ড. মোজাফফর হোসেন

পনের দিনের মতো মক্কা ও মদিনা মিলে অবস্থান করলাম। এই পনের দিনে নানান বিষয়ে অভিজ্ঞতা হলো। একটি ছোট্ট অভিজ্ঞতা। দেখলাম হাজিদেরকে যেখানে সেখানে পানির বোতল ফ্রি দেওয়া হচ্ছে। একদিন আমরা ওহুদ পাহাড় দেখতে গেলাম। পানি ফ্রি দেওয়ার ব্যাপারটি এখানেই শুধু ঘটল, এমন নয়। আরও অনেক জায়গাতেই ঘটেছে। ওহুদ পাহাড় ঐতিহাসিক। ওহুদ পাহাড়ের পাদদেশ হলো নবীজীবনের উল্লেখযোগ্য ব্যাটলফিল্ড। এখানে হয়েছিল মদিনার মুসলিম ও মক্কার কুরাইশদের মধ্যে দ্বিতীয় যুদ্ধ, যা ওহুদ যুদ্ধ নামে পরিচিত। মুসলমানদের নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং নবীজি। আর কুরাইশদের নেতৃত্বে ছিল আবু সুফিয়ান। বদরের যুদ্ধ হয় ৬২৪ খ্রিষ্টাব্দে আর ওহুদ যুদ্ধ হয় বদরের একবছর পরে ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে। মুসলমানদের ৭০ জন সাহাবি এখানে শহীদ হোন। তাদের কবর ওহুদের পাদদেশে রয়েছে। এখানে শত্রুদের আঘাতে নবীজির দন্ত ভেঙে ছিল। ওহুদ যুদ্ধে মুসলমানদের আপাত পরাজয় হলেও এ যুদ্ধ মুসলমানদের জন্য সুদূরপ্রসারী তাৎপর্য বহন করে। যুদ্ধে কুরাইশদের পক্ষে যারা ছিল তারা সকলেই নবীজির পূর্ব পরিচিত এমন কি নবীজির শরীকগোষ্ঠীরও লোকজন। বিখ্যাত সাহাবি ও নবীজির চাচা ‘হামজা’ এ যুদ্ধেই শহীদ হয়েছেন। খালিদ বিন ওলিদ, তিনি তখনও মুসলমান হন নি। তিনি কুরাইশদের পক্ষে যুদ্ধে ব্যাপক নৈপুণ্য দেখান। ওহুদ যুদ্ধের দুই বছর পর খালিদ বিন ওলিদ মুসলমান হোন।

ওহুদ পাহাড়ের পাদদেশে শহীদ সাহাবিদের কবর। কবরগুলোর চারপাশ লোহার নেট বেষ্টিত। নেটের বাইরে দাঁড়িয়ে হামজাসহ সাহাবিদের জন্য দোয়া পড়লাম। তারপর যুদ্ধের সেই দৃশ্যকে উপলব্ধি করার চেষ্টা করলাম, এমন সময় একজন পানি বিক্রেতা পানির বোতল ভর্তি একটি কার্টুন সবেমাত্র বিক্রির উদ্দেশ্যে নিয়ে আসলেন। একটি বোতলও তিনি বিক্রি করতে পারলেন না। সাথে সাথে স্থানীয় মদিনাবাসী ৩০/৩২ বছর বয়সের এক যুবালোক কার্টুনসহ সমস্ত বোতলগুলো কিনে নিয়ে সবাইকে ফ্রি বিতরণ করলেন। প্লস্টিকের বোতল। মুক্তার মতো ঝকঝকে। প্রতিটি বোতলে ২০০ মিলি পানি। আমার মনে হলো, সাহাবিদের কবর জিয়ারতে এসে হাজিরা পানি কিনে খাবে এটা লোকটি বরদাস্ত করতে পারলেন না। আমিও পানির বোতল নিয়ে বের হয়েছিলাম। কিন্তু ইতিমধ্যে পানি শেষ হয়েছিল। অগত্যে আমিও ফ্রি বোতল নিয়ে নিলাম। পানির বোতল হাতে মেঘশূন্য আকাশে তাকালাম। রোদের তীব্র ঝলক। মনের ভিতর অফুরন্ত কৌতূহল। যুদ্ধের ভয়াবহতা অনুমান করার চেষ্টা করলাম। এভাবে কেটে গেল কয়েক মিনিট। চোখ ফিরালাম আশপাশের মানুষের দিকে। একজন আরব ইশারায় বোঝালেন, এখানে তাবুর নিচে পোলাও বিতরণ করা হচ্ছে, আপনাদের ইচ্ছা করলে খেতে পারেন। হাজিদের সম্মানে এসব আয়োজন। সরকারের পক্ষ থেকে নয়, ব্যক্তি মানুষের পক্ষ থেকে। আমরা পোলাও খেলাম। আমার ক্ষুধা ছিল না। আরব্য রান্নার স্বাদ নেওয়ার জন্য খেয়ে নিলাম।

