আরজাত হোসেন
প্রাচীন ঋগে¦দের ঋষি থেকে শুরু করে হোমার, রুমি, রবীন্দ্রনাথ, নজরুল প্রত্যেক যুগেই কবিরা সাহিত্য রচনার সাথে মানুষের মনের অজানা দিকগুলো উন্মোচন করেছেন। সেই অর্থে কবিরা ছিলেন ইতিহাসের প্রথম মনোবিজ্ঞানী। বলতে পারি - সব মনোবিজ্ঞানী কবি না হলেও সব কবিই কিন্তু মনোবিজ্ঞানী। বিজ্ঞানী-শিল্পী - বিজ্ঞান-শিল্প দুটোর চমকপ্রদ সাদৃশ্য হচ্ছে সৃষ্টি ও অনুসন্ধান, কৌতূহল ও কল্পনা এবং সত্য অনুসন্ধান। মাঝেমাঝে আমরা কবি, আবৃত্তিকার, আলোচক, সমালোচক, গীতিকার এবং কিছু যুক্তিবাদী ব্যক্তিদেরও এক কাতারে নিয়ে এসে “কবি” ট্যাগ লাগিয়ে দিই। কিন্তু এতে চাপা পড়ে প্রকৃত কবির। এজন্যই কবি জীবনানন্দ দাশ তাঁর “কবিতার কথা” নামের প্রবন্ধ গ্রন্থে বলেছেন, “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”।
কবিকে পৃথক করবো কীভাবে
প্লেটো বলেছেন: “ Poet is a light and winged and holy thing ” “কবি হল এক লঘু, পাখাযুক্ত এবং পবিত্র সত্তা”। এই উক্তি কবিকে দৈব বা বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন হিসেবে দেখায়। কবিকে চেনার আগে কবিতাকে চিনতে হবে। কবিতা কী ? তারপর জানতে পারবো কে কবি। অর্থাৎ এটা স্পষ্ট যে প্রকৃত কবিতার রচয়িতাই প্রকৃত কবি। যখন একটি লেখা সম্পূর্ণভাবে কাব্যিক রূপ পায়, কবিতা হওয়ার জন্য সমস্ত উপাদান বিদ্যমান তাহলে সেটাই কবিতা এবং এর স্রষ্টাই মূলত কবি। আমি এর আগে বিভিন্ন আলোচনায় অবশ্য উল্লেখ করেছি যে, “কবিতা লেখার রীতিই মূলত কবিকে পৃথক করে “
যদি কবিতা লেখার সুনির্দিষ্ট রীতি না থাকতো তাহলে আমি জগতের সকল জ্ঞানী ব্যক্তিকে কবি আখ্যা দিতাম। এই যে কবিতায় একটা নির্দিষ্ট নিয়ম / রীতি আছে বলেই কেউ কেউ কবি আর বাকি সবাই মতপ্রকাশী। অর্থাৎ বলতে পারি - কবিতার ছন্দরীতিই কবিকে পৃথক করার উত্তম উপায়।
কবির বিশিষ্টতা কী ?
একটু ইতিহাস খতিয়ে দেখা যাক,
“প্রাচীন গ্রীসে কবিকে বলা হতো Poet(poiein = to make ” অর্থাৎ সৃষ্টিকারী)।”
“প্রাচীন ভারতে কবিকে বলা হতো ‘কবি’, যার অর্থ ছিল দ্রষ্টা বা যিনি দেখতে পান অন্যরা যা দেখে না।”
অর্থাৎ কবি হচ্ছে সমাজের দর্পণ ও পথপ্রদর্শক। একজন প্রকৃত কবির মাঝে লুকায়িত আছে মনোবিজ্ঞান, যাকে আমি কবির জন্য দৈব শক্তি বলে মনে করি। যে বুঝতে পারে, বলতে পারে, লিখতে পারে গান / সেই তো কবি, ধরার রবি, উঁচু যার সম্মান। যুগ যুগ ধরে কবিরা সমাজ, রাষ্ট্র, প্রকৃতি ও সত্যকে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করেছেন। কবি মাইকেল মধুসূদন দত্তের “কবি” কবিতায় তিনি বলেছেন – “সেই কবি মোর মতে, কল্পনা সুন্দরী / যার মনঃ-কমলেতে পাতেন আসন,/ অস্তাগামি ভানু- প্রভা- সদৃশ বিতরি / ভাবের সংসারে তার সুবর্ণ কিরণ।/ আনন্দ, আক্ষেপ, ক্রোধ যার আজ্ঞা মানে / অরণ্যে কুসুম ফোটে যার ইচ্ছা-বলে; / নন্দন-কানন হতে যে সুজন আনে / পারিজাত কুসুমের রম্য পরিমলে; / মরুভূমে তুষ্ট হয়ে যাহার ধেয়ানে / বহে জলবতী নদী মৃদু কলকলে!”
