মুসলমান একত্রিত হয়ে মহান আল্লাহর কাছে আত্মসমর্পণ করে জামাতে নামাজের মাধ্যমে। আল্লাহর গুণকীর্তন ও রাসূলের উপর দরুদ পড়া হয় ঈদের খুৎবাতে। এতে কোন নেতা-নেত্রীর বন্দনা নয়, দলীয় কোন শ্লোগান নয় বরং মহান স্রষ্টার মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়ে থাকে। মুসলমানদের করণীয়-বর্জনীয় বিষয়েও দিকনিদের্শনা দেয়া হয় তাতে। আর সমবেত কণ্ঠের ‘আল্লাহু আকবর’ ধ্বনীতে ঈদের ময়দান মুখরিত হয়ে ওঠে। এ ছাড়া মুসলমানসহ সমগ্র বিশ্বের শান্তি-সমৃদ্ধি কামনা করে মহান আল্লাহর দরবারে বিনম্র প্রার্থনা করা হয় ঈদের মুনাজাতে।

ভাতৃত্ববোধ ও জাতীয় ঐক্য সুসংহত করা ঈদের প্রধান শিক্ষা। সহমর্মিতা-সহানুভূতি জাগ্রত করা ঈদের বিশেষ দীক্ষা। ধনীর পাশাপাশি দরিদ্ররাও যাতে ঈদের আনন্দে অংশ নিতে পারে সেজন্য ধনীদের উপর ‘সাদাকাতুল ফিতর’ আদায় করা অপরিহার্য। অন্যদিকে এ সাদাকাতুল ফিতর অসহায় দরিদ্র মুসলমানের জন্য প্রাপ্য। সাদাকাতুল ফিতর আদায় ও গ্রহণের মাধ্যমে পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা-সহানুভূতি জাগ্রত হয়। ‘মুসলমান পরস্পর ভাই’ মহান আল্লাহর এ ঘোষণা ঈদের দিনে বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়। ভেদাভেদ ভুলে এক মুসলিম অন্য মুসলিমকে বুকে টেনে নেয় জাতীয় এ আনন্দের দিনে। পারস্পরিক উপহার-শুভেচ্ছা বিনিময় ঈদ উৎসবকে প্রীতিময় করে তোলে। আত্মীয়-স্বজন ও প্রিয়জনকে বিভিন্ন ধরনের উপহার দেয়া হয় ঈদ উপলক্ষে। রাজনীতিবীদ, ব্যবসায়ী, সমাজসেবীসহ বিভিন্ন পেশা ও বিভিন্ন বয়সী মানুষের শুভেচ্ছা বিনিময় বিভিন্ন রকমের হয়ে থাকে। সাম্প্রতিককালে ঈদ কার্ড ও মোবাইল ফোনের ক্ষুদে বার্তা, ই-মেইল, ফেসবুকসহ সামাজিক বিভিন্ন যোগাযোগ মাধ্যমে ঈদের শুভেচ্ছা বিনিময় সহজ হয়েছে। জাতীয় এ উৎসবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে ঈদের আনন্দে সম্পৃক্ত করার জন্য কম-বেশি সবাই চেষ্টা করেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঈদ উপলক্ষে দলীয় নেতা-কর্মী, শুভানুধ্যায়ী ও জনগণের সাথে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। ব্যবসায়ীরা ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিয়ে থাকেন। সমাজের সবাইকে ঈদের আনন্দে সম্পৃক্ত করার জন্য সমাজসেবীরা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেন। সাহিত্য-সাংস্কৃতিক কর্মীরা সবাইকে ঈদের আনন্দ দেয়ার জন্য বিশেষ সাহিত্য রচনা ও বিনোদনমূলক কর্মসূচিতে ব্যস্ত থাকেন। গ্রাহককে ঈদের আনন্দ দেয়ার জন্য দর্জি-দোকানিরা দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। প্রিয়জনের সাথে ঈদ করার সহযোগিতার জন্য পরিবহন শ্রমিকরা সব সময় যাত্রীসেবায় ব্যস্ত থাকেন। ঈদে সুস্বাদু ও উপাদেয় খাবার সরবরাহের জন্য কৃষকেরা আপ্রাণ পরিশ্রম করেন। জনগণের ঈদের আনন্দ নিশ্চিত করতে আইনশৃঙ্খলায় নিয়োজিত কর্মীরা নিজেদের ঈদ আনন্দ বিকিয়ে দেন। এভাবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষ পরস্পরকে ঈদের আনন্দ দেয়ার জন্য সাধ্যমত চেষ্টা করেন। ঈদ মুসলমানদের আনন্দ উৎসব হলেও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বাংলাদেশে এ উৎসবে অন্য ধর্মাবলম্বীরাও অংশ নিয়ে থাকেন। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টানসহ সব ধর্মের লোকেরা ঈদ উৎসবে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।

