মনসুর আহমদ

একটি জাতির ঐতিহ্য ও ইতিহাস চেতনা জাতির অস্তিত্বের জন্য অতীব প্রয়োজন। ঐতিহ্য মূলতঃ কোন আরোপিত সম্পদ নয়, গ্রহণ, বর্জন ও অর্জনের মাধ্যমেই তার ব্যপ্তি; সুতরাং ঐতিহ্যের মূল সম্পদকে গ্রহণ করে এবং তা পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের মাধ্যমে ব্যাপ্ত করে যে সাহিত্য রচিত হয় তার মজবুত স্থাপন ও স্থায়ী মূল্য অপরিসীম। টি এস এলিয়ট ও আইরিশ কবি ডাব্লিউ বি ইয়েটস দেখিয়েছেন ঐতিহ্য কবিতার জন্য কত গভীর তাৎপর্য বহন করে। সাহিত্য সৃষ্টিতে ঐতিহ্য অবলম্বনকারী বিখ্যাত ইংরেজ কবি ইয়েটস ও এলিয়ট, উর্দু মহাকবি ইকবাল এবং বাংলার কবি মধুসূদন ছিলেন ফররুখের প্রিয় কবিদের সূচিতে শীর্ষ অবস্থানে।

কবি ফররুখ আহমদের সমসাময়িক ও সহকর্মীদের সমগ্র উদ্যোগ ঐতিহ্য চেতনা মণ্ডিত সাহিত্য সৃষ্টিতে যতখানি ভূমিকা রেখেছে, তার চেয়ে অধিক তাৎপর্যময় হয়ে উঠেছে ফরুখ আহমদের একক সৃজনবুদ্ধি ও ক্লান্তিহীন প্রচেষ্টা। নিছক আবেগ অতিশয্য প্রবাহে কবি এ পথে বেরিয়ে পড়েননি। কবির কাব্যপ্রতিভার সাথে ঐতিহ্যবোধ ও গভীরতর বিশ্বাসের সমন্বয় সাধনই তাঁকে এ পথে বিচরণে সার্থক করেছে। কবির বিশ্বাসের সাথে আলোকের ও বাণীমূর্তিও দৃঢ়তর বন্ধন জাতীয় কাব্য সৃষ্টির ভূমিকায় এতটা সফলতা প্রদান করেছে।

কবি ফররুখ আহমদ ঐতিহ্য সচেতন ইসলামী পুনর্জাগরণের কবি। ঐতিহ্য চেতনাকে উজ্জীবিত করার প্রয়াসে অনেক সময় তিনি তার রচনায় মরুচারিতা, সমুদ্রাভিযান ও আরব্য আবহ নির্মাণে সচেষ্ট হয়েছেন। কবি মুসলিম জাগরণের নায়ক ও ইসলামী সংস্কৃতির তুর্যবাদকদের অভিনন্দন জানিয়ে যে কবিতা রচনা করেছেন তাতে রয়েছে মুসলিম ঐতিহ্য ও মরুচারিতার মনোহর প্রতিচ্ছবি। কবিকন্ঠে ধ্বনিত হয়েছে-

“তোমরা এনেছো জ্যোছনা-ভেজানা স্বপ্ন-সবুজ শাখে

গভীর রাতের গূঢ় মোরাকাবা বন-ডাহুকীর ডাকে,

কোথা নলবনে চৌচির হয়ে বাঁশী যেতে চায় ফেটে,

কোথা জোলায়খা দেখায় মাশুক চাঁপার আঙ্গুল কেটে।

কোথা মজনুর বিরহী হৃদয়ে আকাশের নিরবতা

কোন ঝরোকায় শাহেরজাদীর ঘুম ভাঙ্গা রূপকতা,

নিশীত রাতের ঘনায়িত ব্যথা কোথা লাইলির প্রাণে,

মৌসুমী হাওয়া বলে গেছে বুঝি তোমাদের কানে কানে।

তোমাদের সুরে শুনেছি আমরা পথ চলবার বাঁশী

রুদ্ধ কপাটে যেখানে ঝঞ্ঝা বেজেছে সর্বনাশী।

ম্লান জড়তার জড়বাদ - বাধ ভাঙ্গে তোমাদের হাতে

গোলাব কলির ফুটবার খোঁজ দাও অমাবশ্যাতে

বন্ধু! তোমরা এনোছো দরদ উমরের বুক হতে

কল্পলোকের আকাশ ছেড়েও নেমেছো ধূলির স্রোতে।

দুর্গত জনগণের সঙ্গে বেঁটে নাও ব্যথা বিষ,

মরু ওয়েসিসে জাগাও তোমরা দোয়েলের মিঠে শিস্”