কবি বলতে চেয়েছেন - মানুষের কল্পনা ও মননের সৌন্দর্যই প্রকৃতির সৃষ্টি ও আনন্দের উৎস। একজন কবির মধ্যে থাকবে প্রকৃতি ও মানবের সংযোগ, সৌন্দর্যবোধের গভীরতা, আবেগ ও অনুভূতির প্রকাশ, দর্শন ও দার্শনিক ভাবনা। প্রাচীনকাল থেকেই কবিরা বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে নিজেদের শৈল্পিক পরিচয় দিয়েছেন । যেমন - আরব দেশে কবি ছিলেন “শায়ের”। তাঁরা গোত্র, ধর্ম ও প্রেম নিয়ে কবিতা রচনা করতেন।
সমাজসচেতন কবি: অন্যায়ের বিরুদ্ধে কলম ধরেন। (যেমন- নজরুল)
প্রকৃতিপ্রেমী কবি: প্রকৃতিকে নতুন চোখে দেখান। (যেমন- জীবনানন্দ)
দার্শনিক কবি: জীবনের গভীরতা নিয়ে ভাবেন। (যেমন- রবীন্দ্রনাথ)
প্রেমের কবি: মানবপ্রেম, দেশপ্রেম বা নারী-পুরুষের প্রেমকে রূপ দেন।
অকবি;- প্রায় সকল মানুষই ব্যক্তিগতভাবে নিজেদের মত খুব সুন্দরভাবে প্রকাশ করতে পারে। তাই বলে সবাই কি কবি ? উল্লেখ্য যে কিছু কিছু মানুষের কবিত্ব আছে তবু কবি নয়! একটু আশ্চর্যের। কবিত্ব হচ্ছে যার মধ্যে কবি হওয়ার গুণ আছে। কবিতা রচার শক্তি, বা কবির ভাব। কিন্তু কবি নয়। আর কবি হচ্ছে - কবিতা রচয়িতা, বিদ্বান, পণ্ডিত ।
আমি বিশেষ করে কবি এবং অকবি বাছাইয়ের জন্য শব্দমালার বাইরে এসে ছন্দকে বেশি গুরুত্ব দিই। আবার আমাদের মধ্যে কেউ কেউ আছেন যারা আবৃত্তিকারকে পাক্কা কবি দাবি করি এবং কিছু আবৃত্তিকার সেই সুবাদে পাণ্ডুলিপি করতে ব্যস্ত !! আবৃত্তিকার বলেই যে কবি তা মোটেও নয়। গুছিয়ে মতপ্রকাশ করলে সে শুধু মতপ্রকাশীই । আর কবি হতে শৈল্পিক বিন্যাস, ছন্দ, সৃজনশীল ইত্যাদি বিষয় প্রয়োজন।
পরিশেষে বলি;- কবি যুগকে ধারণ করেন, যুগকে অতিক্রমও করেন। সমাজ পরিবর্তনের ক্ষেত্রে কবি অগ্রপথিকের ভূমিকা পালন করেন। রবীন্দ্রনাথের মানবতাবাদী দৃষ্টি। নজরুলের বিদ্রোহী স্বর। জীবনানন্দের প্রকৃতি-প্রেম। লালনের দার্শনিক সুর। এভাবে কবিরা বিভিন্ন শাখায় নিজের জাদু দেখিয়েছেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের “কবি” কবিতায় বলেনথ
“ওই যেতেছেন কবি কাননের পথ দিয়া ,
কভু বা অবাক , কভু ভকতি-বিহ্বল হিয়া।
নিজের প্রাণের মাঝে
একটি যে বীণা বাজে ,
সে বাণী শুনিতেছেন হৃদয় মাঝারে গিয়া।”
কবির অন্তরেই সৃষ্টির অনুপ্রেরণা ও সৌন্দর্যের উৎস লুকিয়ে আছে, যা তিনি প্রকৃতির সঙ্গে মিলিয়ে অনুভব করেন, ছন্দে দেন রূপরেখা। শব্দের আঁচড়, বর্ণের প্রাচীর ও শৈল্পিক বিন্যাসে হয়ে ওঠে কবিতা আর এই শিল্পের স্রষ্টাকে বলি কবি।