ঈদের আনন্দ উপভোগ করতে আমাদের দেশে বেশ কয়েকদিন সরকারি ছুটি থাকে। ঈদের দিনে ছোট-বড়, নারী-পুরুষ সব মুসলমানই আনন্দ ও হাসিÑখুশিতে মেতে উঠে। শিশু-কিশোর, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সাধ্যমত রঙ-বেরঙের নতুন পোশাক পরে ঈদের আনন্দ উপভোগ করে। তারা অতীত দিনের দুঃখ-যাতনা ভুলে ভবিষ্যতের সুখ-সমৃদ্ধময় জীবন গড়ে তোলার স্বপ্ন বোনে। ঈদ উৎসবে সুস্থ-সুন্দর-কল্যাণকর বিনোদন ইসলামে অনুমোদন আছে। তবে সম্প্রতি কিছু লোক বিনোদনের নামে অশ্লীল ও ক্ষতিকর অপসংস্কৃতি আমদানি করে পবিত্র ঈদের ভাবমর্যাদাকে চরমভাবে ক্ষুণ্ন করছে। আগের দিনে আমাদের দেশে ঈদের উৎসবে বড়দের জন্য হা-ডু-ডু, ফুটবল, কুস্তি খেলা, সাঁতার কাটা, নৌকা বাইচ ইত্যাদি খেলার আয়োজন করা হতো। আর শিশুরা গোল্লাছুট, দাঁড়িয়াবান্ধা, ফুটবল, ঘুড়ি উড়ানো ইত্যদি খেলায় মেতে উঠতো। মা-খালা, দাদী-নানীরা হাসি-তামাসা, গল্প করে বেশ মজা করতো। তখন ঈদ এভাবে আনন্দে-উল্লাসে ভরপুর ছিল। অবশ্য এখনও অনেক গ্রামে ঈদ উপলক্ষে শিশু-কিশোরদের জন্য বিভিন্ন ধরনের খেলা-প্রতিযোগিতার আয়োজন হয়ে থাকে। আর শহুরে শিশু-কিশোররা বিভিন্ন পার্কে-বিনোদন কেন্দ্রে অর্থের বিনিময়ে আনন্দ-খেলা করতে পারে। এতে ধনী পরিবারের শিশুরা অংশ নেয়ার সুযোগ পেলেও দরিদ্র পরিবারের শিশুরা বঞ্চিত থাকে।

ঈদ উৎসবের অর্থনৈতিক গুরুত্বও আছে। পোশাক, জুতা, প্রসাধনীসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ঈদের সময় ক্রয়-বিক্রয় ও লেন-দেন বেশি হয়ে থাকে। এ সুযোগে বহুজাতিক কোম্পানি থেকে শুরু করে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী সবাই ঈদে অতিরিক্ত মুনাফা লুটে। অতিরিক্ত সুবিধার আশায় পরিবহন মালিক-শ্রমিকরা ঈদের অপেক্ষায় থাকে। বোনাস-ভাতার সুবিধা ভোগ করেও অর্থলোভী-ঘুষখোর-দুনীর্তিবাজ অফিসার-কর্মচারীরা ঈদে সেলামি তোলে! দর্জি-দোকানিরা ঈদে অতিরিক্ত অর্থ রোজগারের জন্য অনেক রাত জাগে। ঈদের অতিরিক্ত খরচ মেটানোর জন্য প্রান্তিক আয়ের মানুষেরা অতিরিক্ত পরিশ্রম করে। চোর-ডাকাতরাও ঈদের সময় মওকা খোঁজে। ধার্মিকের ছদ্মাবরণে ঈদে ধর্মবিদ্বেষীরাও নিজেদের ফায়দা লুটে। এমনিভাবে ঈদে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের আয়-রোজগার বাড়ে। এতে দেশের সামগ্রিক অর্থনীতি চাঙ্গা থাকে।