[দল-বাঁধা বুলবুলি, মাসিক মোহাম্মদী, জ্যৈষ্ঠ , ১৩৫০]

কবি মুসলিম জাগরণের নায়ক ও ইসলামী সংস্কৃতির তুর্যবাদকদের অভিনন্দন জানিয়ে রচনা করেছেন ‘সিরাজাম মুনিরা। তিনি লিখেছেন,-

‘আজকে উমর-পন্থী পথীর দিকে দিকে প্রয়োজন

পিঠে বোঝা নিয়ে পাড়ি দেবে যারা প্রান্তর প্রাণপণ ,

উষর রাতের অনাবাদী মাঠে ফসল ফলাবে যারা,

দিক-দিগন্তে তাদেরে খুঁজিয়া ফিরিছ সর্বহারা। ’[ উমর- দারাজ দিল।]

অন্য জায়গায় লিখেছেন-

‘তাঁর তক্বীরে কাঁপে অম্বর ফাটে মরু -প্রান্তর ,

গর্জে খোদার সিংহ:আল্লা, আল্লাহু আক্ব।

নবীজীর পাশে আল্লার সেনা এল আলী হায়দার। ’

[আলী হায়দার। ]

কবিতায় ঐতিহ্যের এমন রূপায়ণে ফররুখ আহমদের ভূমিকা আধুনিক কবিদের সবার শীর্ষে বললে অত্যুক্তি হবে না। মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ লিখেছেন: “মুসলিম ঐতিহ্যের ছায়া-ঘেরা এই অপূর্ব অবদান কবিকে চিরদিনের জন্য স্মরণীয় কর রাখবে সন্দেহ নেই। ”কবিতায় ঐতিহ্যের এমন নবরূপায়ণে ফররুখ আহমদের ভূমিকা আধুনিক কবিদের সবার শীর্ষে বললে অত্যুক্তি হবে না। তিনি পুঁথি সাহিত্যের শব্দসম্ভার, উপমা, উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পকে অবলম্বন করে আধুনিক কাব্য রচনার প্রচেষ্টায় সফলকাম ও স্মরণীয় ব্যক্তিত্ব।

কবি ফররুখ আহমদের প্রথম কাব্য গ্রন্থ ‘সাত সাগরের মাঝি’র রচনা কাল ১৯৪৩-৪৪ সাল। অশিক্ষিত, অবহেলিত ও দুর্দশার পঙ্কে নিমজ্জিত বাঙ্গালী মুসলমানদেরকে উজ্জীবিত করার মানসেই রচিত হয়েছে ‘সাত সাগরের মাঝি।’ মুসলিম সম্প্রদায়ের জীবন ও জীবনের অনুসংগগুলি স্বপ্নালোকে ও আদর্শকে রোমান্টিকতা ও আদর্শিকতার সমন্বয়ে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি তাঁর ‘সাত সাগরের মাঝিতে। ’বাংলা কবিতায় মুসলিম রেনেসাঁর যে সুরটি নজরুল ইসলাম সৃষ্টি করেছিলেন কবি ফররুখের ‘সাত সাগরের মাঝি’ তারই পরিপূরক। এ কাব্যে আরবের মরুময়তা ও বিখ্যাত আরব্য উপন্যাস ‘আলফা লায়লা ওয়া লায়লা’র প্রাণস্পর্শী চিত্র ফুটে উঠেছে মনোহারী রূপ নিয়ে। যেমন:

‘ভেঙে ফেলো আজ খাকের মমতা আকাশে উঠেছে চাঁদ,

দরিয়ার বুকে দামাল জোয়ার ভাঙছে বালুর বাঁধ,

ছিঁড়ে ফেল আজ আয়েশী রাতের মখমল -অবসাদ ,

নতুন পানিতে হাল খুলে দাও , হে মাঝি সিন্দবাদ! ’