মক্কায় পানির গুরুত্ব আমাকে বিস্মিত করেছে। খেয়াল করেছি এখানে নানাভাবে পানি খেজুর বিতরণ করা হয়। একদিন মাতাফে তাওয়াফ শেষে আছরের নামাজের জন্য প্রস্তুতি নেয়া হচ্ছে, এই সময় পানির বোতল ফ্রি বিতরণ করা হলো। কেউ নিল কেউ পেল না। কারণ কারো হাতে হাতে বোতল দেওয়া হলো না। দূর থেকে বোতল ছুড়ে দেওয়া হচ্ছিল। আমিও একটা বোতল ধরতে গিয়ে ব্যর্থ হই। পিপাসা লেগেছিল। প্রচন্ড তাপে প্রচুর পানির চাহিদা বাড়ে, আর সেজন্য পানি দিয়ে সবাইকে আপ্যায়ন করে মক্কাবাসী। পানির গুরুত্ব বোঝাতে আর একটা গল্প বলি; আমি তায়েফ থেকে মক্কায় আসার জন্য ভাড়ায় চালিত গাড়ির অপেক্ষা করছি। রাস্তায় ছুটে চলা গাড়ি লক্ষ করে হাত নাড়ছি। দেখি একটি প্রাইভেট কার আমাদের সামনে এসে দাঁড়াল। ভিতরে গাড়ির স্টিয়ারিং-এ পঁচিশ/ কুড়ি বছর বয়সের এক যুবক। আমরা চারজন ছিলাম। দুজন ইন্ডিয়ান আর দুজন আমরা বাংলাদেশি। আমরা যুবকের সাথে ভাড়া দরদাম করলাম। তাকে এক একজনের পনের রিয়াল বললাম। যুবক তাতেই রাজি হলো। আমরা গাড়িতে উঠলাম। মাঝামাঝি পথে এসে যুবক রাস্তার পাশের দোকান থেকে কোক আর পানির বোতল কিনলেন। সে কোক নিজের কাছে রেখে দিল আর আমাদেরকে পানির বোতল দিয়ে দিল। কোকের চেয়ে পানি দেওয়াই এখানে সম্মানের। বাংলাদেশে হয়তো আমরা মেহমানকে কোক কিনে খাওয়াতাম। যুবক কথাবার্তার এক সময় বললেন; তিনি এখনো বিয়ে করেন নি। ব্যবসা করে টাকা জমাচ্ছেন। বিয়েতে মোহরানা নগদ প্রদানের উদ্দেশ্যে। যুবকের বাড়ি তায়েফে। তিনি যাচ্ছেন মক্কাতে ওমরা করতে। তিনি এ জীবনে বহুবার হজ ও ওমরা করেছেন। প্রতি বছর, কখনো ছ মাস পরও, তিনি আল্লাহর অনুগ্রহ লাভের আশায় ওমরা করেন। তিনি আরও বললেন; তায়েফের মানুষ নিয়মিত ওমরা করেন। লক্ষ করলাম তার পরনেও এহরামের কাপড়। যুবক আমাদের পরিচয় জেনেও খুশি হলেন। আলাপ হতে হতে আমরা পৌঁছে গেলাম মিসফালার কাছাকাছি পাহাড়ের টানেলে। যুবক মক্কায় আমাদেরকে নেমে দিলেন। কিন্তু ভাড়া আর নিলেন না। অবিবাহিত এই আরব্য যুবকের উদারতা দেখে অভিভূত না হয়ে পারলাম না।