ঈদ বৈশ্বিক উৎসব হলেও এতে স্থানীয় সংস্কৃতির গুরুত্ব আছে। তাই দেখা যায়, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ঈদ উদযাপিত হয় নিজস্ব সংস্কৃতিতে। বাঙালি মুসলমানরা ঈদগাহে যায় সকালে সেমাই-পায়েস ও অন্যান্য মিষ্টান্ন জাতীয় খাবার খেয়ে। আর গোস্ত-খিচুরি, পোলাও-কোরমা ইত্যাদি মুখরোচক খাবার খায় বিকেলে বা রাতে। ঈদের দিনে সাধারণত বাঙালি পুরুষ ও ছেলেরা পায়জামা-পাঞ্জাবি এবং নারীরা শাড়ী, সালোয়ার-কামিস পড়েন। অর্থাৎ বাংলাদেশে ঈদ উদযাপিত হয় বাঙালি সংস্কৃতিতে। এমনিভাবে মালেশিয়া, আমেরিকা, আফ্রিকা, ইউরোপ, সৌদি আরব ও বিশ্বের অন্যান্য দেশের মুসলমানরা ঈদ উদযাপন করেন তাদের নিজস্ব সংস্কৃতিতে। ১৪০০ বছর আগে অর্থাৎ ৬২৪ খ্রিস্টাব্দে মদিনায় ঈদ উৎসব শুরু হয়ে কালক্রমে পরিবর্তিত হয়ে বর্তমানের রূপ ধারণ করেছে। তবে কালপরিক্রমায়, ভৌগোলিক ব্যবধান ও সাংস্কৃতিক রূপান্তরের কারণে ঈদ উৎসবের ধরন পরিবর্তন হলেও এর মৌলিক বিধানাবলী ও মূল চেতনা অপরিবর্তিত আছে।

বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে ঈদের গুরুত্ব কম নয় । ঈদ উপলক্ষে অনেক চলচ্চিত্র, নাটক নির্মিত হয় এবং গানের ক্যাসেট-সিডি বের করা হয়। সরকারি-বেসরকারি টিভি চ্যানেল-রেডিও ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে। দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক পত্রিকাগুলোও ঈদ উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা ও ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। গ্রামে গঞ্জে হা-ডু-ডু, ফুটবল, ক্রিকেট, সাঁতার, নৌকা বাইচ ইত্যাদি খেলার আয়োজন করা হয় ঈদ উপলক্ষে। সাম্প্রতিককালে ঈদ পুর্নমিলনী অনুষ্ঠান ঈদের প্রীতি ও আনন্দকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে ঈদ ইসলামি আদর্শ ও নৈতিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত একটি জাতীয় উৎসব। মানুষের বৈষম্য-ভেদাভেদ দূর করে সাম্য-ভাতৃত্বের ন্যায়ভিত্তিক আনন্দ উৎসব এর লক্ষ্য। উৎসবের মাধ্যমে মহান আল্লাহর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও আত্মসমর্পণ এর উদ্দেশ্য। জুলাই’২৪ বিপ্লবোত্তর বাংলাদেশে এমন ঈদ সকলের কাম্য।

লেখক : আহ্বায়ক, ডক্টরস এসোসিয়েশন অব নন-গবর্নমেন্ট টিচার্স (ড্যাঙ্গট)