ঐতিহ্য ও আদর্শিকতার এমন সফল সমন্বয় কাব্য জগতে সত্যই বিরল। কবি শামসুর রাহমান বলেছেন: “ ইসলামী ঐতিহ্যের পুনরুজ্জীবনে যেসব কবি বিশ্বাসী ফররুখ আহমদ তাঁদের পুরোধ high Priest । ফররুখ আহমদের “ সাত সাগরের মাঝি” আমাদের কাব্যসাহিত্যের একটি উজ্জ্বল বই। সর্বপ্রথম হলেও “সাত সাগরের মাঝি”ই এখন পর্যন্ত তাঁর সবচেয়ে পরিণত গ্রন্থ। এ কাব্যগ্রন্থেই তাঁর কাব্যশক্তির সবগুলো লক্ষণ বর্তমান। আরবী-ফারসী শব্দের সুনিপুণ ব্যবহার করে, পুঁথিসাহিত্য থেকে উপাদান সংগ্রহ করে তিনি নিজস্ব একটি ডিকসান তৈরী করতে সক্ষম হয়েছেন। ”

কবি ফররুখ আহমদ মানবতাবাদী আদর্শ উজ্জীবনের জন্য ‘হেরার রাজ তোরণ’-এর দিকে প্রত্যাবর্তনের প্রয়োজনয়িতা অনুভব করেছেন গভীর ভাবে। কবি তাই বার বার সাতসাগরের মাঝিকে আহ্বান জানিয়েছেন ‘ হেরার রাজতোরণ’-এর দিকে ’তার কিশতি চালাতে। আশা করা যায় তাহলে সুন্দরতর দিনকে পুনরায় ফিরে পাওয়া যাবে। কবি তাই বলেন:

‘এখানে এখন রাত্রি এসেছে নেমে,

তবু দেখা যায় দূরে বহু দূরে হেরার রাজ-তোরণ,

এখানে এখন প্রবল ক্ষুধায় মানুষ উঠছে কেঁপে,

এখানে এখন অজস্র ধারা উঠছে দু’ চোখ ছেপে

তবু দেখা যাায় দূরে বহু দূরে হেরার রাজ-তোরণ। ’

[সাত সাগরের মাঝি]

ফররুখ আহমদেও কবির দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “ সিরাজাম মুনিরা। “এর রচনা কাল ১৯৪৩-৪৬ সাল। উপমা ও চিত্রকল্পে মানবতার আদর্শকে তিনি অনবদ্য ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন এ কাব্যে। “সাত সাগরের মাঝি”র কবি স্বপ্ন “ সিরাজাম মুনিরা”তে খোলাফায়ে রাশেদীনের

জীবনালোকে নতুন রাষ্ট্র গড়ার স্বপ্নের মধ্যে দিয়েই প্রথম বাস্তবায়নের পথ খুঁজছে। মানবতাবাদী আদর্শের উজ্জীবনের প্রত্যাশায় কবি মানবতার মুক্তির দিশারী হযরত মুহম্মদ (সঃ) এবং খোলাফায়ে রাশেদা সহ কয়েক জন গাউস কুতুব, পীর ও মরমী সাধকদের মানবিক আদর্শ ও জীবন সৌন্দর্যকে এ কাব্যে ফুটিয়ে তুলেছেন কবি। ত্যাগ তিতিক্ষা ও প্রেম ভালবাসার যে আদর্শ তাঁরা মানুষের সামনে রেখে গেছেন তাকে প্রকৃত ইনসানের আদর্শ হিসেবে পেশ করছেন কবি ফররুখ। তিনি মানবতা বোধের জাগরণের জন্য গাইলেন:

“সত্য ন্যায়ের সে পথে ভাঙুক সব সংকীর্ণতা,

হারানো সে -দিন এ রাতের সাথে আবার বলুক কথা ,

অসুক আবার এ হাতে আমার র্দোরা তলোয়ার

এই কলুষিত জীবনের বুকে হানিতে শেষ প্রহার ।

এ নির্লজ্জ মানবতাহীন পশুদের যেথা ভীড়,

দ্বীনের রোশ্নি মুছে যারা টানে শামিয়ানা রাত্রির

সেথা ওমরের র্দোরা হানিয়া আনো পথ মুক্তির

আনো আজাদীর শুভ্রতা , ভাঙো শঙ্কা ধরিত্রীর। ”

[উমর -দারাজ দিল]

মণীষী ভূদেব মুখোপাধ্যায় আমাদের স্বপ্রকৃতি সচেতন করবার অভিপ্রায়ে বলেছেন:“ জাতিভেদে সর্বপ্রকার সাহিত্য রচনা রীতী ভিন্ন হয়। ইতিবৃত্ত প্রণয়নের প্রণালীও স্বতন্ত্র হয়।——মূলত সকল জাতির কাব্য, ইতিহাস, দর্শন শাস্ত্রাদি তাহাদিগের বিশেষ জাতীয় লক্ষন প্রকাশ করে। ”এ কথাটি ফররুখ রচনাবলীতে সুস্পষ্টভাবে সত্য প্রমাণিত। অমুসলিম ও প্রাগ ইসলামী যুগের নানা চিত্র ও চরিত্রকে কবি আপন কল্পনায় আদর্শের প্রতীক রূপে চিত্রিত করেছেন। এমন এক চরিত্র ‘হাতেম তা’য়ী’। কবির কাব্যগ্রন্থ ‘হাতেম তা’য়ী ’রচিত হয়েছে প্রাগ ইসলামী যুগের আরবের কিংবদন্তী সৃষ্টিকারী এক সাধারণ মানুষ হাতেম তা’য়ীকে কেদ্র করে। পুঁথি সাহিত্যের সম্পদশালী অঙ্গকে ভিত্তি করে কাব্যরচনায় এবং পুঁথি সাহিত্যের নবরূপায়ণে ফররুখ আহমদের কৃতিত্ব উল্লেখ যোগ্য। কবি তাঁর এ কাব্যে সৈযদ হামজার পুঁথি ‘হাতেম তা’য়ীর’ একটি প্রত্যক্ষ নিদর্শন ফুটিয়ে তুলেছেন তার স্বীয় বৈশিষ্ট্যে। পুঁথি সাহিত্যের শব্দসম্ভার, উপমা . উৎপ্রেক্ষা ও চিত্রকল্পকে অবলম্বন করে আধুকি আঙ্গিকে কাব্য রচনার প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে ফররুখ আহমদ তুলনাহীন।

কবি মানবতা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নই দেখেছেনতাঁ ‘হাতেম ত’ায়ী’ কাব্যে। পূর্ণ মানুষ হয়ে ওঠার পথ বড়ই কন্টকাকীর্ণ। হাতেম তা’য়ীর সাধনা সেই বন্ধুর পথকে জয় করার সাধনা। এ সত্যই ফুটে উঠেছে ‘হাতেম তা’য়ী’ কাব্যে। কবি বলেন:

“অথবা কি সাধনায় পায় খুঁজে পূর্ণতা মানুষ,

বিপথে বিভ্রান্ত হয়ে মরে ফের কোথায় বেহুঁশ,

কি উপায়ে, কোন পথে কামালাৎ পায় খুঁজে প্রাণ ,

কোথায় অপূর্ণ সত্তা হয় পূর্ণ কামিল ইনসান,

অসত্যের অন্ধকার, -পার হয়ে তরঙ্গ ফেনিল

কোথায় জীবন -তরী পায় খুঁজে অভীষ্ট মঞ্জিল

কিম্বা হয় বানচাল কোন্খানে কেন কি কারণে

জেনে নিতে চাই আমি প্রাণের নিগূঢ় প্রয়োজনে। ”

[হাতেম তা’য়ী- পহেলা সওয়াল]

একটি সত্য এইযে, কবি সাহিত্যিকদের সৃষ্টি তাঁর সমকালকে যেমন ভাবে আন্দোলিত করে পরবর্তী সময়কে কখন তেমন তীব্রভাবে নাড়া দেয় না। কারণ মানুষের ভাবনা, বিশ্বাস, রুচিবোধ , জীবনবোধ সময় প্রবাহের সাথে নিরন্তর পরিবর্র্তিত হতে থাকে, নতুন ধারণা, নতুন অনুসঙ্গ জন্ম নেয় মানুষের মনে। কিন্তু এমন কিছু সৃষ্টি আছে যা কালের প্রাকার ডিঙ্গিয়ে বহুকাল মানুষের মনে দোলা দিতে থাকে। প্রাচীন অরবী সাহিত্যের এমন কিছু উপমা ও উপাদান যেন কবি চিত্তকে দোলা দিয়েছে। আরবী কবি ইমরাউল কায়েস লবঙ্গ ফুলকে তার কাব্যে উপমা হিসেবে বেছে নিয়েছিলেন। “যখন তারা দু’জন দাঁড়াত তখন লবঙ্গের (কারাণ ফুর) গন্ধ বহন কারী পূবালী বাতাসের মতো ( নাসিম) তারা মৃগনাভীর গন্ধ নিঃসরণ করত। ” কবি ফররুখ লবঙ্গ ফূলকে আরবী কবির অনুকরণে নয় বরং নিজস্ব শৈলিতে তাঁর রচনায় স্থান দিয়েছেন। যেমন:

“তুমি কি ভুলেছ লবঙ্গ ফুল, এলাচের মৌসুমী,

যেখানে ধূলিতে, কাঁকরে দিনের জাফরান খোলে কলি,

যেখানে মুগ্ধ ইয়সমিনের শুভ্র ললাট চুমি

ঈরীর দেশের স্বপ্ন -সেহেলি জাগে গুলে বকাওলী।”

[সাত -সাগরের মাঝি]

আরবী সাহিত্যের সপ্তর্ষি মণ্ডল যেন কবিকে বিমোহিত করেছে। আরবী সাহিত্যে জু’আর রুম্মার, ইবনুল মুতাজ, আল আসহাব বিন রুমাইলা, ইবনে তাসরিয়া প্রমুখ কবি তাঁদের কবিতায় সপ্তর্ষি মণ্ডলের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। ফরুখ তাঁর কাব্যে সরাসরি সপ্তর্ষি মণ্ডলকে চিত্রিত না করলেও সুরাত জামাল ও সেতারার কথা বার বার উচ্চারণ করেছেন। যেমন:

* ‘সুরাত জামাল জওয়ানির ঠোঁটে কেটেছে স্বপ্নরাত

শুনেছি নেশার ঘোর কেটে যেতে এসেছে নয়া প্রভাত।’ [ সিন্দবাদ]

*‘দেখ আসমানে ফোটে সেতারার কলি,

আরশির মত নিটোল পানিতে মুখ দেখে বকাওলি” [বা’র দরিয়া]

*“হে মাঝি তোমার সেতারা নেভেনি এ -কথা জানোতো তুমি ,

তোমার চাঁদনি রাতের স্বপ্ন দেখেছে এ মরুভূিম,” [সাত-সাগরের মাঝি]

“তোমাকে মুশতারি তারা জীবনে দেখছি যতবার

জেগেছি বিস্ময়ে তত । প্রথম শৈশব দিন থেকে” [ মুশ্তারি সেতারা]

*“মুশতারি সিতারা জ্বলে শতাব্দীর নিরন্ধ্র তিমিরে,” [ সাম্পান মাঝির গান]

বিশুদ্ধ সাহিত্যরস মানবিক অনুভূতি বা চিত্তের অন্যবিধ আহার্যের চাইতেও বেশি কিছু ফররুখর কাছ থেকে সংগ্রহ করেছে এদেশের মুসলিম সমাজ। কবির সৃষ্টি জল সিঞ্চন করেছে আমাদর রাজনৈতিক সাং¯স্কৃতিক ও স্বদেশিকতার চেতনার শিকড়ে। ঐতিহ্য সচেতন ইসলামী পুনর্জাগরণের কবি যে ভাবে পুঁথি ও প্রাচীন আরবী এতিহ্য আত্মস্ত করে আধুনিক চিন্তার আলোকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যে সাহিত্য নির্মাণ করেছেন তা ফররুখ উত্তর -সুরিদের জন্য আলোক বর্তিকা হিসেবে কাজ করবে।

কবি ফররুখের কাব্য প্রতিভার প্রদীপ্ত ছটায় বাংলা কাব্যের দিগন্ত যেমন প্রসারিত ও আলোকিত হয়েছে, তেমন তাঁর জীবনবোধের দীপ্তি ও ঐতিহ্যানুসারিতার স্নিগ্ধ আলোয় বাংলা সাহিত্য নব জীবন ও অপূর্ব রূপ অর্জন করেছে। কবি ফররুখের ঐতিহ্য প্রীতির জয়গান গেয়ে মুহম্মদ আবদুল হাই লিখেছেন, “কবি হিসাবে তিনি বিশিষ্টতা ও খ্যাতি অর্জন করেছেন ইসলামের ইতিহাস চেতনা ও মুসলিম জীবনাদর্শমূলক সাহিত্যের ঐতিহ্য প্রীতির জন্য। তাঁর শব্দানুশীলন, বাক্য বিন্যাস ও ভাষা ব্যবহারের রীতিতে ইসলামের অতীত যুগের চিত্র ও আদর্শ প্রতিফলিত হয়েছে। এ যুগে মুসলিম জীবন ও মানসের আদর্শ বিচ্যুতির জন্যে কবি বেদনাবোধ করেছেন। সং¯কারকামী মনের আশ্চর্য প্রতিফলন রয়েছে তাঁর শব্দ চয়ন কুশলতায়।”